ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। এটি বাঙালির কাছে শুধু একটি নম্বর নয়, একটি ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবয়ব। ৩২ নম্বর বললেই চোখের সামনে সবার আগে ভেসে ওঠে একটি মুখ, একটি বাড়ি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পাইপ হাতে দাঁড়ানো একটি সাদা বাড়ি। জাতির পিতার রক্তে রঞ্জিত সেই সিঁড়ি।
আসলে ৩২ নম্বর কোনো বাড়ি নয়। ধানমন্ডির একটি সড়ক। এই সড়কেই সেই বিখ্যাত বাড়িটি। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছিষষ্টির ছয়-দফা, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, একাত্তরের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ জাতির সব গুরুত্বপূর্ণ মোড় গোড়ানোর সূতিগাকার এই বাড়ি। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাতই মার্চের ভাষণের রূপরেখাও তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে। ৭১-এর উত্তাল দিনগুলোয় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ভিড় করেন এখানে।
এই বাড়ি বাঙালি জাতির ইতিহাসের অংশ। এই জাতির অভ্যুদয়ের ইতিহাস এই বাড়িকে ঘিরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের ইতিহাস রচিত হয়েছে এখানে।
১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৭১ সালের উত্তাল মার্চে ৩২ নম্বর বাড়িটিই হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক। গণমানুষের ভরসা ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আর শত্রæদের চক্ষুশূল। তখন বাঙালার সব পথ গিয়ে মিলত ৩২ নম্বরে।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রতিদিনই হাজার হাজার লোক মিছিল করে যেত। ‘বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সঙ্গে’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু‘। এই ছিল প্রধান প্রধান স্লোগান।
এই বাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিতেন, সে অনুসারে চলত দেশ। বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পরিণত হয়েছিল অঘোষিত সরকারি দপ্তরে। তখন মানুষের একটাই ঠিকানা ছিল, একটাই নিশানা ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ৩২ নম্বর।
এই বাড়ির যেমন রয়েছে সৃষ্টির ইতিহাস, একটি জাতির অর্জনের ইতিহাস, তেমনি এই বাড়ি ঘিরেই রয়েছে বাঙালির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটে সপরিবারে নিহত হন বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ স্বমহিমায় বাঙালি জাতি আছে, বাংলাদেশ আছে। আছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি। শুধু নেই তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বাংলাদেশকে জানতে হলে ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়িটি এখন জাদুঘর। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন বাড়িটি দেখতে। বাড়ির নিচতলা, সিঁড়িঘর, দোতলা এবং তৃতীয় তলায় উঠে ঘরগুলো ঘুরেফিরে দেখেন আর হয়ে পড়েন আবেগাপ্লুত। আফসোস করতে থাকেন। বুকের ভেতর থেকে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস বের হতে থাকে।
জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বাড়িটিতে ঢুকতে হলে টিকিট কাউন্টারে পাঁচ টাকার বিনিময়ে টিকিট কাটতে হবে। সেই সঙ্গে জমা দিতে হবে কাছে থাকা ব্যাগ, মোবাইল ফোনসহ যাবতীয় ধাতব যন্ত্র। একটি টোকেন নিয়ে দেহতল্লাশি গেইট দিয়ে প্রবেশ করেই দাঁড়াতে হবে আপনার ছবি স্ক্যানের জন্য। ছবি তোলার কাজটি হয়ে গেলেই বাড়ির সবুজ চত্বরে পা রাখা যাবে।
