ইরানের মাটিতে ইসরায়েলের যত ‘গোপন অভিযান’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩:২৩

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ডের পরপরই অভিযোগের তীর উঠেছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ইরান সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলকে ‘কঠিন শাস্তি’ দেওয়ার হুমকিও দেয়।

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো বক্তব্য না এলেও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, তার দেশ সাম্প্রতিক সময়ে ‘শত্রুদের’ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার মতো আঘাত হেনেছে।
সেসময় বিবিসি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন বলেছিলেন, হানিয়াকে ইসরায়েলই হত্যা করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

অবশ্য এটাই প্রথমবার নয়। এর আগে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে, ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কোন পর্যায়ের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। গত কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই আন্দাজ পাওয়া যায়, ইরানে অতি উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিদেরও তারা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট অভিযান চালানোর জন্য।
ইসরায়েলের সেসব অভিযানের মধ্যে যেমন রয়েছে খুন, তেমনি রয়েছে সাইবার আক্রমণ এবং ড্রোন দিয়ে হামলা।
দেখে নেওয়া যাক গত দেড় দশকে ইরানের মাটিতে মোসাদ কী কী ঘটনা ঘটিয়েছে-

হত্যা
গত প্রায় দেড় দশকে ইরানের একাধিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা খুন হয়েছেন, যেগুলোর পেছনে ইসরায়েল তথা মোসাদের হাত ছিল বলে দাবি করে তেহরান।

• জানুয়ারি ২০১০ :

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদ-আলি-মোহাম্মদী তার মোটরসাইকেলে রাখা রিমোট পরিচালিত বোমার আঘাতে নিহত হন। বাড়ির কাছেই ওই ঘটনা ঘটেছিল।

এক বছর পরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইরান ঘোষণা করেছে, অধ্যাপক মোহাম্মদীকে হত্যার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে তারা ১০ জন ইরানি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে।

ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ তখন দাবি করেছিল, ধৃতরা ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন বলে স্বীকার করেছেন।

• নভেম্বর ২০১০ :

তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাজিদ শাহরিয়ারি কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একটি গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত হন। আহত হন তার স্ত্রীও। তৎকালীন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ওই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করেছিলেন।

• নভেম্বর ২০২০ :

তেহরানের বাইরে গাড়িতে যাওয়ার সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পরমাণু বিজ্ঞানী মেহসেন ফাখরিজাদেহ। পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করতেন, ফাখরিজাদেহ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জনক।

জাতিসংঘ ২০০৭ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে তার ওপরে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল।

২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছিল, ইরানের ধারণা, শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজাদেহকে গুলি করে হত্যা করতে ইসরায়েল ও নির্বাসিত বিরোধী গোষ্ঠী রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
ঘটনার বছর দুয়েক পরে এক বিশ্লেষণে বিবিসি পারসি সার্ভিসের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছিল, ফাখরিজাদেহকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি তথ্য না পেলে ওইভাবে একটি চলমান লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায় না!

• মে ২০২২ :

ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসির কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইকে তেহরানে তার বাড়ির বাইরে পাঁচবার গুলি করে খুন করা হয়। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য মাজিদ মিরাহমাদি ওই হত্যাকাণ্ডকে ‘নিশ্চিতভাবেই ইসরায়েলের কাজ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে ‘বৈশ্বিক ঔদ্ধত্য’কে দায়ী করেছিলেন।

সাইবার হামলা
• জুন ২০১০ :

ইরানের বুশেহর শহরের পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে স্টাক্সনেট ভাইরাস পাওয়া যায় এবং তা সেখান থেকে অন্যান্য প্রকল্পে ছড়িয়ে পড়ে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইরানের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের ব্যক্তিগত কম্পিউটারগুলো একটি জটিল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা ইরনা।

তবে বুশেহর প্ল্যান্টের অপারেটিং সিস্টেমের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানান সেখানকার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহমুদ জাফারি।

