বিবিসির বিশ্লেষণ

মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত কীভাবে শেষ হবে

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২০

এক বছর আগে ছবিগুলো ছিল চরম নির্মম। ইসরায়েল তখনো তার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাটির ধাক্কায় হিমশিম খাচ্ছিল। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, সময়টা মোড় ঘোরানোর।
যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত অনেক বছর পর্দায় অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল, সেটা যেন তখন বিস্ফোরণের মতো ফিরে এসেছিল।
ব্যাপারটি প্রায় সবাইকেই অবাক করে দিয়েছিল। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলটি দুই দশকের তুলনায় আজ শান্ত।’ তাঁর এই উক্তিটি স্মরণীয় হয়ে আছে।
সুলিভানের এমন ঘোষণার পর এক বছর ধরে এই অঞ্চলে আগুন জ্বলছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। উপত্যকার ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন আরও ৬০০ ফিলিস্তিনি।
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত ১০ লাখ মানুষ।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের চালানো হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন। এরপর গাজায় যুদ্ধে গিয়ে ইসরায়েলের ৩৫০ জনের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন।
গাজার কাছাকাছি ও লেবাননের অস্থিতিশীল উত্তর সীমান্ত বরাবর এলাকার দুই লাখ ইসরায়েলি বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরায়েলের প্রায় ৫০ সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অবনতি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র নানা চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এসব চেষ্টার মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্টের সফর, অসংখ্য কূটনৈতিক মিশন, বিপুল সেনা-সরঞ্জাম মোতায়েন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি। দূরের ইরাক ও ইয়েমেন থেকেও রকেট ছোড়া হয়েছে।
আর চিরশত্রু ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যেও পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমনটা আরও ঘটবে, তা প্রায় নিশ্চিত।
মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন কদাচিৎ প্রভাবহীন বলে মনে হচ্ছে।
সংঘাত যখন ছড়িয়ে পড়েছে, এর উৎপত্তি দৃশ্যপট থেকে ঝাপসা হয়ে গেছে। ঠিক যেন আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হওয়া কোনো জগদ্দল গাড়ির পেছনমুখী কাচে হারিয়ে যেতে থাকা অন্য কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার দৃশ্যের মতো।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের আগে-পরের গাজাবাসীর জীবন প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে। কারণ, গণমাধ্যম শ্বাসরুদ্ধকরভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ আশঙ্কার কথা বলছে।
৭ অক্টোবরের ঘটনায় কিছু ইসরায়েলির জীবনও ওলটপালট হয়ে গেছে। তাঁরা একইভাবে অবহেলিত বোধ করছেন।
ইসরায়েলি জিম্মি নিমরোদ কোহেনের বাবা ইহুদা কোহেন গত সপ্তাহে ইসরায়েলের কান নিউজকে বলেন, ‘আমাদের পাশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’
ইহুদা কোহেন বলেন, ‘অর্থহীন’ একটি যুদ্ধে দেশকে ঠেলে দেওয়া এবং সম্ভাব্য সব শত্রুর মুখোমুখি দাঁড় করানোর সব দায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর।
ইহুদা কোহেন আরও বলেন, নেতানিয়াহু ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে একটি মামুলি ব্যাপারে পরিণত করতে সব আয়োজন দারুণ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করছেন।
অবশ্য সব ইসরায়েলি ইহুদা কোহেনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নন। অনেকের মতে, এক বছর আগে হামাসের চালানো হামলাটি ছিল ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ধ্বংসের জন্য ইসরায়েলের শত্রুদের প্রথম পদক্ষেপ।
ইসরায়েলও পাল্টা আঘাত করেছে। যেমন লেবাননে হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত পেজারে বিস্ফোরণ ঘটানো, নিশানা করে গুপ্তহত্যা, দূরপাল্লার বোমা হামলা ও গোয়েন্দা তথ্যে পরিচালিত অভিযান, যা (গোয়েন্দা) নিয়ে দেশটি অনেক গর্ব করে থাকে। এসব পদক্ষেপ ইসরায়েলের এক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ‘আত্মবিশ্বাস’ কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছে।
নেতানিয়াহু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ইসরায়েল পৌঁছাতে পারে না।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের পরের কয়েক মাস নেতানিয়াহুর জনসমর্থন তলানিতে নেমে গিয়েছিল। এখন তা ধীর ধীরে বাড়ছে। এটি হয়তো তাঁর জন্য আরও দুঃসাহসী পদক্ষেপের ‘ছাড়পত্র’!
কিন্তু সবকিছু কোন দিকে যাচ্ছে?
