তরুণেরা বর্তমানে বাঁচে, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে না, তাই দাবি আদায়ে পথে নামতেও তাঁরা কোনো পিছুটান বোধ করেন না।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলন থেকে সৃষ্ট গণ–অভ্যুত্থানে তখন উত্তাল দেশ। শিক্ষার্থীরা কোথাও মিছিল করছেন তো কোথাও গুলির সামনে পেতে দিচ্ছেন বুক। কোথাও আবার প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দেয়ালে আঁকছেন রঙিন স্বপ্ন।
সে রকম সময়েই ঢাকার মোহাম্মদপুরে সড়ক বিভাজকের ওপর বসে থাকা চল্লিশোর্ধ্ব ইসমত জেরিনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর চোখ সামনের দেয়ালে, যেখানে একদল কিশোর-কিশোরী লিখছে তাদের দাবির কথা, মনের কথা।
ইসমত জানালেন, দলটিতে রয়েছে তাঁর মেয়েও। কিছুতেই মেয়েকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারেননি। বন্ধুদের সঙ্গে সেও নামতে চায় পথে। প্রথমে মানা করেছিলেন, তারপর নিজের স্কুল-কলেজজীবনের বাঁধনহারা দিনগুলোর কথা ভেবে আর বাধা দেননি। কিন্তু মায়ের মন মানে না, তাই মেয়ে নিরাপদে আছে কি না দেখতে তিনিও নেমেছেন পথে।
সম্প্রতি যে প্রচণ্ড আন্দোলন ও বিপুল গণজোয়ার দেখল দেশ, তার নেতৃত্ব পুরোটাই ছিল তরুণদের হাতে। রাষ্ট্র, পুলিশ, জেল–জুলুম; কোনো কিছুর ভয়ই তাঁদের দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সফল আন্দোলন কীভাবে করতে হয়, দেখিয়েছেন তাঁরা। ঘরে তুলেছেন আন্দোলনের ফসলও।
কেবল ২০২৪ সালের এই আন্দোলনই নয়, যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ও মিছিলে বুক পেতে দিয়েছিলেন তরুণেরা। এরপর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরে যাঁর যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে লড়াই করতে নেমে যাওয়ার ডাকে প্রথম সাড়া তো তরুণেরাই দিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের মার্চ মাসের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, দেশে তরুণ জনশক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখের বেশি। মূলত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত তরুণের সংখ্যা এটি। এর বাইরেও তরুণদের বড় একটি অংশ রয়েছে, যাঁরা সরাসরি কোনো কাজে নিয়োজিত নন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তরুণ এবং যাঁদের বড় অংশ এবার নিজেদের অধিকার আদায়ে নেমেছিল পথে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন মাঝবয়সীদের তেমন পথে নামতে দেখা যায় না, যাঁরা নিজের শিক্ষাজীবনে হয়তো আন্দোলন–সংগ্রামে সব সময় সামনের সারিতে থেকেছেন, তাঁরাও কেন একটা বয়সের পর মিছিলে হাঁটতে ভয় পান?
বিষয়টি জানতেই কথা বলেছিলাম জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক অধ্যাপক মেখলা সরকারের সঙ্গে।
তিনি বললেন, ‘আমরা সাধারণত তরুণ হিসেবে ধরি পোস্ট অ্যাডোলোসেন্স পিরিয়ড, অর্থাৎ ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের। এই বয়সীরা যে কাজটি করেন, সেটিকেই সঠিক বলে মনে করেন। এই বয়সটাই প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ফলে কাজটি নিরাপদ কি না, ফলাফল কী হবে, কাজটি করলে ভবিষ্যতে কী হবে, নিজের কোনো ক্ষতি হবে কি না; এত সব ভাবনা তাঁদের মাথায় থাকে না।’
তাঁরা যদি মনে করেন পদক্ষেপটি সঠিক, তো সেটাই ঠিক বলে ধরে নেন।
অন্যদিকে যাঁরা তুলনামূলক বয়সী, অর্থাৎ ৪০–এর আশপাশে বয়স; তাঁরা কিন্তু এরই মধ্যে সংসারে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের নিজস্ব কিছু দায়িত্ব আছে, কিছু সীমারেখা আছে। এই বয়সে এসে সেসব সীমানা ভেঙে, দায়িত্ববোধকে পেছনে ফেলে সব সময় ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হয় না।
চল্লিশের পর সাধারণ মানুষ পেশা বা ব্যক্তিজীবনে স্থির হতে চান। দীর্ঘ সময় ধরে নিজেকে তৈরি করেছেন। নিজের সেই সামাজিক পরিচয়, পেশাগত অবস্থান বা সামাজিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন কোনো কাজ তিনি করতে চান না—এমনটাই মনে করেন মেখলা সরকার।
এই বয়সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রধান ভাবনা হয়ে দাঁড়ায় জানিয়ে এই মনোরোগ চিকিৎসক বলেন, উল্টো দিকে তরুণেরা নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। চল্লিাশোর্ধ্বরা যখন ভাবেন মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছেন, তরুণেরা তখন পায়ে পায়ে মৃত্যুকে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যান। এটাই তারুণ্যের শক্তি।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে ডা. মেখলা বলেন, এই আন্দোলনেরও পরিণতি টেনেছেন তরুণেরা। হয়তো অন্য বয়সী মানুষেরাও ছিলেন। তবে বয়সের স্বভাবের কারণেই হয়তো তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন দৃশ্যপটের বাইরে। হয়তো তাঁরা বুদ্ধি দিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, প্রেরণাও দিয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যপটে কিন্তু ছিলেন তরুণেরা। মিছিলে-বিক্ষোভে তাঁদেরকেই আমরা সামনে দেখেছি।
একেই তারুণ্যের ধর্ম বলে অভিহিত করলেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তরুণদের মৃত্যুর ভয় থাকে না, ভবিষ্যৎ নিয়ে এত ভাবনা থাকে না; তাঁরা বর্তমানে বাঁচে, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে না, তাই দাবি আদায়ে পথে নামতেও তাঁরা কোনো পিছুটান বোধ করেন না।’
তারুণ্যের এই আগুনে স্বভাবের কথা ভেবেই উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
২০২৪–এর সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় এসেও যা সমান প্রাসঙ্গিক।