স্টাক্সনেট ভাইরাস একটি শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভাইরাসটি এতই জটিল যে এটি কেবল কোনো ‘জাতিরাষ্ট্র’-ই বানাতে পারে।

সে বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ১৪টি প্রকল্পের প্রায় ৩০ হাজার কম্পিউটার ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল।

• মে ২০১২ :

ইরান ঘোষণা করে, ফ্লেম নামে একটি ভাইরাস ব্যবহার করে সরকারি কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরির চেষ্টা চালানো হয়েছে।

বিবিসির ওয়েবসাইটে ২০১২ সালের একটি প্রতিবেদনে এই ফ্লেম ভাইরাসটি নিয়ে লেখা হয়েছিল। সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা ক্যাস্পারস্কি ল্যাবসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, ফ্লেম ভাইরাসটি ‘এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব থেকে জটিল’ ভাইরাস।

ক্যাস্পারস্কি এটাও বলেছিল, তারা মনে করে এই ভাইরাস আক্রমণ কোনো রাষ্ট্রই চালিয়েছে। তবে ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল নিয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।

• অক্টোবর ২০২১ :

ইরানের নাগরিকরা ভর্তুকি হারে জ্বালানি কেনার জন্য যে সরকারি কার্ড ব্যবহার করেন, তার ব্যবস্থাপনাতেই সাইবার হানা হয়। দেশের ৪,৩০০টি পেট্রোল স্টেশনই এর ফলে প্রভাবিত হয়।

গ্রাহকদের হয় নিয়মিত দামে জ্বালানি কিনতে হয়েছিল – যা ভর্তুকি-যুক্ত দামের দ্বিগুণেরও বেশি, অথবা কেন্দ্রীয় বিতরণ ব্যবস্থাপনায় স্টেশনগুলি যতক্ষণ না আবারও সংযোগ করতে পারে, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

এই ঘটনার জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছিল ইরান।

• মে ২০২০ :

ইরানের দক্ষিণ উপকূলে শহীদ রাজাই বন্দরে সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার ব্যবস্থাপনায় সাইবার হামলা হয়। এর ফলে বন্দরে আসার জন্য জাহাজগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

ওয়াশিংটন পোস্ট এই খবর দিয়ে জানিয়েছিল যে, ওই হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। তবে ইসরায়েল দায় স্বীকার করেনি।

ড্রোন হামলা ও গুপ্ত অভিযান
• জানুয়ারি ২০১৮ :

মোসাদ এজেন্টরা তেহরানের একটি সুরক্ষিত স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি করে বলে ইরান অভিযোগ করে।

আল-জাজিরার একটি খবরে বলা হয়, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঘোষণা করেন, ইসরায়েল এমন এক লক্ষ ‘গোপন ফাইল’ হাতে পেয়েছে, যা দিয়ে প্রমাণ হয় ইরান পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালায় না বলে যেটা বলে থাকে, তা অসত্য।

• ফেব্রুয়ারি ২০২২ :

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি উপ-সম্পাদকীয়তে স্বীকার করেছিলেন, তার আগের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরায়েল একটি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের একজন সিনিয়র কমান্ডারকে হত্যা করেছে।

• মে ২০২২ :

বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন আঘাত হানে তেহরানের দক্ষিণ-পূর্বে পারচিন সামরিক কমপ্লেক্সে। ওই ঘটনায় একজন প্রকৌশলী নিহত হন।

ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনী যে ভবনে তাদের নিজেদের ড্রোন তৈরি করতো, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

• এপ্রিল ২০২৪ :

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাস ভবনে ইসরায়েলি হামলায় সাতজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।

নিহতদের মধ্যে কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদী ও তার ডেপুটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রাহিমিও ছিলেন।
এর জবাবে ইরান শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইসরায়েলে।
দুই শত্রু দেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে চলা ছায়া যুদ্ধের পর এটিই প্রথম ইরান সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালায়।