প্রধান উপদেষ্টা

আমাদের মুখ থেকে যেদিন শুনবেন, তখনই নির্বাচন হবে

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:৩৫

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বা আগামী নির্বাচন কবে হবে, এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হলেও উপদেষ্টা পরিষদ এ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা আলোচনা করেছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেইনি। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, তখন সেটাই হবে তারিখ।

শুক্রবার, (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে ভাষণ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে দেশে আগামী আঠারো মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আশা প্রকাশ বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এজন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে সরকারকে তার দৃঢ় সমর্থন দেওয়ার কথাও জানান। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

সেনা প্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে- এ কথা থেকে কি ধরে নেওয়া যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ১৮ মাস- এমন প্রশ্ন করা হলে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সেটা আপনি ইচ্ছা করলে ধরতে পারেন। কিন্তু, সরকারের মতামত তো না সেটা। সরকার তো কোনো মত দেয়নি এ পর্যন্ত। কাজেই সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে, সেটা সরকারকে বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত সেটা তো সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না।
বিষয়টি পরিষ্কার করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আরও বলেন, আমাদেরই বলতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, তখন সেটাই হবে তারিখ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো শেষ করে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা আমার সরকারের মূল লক্ষ্য।

ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের মুখে এ বছরের ৫ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সরকার পতনের পর ৮ অগাস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেই থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি দৃশ্যমান টানাপড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে ইউনূস জানান, এটি একটি আইনগত বিষয় ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দুই দেশেরই স্বার্থ হলো, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝেমধ্যে কতগুলো প্রশ্ন এসে যা,য় যেখানে সম্পর্কে একটু চির ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করলো, বাচ্চা মেয়ে মারা গেলো, বাচ্চা ছেলে মারা গেলো, এগুলো মনে কষ্ট দেয়।
‘তবে আমরা মনে করি না যে ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে। যে সমস্ত কারণে এসব ঘটে, সেসব কারণগুলো যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে- সেজন্য কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল শিক্ষার্থীসমাজ। অন্তর্বর্তী সরকারেও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি রয়েছে। তবে সরকারের বাইরে যারা আছেন, এমন অনেক ছাত্রকে দেশের নানা ক্ষেত্রে, নানা প্রতিষ্ঠানে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরাই কি দেশ চালাচ্ছে কি না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, চালানো উচিত বলছি। চালাচ্ছে বলছি না। চালানো উচিত। তরুণদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমি বরাবরই বলে এসেছি। এখানে এই দায়িত্ব পালন করার আগে থেকেই বলছি যে তরুণরাই তাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে।
বাংলাদেশে জুলাই মাসের ১ তারিখে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দুই সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপক গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। জাতিসংঘের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রাথমিক রিপোর্টে আরও বলা হয়, ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে ১১ অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে ২৫০ জনের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছে।
১ লাখ ৯০ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনী এখনো বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে ও তার প্রভাব দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে দুই মাসের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয় ইউনূসের নেতৃত্বধীন অন্তবর্তী সরকার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা পেয়েছেন।
দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দেড় মাস পরে, তিন বাহিনীর কমিশনড কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন কেন- এই প্রশ্নের জবাবে ইউনুস জানান, গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থী-জনতাকে হত্যা করাসহ গণবিরোধী ভূমিকায় জনগণের মধ্যে পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়। সে কারণে অভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবলও ভেঙে যায়। তাই পুলিশকে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা যাচ্ছিলো না। এ কাজে আনসার নিয়োগ করেও ফল আসেনি। তাই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
ইউনূস বলেন, নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সমাবেশ হচ্ছে। তাতে, বিশেষ করে আমাদের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা গেলো। সেগুলো নিয়ে মনে করলাম যে, এভাবে চলতে দিলে তো বাড়তে আরম্ভ করবে, তখন সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলো।
সেনাবাহিনীও বলে, আমরা তো আছিই কিন্তু আমাদেরকে তো কেউ পরোয়া করছে না। কারণ আমাদের তো কোনো ক্ষমতা নেই। আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে, বিশৃঙ্খলাকারীরা হয়তো নিয়ন্ত্রণে আসবে। তখন আমরা সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিলাম।
সেনাবহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২০ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, আমাদের মতে তখনই এ ক্ষমতা দেওয়া দরকার, যখন মনে হবে সংবিধান নিয়মের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু এ সংবিধান এখনো ভালো আছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতা কর্মীরাই সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেখানে সেনাবহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া মানে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো, বিশেষ করে পুলিশ হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত ও বিচার করা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে যেখানে যে অপরাধ করেছে, তার বিচার হবে। তা না হলে তো বিচার সম্পন্ন হবে না।
এ সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সার্ক পুনরায় কার্যকরভাবে চালু করার ব্যাপারে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটানের সঙ্গে জাতিসংঘ অধিবেশনের ব্যস্ততার ফাঁকে আলোচনা করা, সংবিধান সংস্কারসহ নানাক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে তার সরকারের উদ্যোগ ও অগ্রগতি, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বাঙালিদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও সহিংসতা, রোহিঙ্গা সংকট ইত্যাদি বিষয়েও কথা বলেন।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালির সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত চারজন আদিবাসী মারা গেছেন। তাছাড়া আহত হয়েছে অর্ধশতাধিকের বেশি মানুষ। এই সংঘর্ষের জেরে বহু ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বৌদ্ধ মন্দিরে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
পার্বত্য জেলাগুলোতে (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি) দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সর্বব্যাপী উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে সামরিক প্রশাসন জেলাগুলোর বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির কারণ হিসেবে বলা হয় তা ওই এলাকায় বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রিডম হাউস পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, এইতো আসলাম মাত্র। এত বছরের একটা সমস্যা, আপনি দুদিনে আমাদের দিয়ে সমাধান করে দিবেন? আমরা একটা সমাধান নিয়ে আসব, এটা আশা করা তো ঠিক হবে না। একটা শান্তি চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি বহু বছরের চেষ্টায় হয়েছে। সেটি এখনো বহাল করা যাচ্ছে না। মান্য করছে না। এখন কি সে শান্তি চুক্তি আবার নতুন করে করতে হবে? সেটা আমাদের সরকার পেরে উঠবে না। এটা পরবর্তীতে নির্বাচিত যে সরকার আসবে, তারা করবে।
নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে সে ব্যাপারে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা যদি আসতে চায়, আমরা তাদের আসতে দেবো। আমরা তাদের গ্রহণ করবো।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের অস্থিরতার কারণে আবার কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অনুমান করা হচ্ছে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২৫ সেপ্টেম্বর জানায়, বাংলাদেশ সীমান্তে এখনও অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে। তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানায় সংস্থাটি।
এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, নীতিগতভাবে আমরা কোনো রোহিঙ্গাকে নতুন করে আশ্রয় দেব না। যদিও কথাটা বলতে দুঃখ লাগে, কিন্তু আমাদের জন্য সাধ্যের অতীত, আর পারবো না তাদের আশ্রয় দিতে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক মাসপূর্তি উপলক্ষে ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন জনপ্রশাসন ও সংবিধান।