রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপিকে খুনের ঘটনা এখনো পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। তাকে খুন করা হয়েছিল বিষয়টি নিশ্চিত হলেও খুনের কারণ কিংবা হত্যাকারীর বিষয়ে কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
মামলাটির তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই বলছে, মামলাটির তদন্তকাজ চলছে। কিছু দিনের মধ্যেই এই নারী চিকিৎসকের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হবে। ২০২১ সালের ৩১ মে রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেইনের একটি বাড়ির চার তলার ফ্ল্যাট থেকে ডা. সাবিরার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহ উদ্ধারের সময় সাবিরার শরীরে ধারাল জখম এবং পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন পাওয়ার কথা পুলিশ জানিয়েছিল।
৪১ বছর বয়সী এই চিকিৎসক গ্রীন লাইফ হাসপাতালে সনোলজিস্ট ছিলেন। তিনি ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দুই তরুণীকে ‘সাবলেট’ দিয়েছিলেন। তাদের একজন প্রথম সাবিরার লাশ দেখেন। অন্যজন সেসময় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে প্রথম স্বামী ডা. উবায়দুল্লা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ২০০৫ সালে সামছুদ্দিন আজাদ নামে এক ব্যাংকারের সঙ্গে দ্বিতীয় ঘর বাঁধেন ডা. সাবিরা। দুই সংসারে সাবিরার দুই সন্তান রয়েছে। তারা তাদের নানীর বাসায় থাকে। তবে বর্তমান স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় সাবিরা আলাদা থাকতেন।
কলাবাগানের যে বাড়িতে সাবিরা ভাড়া থাকতেন সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা টাইমস। তাদের ভাষ্য, বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বাড়িটির সব বাসিন্দাকেই রাত ১১টার মধ্যে বাসায় ফিরতে হয়। তবে হত্যার দিন রাতে ওই বাসার নিরাপত্তায় থাকা দারোয়ান ব্যক্তিগত কাজে বাহিরে যান। বাসায় ফেরেন রাত সাড়ে ১২টায়। পরে সকালে আবার বাজার করতে যান ওই দারোযান।
জানা গেছে, ওই চিকিসৎকের সঙ্গে সাবলেটে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এক তরুণীও সাবিরা খুনের সপ্তাহখানেক আগ থেকে সকালে হাঁটতে বের হতেন। তিনি সেদিনও সকাল ৬টায় বেরিয়ে যান আর ফিরে আসেন ৯টায়। তিনিই প্রথম আগুন লাগার কথা জানান।
ওই বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার ভাষ্য, রাতে আগুন লাগলে আশপাশের ভাড়াটিয়াসহ বাসার লোকজনের জানার কথা। কিন্তু তারা কিছুই টের পাননি। এছাড়া রাতে আগুন লাগালে সকাল ৯টা পর্যন্ত তা জলন্ত থাকার কথাও না।
তবে এ বিষয়ে বাসার দারোয়ানসহ ভাড়াটিয়ারা বলছে, তারা এসে আগুনের ধোয়া দেখে নিজেরা পানি ঢেলেছে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও থানা পুলিশকে খবর দিয়ে আনা হয়েছিল।
পুলিশ ও ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক উভয়ের পক্ষ থেকে সেসময় বলা হয়েছিল, চিকিৎসক সাবিরাকে হত্যা করা হয়েছে মধ্য রাতে। তাহলে একই ফ্লাটে সাবলেটে থাকা ওই তরুণী কেন জানতে পারলেন না সেই প্রশ্ন ছিল সবার।
সাবিরা হত্যায় তার মামাত ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল বাদী হয়ে মামলা করেন। তিনিও সেসময় সাবলেটের ওই তরুণীর দিকে সন্দেহ করেছিলেন। যদিও তিনি মামলা করেন অজ্ঞাতনামা আসামি দেখিয়ে। রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই খুনের সঙ্গে একই ফ্লাটে থাকা তরুণী বা অন্য কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে আমাদের সন্দেহ। পিবিআই বলেছে তদন্তের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রকৃত হত্যাকারিকে চিহ্নিত করতে পারবে তারা। আশা করছি সাবিরা হত্যার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করবে তারা।’
সরেজমিন কলাবাগানের ৫০/১ নম্বর ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িটি এখন ১২টি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সদর দরজা বাদে বাসার দেওয়াল ঘেষে ওঠা বাড়িগুলোর পাশ থেকেও ওই বাসায় প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই।
দারোয়ান রমজান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ১২ মার্চ পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এসে নিহত ডা. সাবিরার ফুফাত ভাই মজুমদার জুয়েল ও ছেলে আহম্মেদ তাজোয়ার বাসা থেকে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে। এর আগে পুলিশের সঙ্গে এসে সাবলেটের এক তরুণী তার জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।
রমজান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ডা. সাবিরা বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় স্বামী কানাডা প্রবাসী বলে জানিয়েছিলেন। আর সাবলেটে থাকা সুবর্ণ নামের এক তরুণীকে আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দেন। তবে হঠাৎ একদিন ব্যক্তি বাসায় যেতে চাইলে আমি তার পরিচয় জানতে চাই। পরে আমার সঙ্গে সাবিরা ম্যামের ফোনে কথা বলে দেওয়ায় আমি বাসার মধ্যে আসতে দেয়। পরে আরেক দিন ওই লোকটা আসলে আমি ডা. সাবিরার কাছে পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, তোমার চাচা।’
নিরাপত্তা প্রহরী রমজান জানান, চিকিৎসক সাবিরা তেমন কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। তিনি নিজেই বাজার সদাই করতেন। অধিকাংশ সময় অর্ডার দিয়ে খাবার আনতেন। এছাড়া খুব বেশি সময় বাসায়ও থাকতেন না। সাবিরা হত্যার পরে ওই বাসায় যায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও র্যা ব। ওই সময় আলামত সংগ্রহ করেন সংস্থাগুলো। এর মধ্যে সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ (ফিল্টার) ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে আশায় ছিলেন তারা। এখন ফিঙ্গার প্রিন্টই এই হত্যাকাণ্ডের শেষ ভরসা, বলছে তদন্তকারী সংস্থা। হত্যাকাণ্ডের এগারো মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। আগামী ৮ জুলাই ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত।
এবিষয়ে পিবিআই ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলার অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে। এটা নিয়ে কাজ চলছে। আশা করা যায় কিছু দিনের মধ্যে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনা করা সম্ভব হবে।’