‘মব জাস্টিস’, অর্থাৎ এক দল লোকের জোর করে নিজের হাতে বিচার তুলে নেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে চরম উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কও তথাকথিত ‘মব জাস্টিসের’ বিরুদ্ধে তাদের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু এসবে কোনো কাজ হচ্ছে না।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বড় আকারে ‘মব জাস্টিস’ শুরু হয়। তবে বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে সেটা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা।
কিন্তু এবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারপিট করে তাড়িয়ে দেওয়া, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা, কোথাও কোথাও পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু কোনো ঘটনায়ই জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা বা আইনের আওতায় আনার মতো খবর এখনো পাওয়া যায়নি। প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের হুঁশিয়ারি এবং ‘মব জাস্টিস’ দুই-ই চলছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও বিভিন্ন জেলা সফর করতে গিয়ে কোথাও কোথাও তারা প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। সর্বশেষ বগুড়ায় তারা সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশ ও সেনা পাহারায় সমাবেশ না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরকম ঘটনা আরও কয়েকটি জেলা থেকে এসেছে।
ইউটিউবার হিরো আলম ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনের সময় হামলার শিকার হয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন। আরাফাতের দল আওয়ামী লীগের সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু হিরো আলমের ওপর হামলা থামেনি।
গত ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আদালত চত্বরে হামলার শিকার হয়েছেন আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে কয়েকজন যুবক এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন হিরো আলম। হামলার প্রতিক্রিয়ায় হিরো আলম বলেন, ‘এক স্বৈরাচারের পতনের পর আরেক দল নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে।’
একই দিনে রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, পঙ্গু আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে৷ আট বছর আগে আরেক হামলায় তিনি একটি পা হারান। তারপর থেকে তিনি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাফেরা করতেন। সেদিন তিনি ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট। এরপর শুরু হয় মামলা। এইসব মামলায় বাছবিচার না করে গণহারে আসামি করা হচ্ছে। আর পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা আটক হতে শুরু করার পর আদালত এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। তাদের পিটিয়ে রক্তাক্তও করা হয়। এই হামলা থেকে নারীরাও রেহাই পাননি।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটছে তা আমার অ্যালার্মিং মনে হচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করিনি। পিটিয়ে মারা, পাগল বলে পিটিয়ে মারা- এগুলোতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই ধরনের নারকীয় হত্যা, হামলা এখনো চলছে। এগুলো তো আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সাপ মারার মতো মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তো আইনের শাসন বলে কিছু থাকে না।’
‘আপনি কোন আইনে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন? তাদের পদত্যাগে বাধ্য করছেন। বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে পদত্যাগ করাচ্ছেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এগুলো যারা করছে, তারা কীভাবে করছে। যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?’
তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে সাত রাস্তার মোড় বন্ধ করে ছাত্ররা আন্দোলন করলো। তারা রাস্তা দখল করলো। আমাদের গাড়িগুলো আটকে গেল। ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করছে না, যে যার মতো চলছে।’
বাংলাদেশে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানও ক্লাস শুরু হয়নি। ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ শিক্ষকদের ওপর হামলাও হয়েছে। হামলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর।
বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলা ও আগুনের ঘটনা পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার নামের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি রীতিমতো ‘উৎসব করে’ ধ্বংস করা হয়েছে।
এখন চলছে মাজার ভাঙার মতো নাশকতা। নারায়াণঞ্জের দেওয়ানবাগীর মাজারসহ আরও কয়েকটি মাজার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারে চলছে আতঙ্ক। সেটাও ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে হতাশা ও বিচারহীনতার কারণে এই ‘মব জাস্টিস’ চলছে। কিন্তু এখানে আমি দায়িত্বহীনতাও দেখতে পাই। এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও এই বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই যে ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে। কোথাও কোথাও তাদের সংশ্লিষ্টতায়, আবার কোথাও কোথাও অতি উৎসাহী জনতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির কারণে এত বড় একটা অর্জন নষ্ট না হয়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন ভয়াবহ অবস্থা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নিয়ন্ত্রনহীন। কোনো শিক্ষক, পুলিশ বা কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু এখন তো বেআইনি কাজ হচ্ছে।’
তার কথা, ‘এই যে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হলো, এটা একটা গণঅভ্যুত্থান। এটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিপ্লব মনে করি না। আমাদের কালচারাল বিপ্লব প্রয়োজন। আমরা যদি ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব দেখি তাহলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার যদি দ্রুত এইসব মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশের থানাগুলোতে হামলা ও অস্ত্র লুটের ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। লুটের অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। আতঙ্কে অনেক পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান ও সাবেক ডিআইজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, ‘এখন আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে ভয়ঙ্কর প্রবণতা চলছে, তা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সরকারের উচিত হবে এই সব মব জাস্টিসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি সরকারের পতন হয়েছে। এখন কিছু লোক মনে করছেন, তারা যা খুশি তা-ই করতে পারবেন। আবার কোনো একটি গ্রুপ হয়তো পরিস্থিতি খারাপ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইবে। কেউ কেউ আবার সুযোগ নিচ্ছেন। ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলার পর পুলিশও এখন আর তেমন সক্রিয় না। সরকারের উচিত হবে সেনাবাহিনীকে আরও অ্যাকটিভ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা।’
জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। যারা জেলা প্রশাসক হতে চান, কিন্তু পারেননি, তারা প্রতিদিনই সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন। এর আগে ছাত্ররা সচিবালয়ে ঢুকে উপদেষ্টাদের ঘেরাও করে এইএইচসি পরীক্ষার অবশিষ্ট ছয় বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল করিয়ে নিয়েছে। তাদের দেখে আনসার সদস্যরাও সচিবালয়ে ঢুকে দাবি আদায়ের জন্য জিম্মি অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। তাদের অবশ্য দমন করা হয়েছে ছাত্রদের সহায়তায়।
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘বাংলাদেশে ৯৯% লোকের সামাজিকীকরণ ঠিকমতো হয়নি। ফলে সব পেশাতেই অসামঞ্জস্য আছে, বৈষম্য আছে। ফলে আগামী চার-পাঁচ মাসে বিভিন্ন সেক্টরে আরও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা আছে। কারণ, এখন যে পারছে, সে-ই নিজের মতো করে ব্যবস্থা নিতে চাইছে।’
তার কথা, ‘এদের এখনই থামিয়ে দিতে হবে। নয়তো বর্বরতা আরও বাড়বে।’