ইরানে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত সিমন গাস সম্প্রতি বিবিসির টুডে পডকাস্টকে বলেন, ‘আমরা কেউই জানি না, এই সংঘাত কখন থামবে, আর সেই সময় সবাই কোথায় থাকবে।’
সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা সম্প্রতি ইসরায়েলে যে সফর করেছেন, তা থেকে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক উপায় খোঁজার চেয়ে সংকট ব্যবস্থাপনায় বেশি জোর দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে আগের চেয়ে বেশি বিষাক্ত। এই পরিস্থিতিকে কোনো সাহসী নতুন মার্কিন উদ্যোগের জন্য উপযুক্ত মুহূর্ত বলে মনে হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আপাতত তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হলো, বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাত ঠেকানো।
মিত্রদের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে, সম্প্রতি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার ইসরায়েলের আছে, এমনকি তা তার কর্তব্যও।
ইরানের এই হামলায় কোনো ইসরায়েলি নিহত হয়নি। ইরান সামরিক ও গোয়েন্দা লক্ষ্যবস্তু নিশানা করে হামলা চালিয়েছিল বলে মনে হয়। তা সত্ত্বে নেতানিয়াহু কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
কয়েক সপ্তাহের অত্যাশ্চর্য কৌশলগত সাফল্যের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছেন বলে মনে হচ্ছে।
ইরানের জনগণকে উদ্দেশ করে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত দিয়েছেন, তেহরানে সরকারে পরিবর্তন আসছে। তিনি বলেছেন, ইরান যখন শেষ অবধি মুক্ত হবে, তখন সবকিছু পাল্টে যাবে। আর সেই মুহূর্তটি ধারণার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের আগ দিয়ে মার্কিন নব্য-রক্ষণশীলদের কথাবার্তার অস্বস্তিকর প্রতিধ্বনি রয়েছে নেতানিয়াহুর এই বক্তৃতায়।
তবে এমন বিপদের মধ্যেও ভঙ্গুর কিছু সুরক্ষা আছে।
ইরানি শাসকেরা ইসরায়েল ছাড়া একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু তারা জানে, এই অঞ্চলের একমাত্র পরাশক্তিকে মোকাবিলার জন্য সে খুবই দুর্বল। বিশেষ করে এমন একটি সময়ে, যখন ইরানের মিত্র ও কথিত প্রতিরোধ ছায়াশক্তি (প্রক্সি) হিজবুল্লাহ ও হামাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসরায়েল।
অন্যদিকে ইসরায়েল চায়, ইরান–সৃষ্ট হুমকি থেকে পরিত্রাণ পেতে। তবে ইসরায়েলও জানে, সাম্প্রতিক সাফল্য সত্ত্বেও তারা একা এই কাজ করতে পারবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছেছবি: এএফপি
ইরানে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের করণীয়ের তালিকায় নেই। তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের তালিকাতেও তা নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন একপর্যায়ে মনে হয়েছিল, তিনি ইরানে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। ২০১৯ সালের জুনে একটি মার্কিন নজরদারি ড্রোন ভূপাতিত করে ইরান। তারপরই এমনটা মনে হয়েছিল। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটেন। যদিও ওই ঘটনার সাত মাস পর তিনি ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হতে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে লড়ছেন।
এক বছর আগে খুব কম লোকই কল্পনা করতে পেরেছিল যে মধ্যপ্রাচ্য কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্তের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু জগদ্দল গাড়িটির পেছনমুখী আয়নায় তাকালে দেখা যায়, গত ১২টি মাস ভয়ানক এক যুক্তির পথে চলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অনেক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। এখনো উদ্বেগজনক গতিতে নানান ঘটনা ঘটছে। নীতিনির্ধারকেরা ও বাকিরা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধের দাবিতে দেশে দেশে বিক্ষোভ হয়ে আসছে
গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধের দাবিতে দেশে দেশে বিক্ষোভ হয়ে আসছেছবি: রয়টার্স
গাজা যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে। যখন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে, তখন গাজাকে কীভাবে পুনর্গঠন ও শাসন করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা আরও বড় যুদ্ধের দামামায় এই আলোচনা চাপা পড়েছে।
ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের বিরোধের সমাধানের বিষয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনার অবস্থাও একইভাবে চাপা পড়েছে। সেই বিরোধই আজ পরিস্থিতিকে এখানে নিয়ে এসেছে।
ইরান-ইসরায়েল বাহাস হয়তো এ অঞ্চলকে গভীরতর সংকটে ফেলে দেবে না। ভবিষ্যতে কখনো যখন ইসরায়েল মনে করবে হামাস ও হিজবুল্লাহর যথেষ্ট ক্ষতি করা হয়ে গেছে, যখন ইসরায়েল ও ইরান তাদের যা বলার, বলে সারবে এবং যখন মার্কিন নির্বাচন শেষ হবে, তখন হয়তো সংকট সমাধানের কূটনীতি আরেকটি সুযোগ পেলেও পেতে পারে।
কিন্তু এই মুহূর্তে সংকট সমাধানের বিষয়টিকে খুব দূরের পথ বলে মনে হয়।