শান্ত মনোরম পরিবেশের বাড়িটিতে ঢুকেই একটি অনুভূতি নিজের ভেতরে কাজ করে। এই চত্বরের বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল দৌড়াদৌড়ি করতেন। এখানেই পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পায়চারি করতেন। নেতাকর্মীরা এখানেই এসে ভিড় করতেন। অনুমতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেন। বড় বড় আমগাছ, কাঁঠালগাছ, নারিকেল গাছসহ নানা ফল-ফুলের গাছে আচ্ছাদিত হয়ে আছে সাদা বাড়িটি। চারদিকে পাখির কলরব এক মায়াময় আবহ তৈরি করে রেখেছে।
হাতের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকেই নিচতলাতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ও অভ্যর্থনা কক্ষ। এখানেই একটি শোকেসে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের জন্মদিনে পাওয়া নানা উপহার সামগ্রী। আবাহনী ক্লাবের উপহার কার্ড ও পটুয়াখালী যুব সংসদের রুপার তৈরি শাপলার রেপ্লিকা। আছে রুপার মানচিত্র, রুপার ছোরা, মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের কোরআন শরিফ।
দ্বিতীয় তলায় ঢুকতেই শেখ রাসেলের অ্যাকোরিয়াম। আছে বিভিন্ন সময়ের উপহারসামগ্রী। শোকেসে থরে থরে সাজানো পানপাত্র, চায়ের সেট, ধাতব নৌকা, বাসন-কোসন ও তৈজসপত্র।
দেয়ালে, দরজায়, ঘরের মেঝেতে ঘাতকের গুলির আঘাতে ছিদ্রগুলো লাল চিহ্ন দেওয়া। একটি দেয়ালে সাদাকালো লম্বা ফ্রেমে বঙ্গবন্ধু কবুতর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এমন একটি ফটোফ্রেম। রুমের একপাশে থালা, গ্লাস, জগ, চামচ, বাটি, গামলাসহ নানা উপকরণ দিয়ে সাজানো একটি খাবার টেবিল। মনে হবে এখনই এখানে এসে খেতে বসবেন বঙ্গবন্ধু, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পাশেই আচারের বয়াম। পানির বোতল। দেয়ালে হেলান দেওয়া দুটি সাইকেল।
বসার কক্ষে কাঠের ফ্রেমের একটি সাদাকালো টেলিভিশন। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে মোড়া, খাট, খাটের ওপর জায়নামাজ, কোলবালিশ, হাতপাখা। পাশে স্ট্যান্ডফ্যান, গোলটেবিল ও পরপর সাজানো কমলা, সাদা ও হলুদ রঙের টেলিফোন সেট। পাশেই আলমারির ওপর রেহেলে কোরআন শরিফ। টেবিলে চশমা, পাইপদানি, তামাকের কৌটা, কলম, কলমদানি, পেপার ওয়েট। আলনায় ঝোলানো রক্তমাখা পাঞ্জাবি, চাদর, জুতা, স্যান্ডেল, শাড়ি, লুঙ্গি প্রভৃতি। একপাশে একটি রকেট মোহাম্মদীয় পঞ্জিকা।
তার পাশেই শেখ রেহানার কক্ষ। সেই কাঠের দরজাতেও গুলির চিহ্ন। সেদিন তিনি দেশে ছিলেন না। পাশের ঘরে শেখ কামালের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি, বিয়ের মেরুন রঙের বেনারসি ও ওড়না। শেখ কামালের কক্ষ। স্নানের ঘর। দেয়ালে, ঘরের ছাদে গুলির চিহ্ন। দেয়ালে ঝুলানো সেই সময়ের ক্যালেন্ডারের জুলাই-আগস্টের পাতাটি দেখা যায়। পাশেই কাচে আবৃত দোতলার সিঁড়ি, যেখানে রক্তের ছোপ স্পষ্ট হয়ে আছে। এটি দেখে কারও পক্ষে আবেগ সংবরণ করা কঠিন। কী নির্মম আর পৈশাচিক ছিল সেই রাত, ১৫ আগস্ট।
নিচে রান্নাঘরে বড় বড় রান্নার পাতিল, কড়াই, হাতা-খুন্তি, বসার পিঁড়ি, বঁটি, মাটির তৈরি পানির কলস, বড় বড় বয়াম, চুলা প্রভৃতি। পাশেই তিন স্তরের কাঠের তৈরি কবুতর ঘর। সেখানে সাদা কবুতর ওড়াউড়ি করছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িটির পাশেই নির্মিত হয়েছে আর একটি নতুন জাদুঘর। তার প্রতিটি ফ্লোরে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, স্মৃতিচিহ্ন