‘জনতার চোখ’ নামে একটি রাজনৈতিক ম্যাগাজিনে মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন পড়লাম। হেডিং : ‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না...’। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি না তা নিয়ে এ লেখা পড়ে আমি নিশ্চিত, দেশত্যাগের পূর্বে তিনি পদত্যাগ করে যাননি বা সময় পাননি বা যারা আগ্রহের সঙ্গে তাকে বিদায় দিয়েছেন, তাদের সেদিকে খেয়াল ছিল না। রাষ্ট্রপতির মন্তব্য নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন।
ব্যাপক সমালোচনার মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপপ্রেস সচিব মুহা. শিপলু জামান সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে, তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে, সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নং-০১/২০২৪ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ৮ আগস্ট, ২০২৪ এর আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে। মীমাংসিত এই বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এ নিয়ে আলোচনার আগে একটু ভণিতা দরকার আছে। মতিউর রহমান চৌধুরীকে আমি চিনি দীর্ঘদিন, সম্ভবত ১৯৭৮ সাল থেকে। ফেরদৌস কোরেশীর ‘দৈনিক দেশবাংলা’ পত্রিকায় আমরা কাজ করতাম। এরপর ‘দৈনিক সংবাদ’ এবং ‘দৈনিক বাংলার বাণী’। এরপর তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ চলে যান। ওই সময়টায় দক্ষ রিপোর্টার যে কজন ছিলেন, মতিউর রহমান চৌধুরী তাদের শীর্ষে ছিলেন। তার গুণকীর্তন করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, শুধু এটুকু বলা যে, এত দিন পরেও, ঠিক আগের মতোই তিনি একটি নির্মোহ সত্য টেনে বের করে এনেছেন।
ধন্যবাদ মতিউর রহমান চৌধুরীকে একটি সংশয় দূর করার জন্য। প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে যাননি, তাতে কী হয়েছে? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এতে খুশি হতে পারেন বটে, কিন্তু যারা ক্ষমতায় বসে আছেন, তাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, থাকার কথা নয়। তারা এটিকে বিপ্লব বলছেন, বিপ্লবের পর অনেক কিছুই থাকে না, বিপ্লবীরা যা বলেন সেটাই কার্যকর হয়ে থাকে। কাজেই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি না তা অবান্তর।
যারা স্বপ্ন দেখছেন শেখ হাসিনা এখনো বৈধ প্রধানমন্ত্রী, তাদের মোহ দূর হতে কিছুটা সময় নেবে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অনেকের সঙ্গে আমিও ভারতে যাই, তখন প্রতিদিনই আমরা শুনতাম ‘জিয়াউর রহমান’ কালই পড়ে যাচ্ছেন এবং আমরা বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরছি। তা ঘটেনি, আমরা চোরের মতো দেশে ফিরেছিলাম। যারা ক্ষমতাসীন, তারা অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছেন বটে, কিন্তু ‘ধপাস’ করে পড়ে যাবেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই?
আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ভাবছেন, ভারত যেনতেন প্রকারে আবারও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তাদের জন্য আমার খারাপ লাগে এবং বাংলাদেশের হিন্দুদের কথা মনে পড়ে। হিন্দুরা গত ৫৩ বছর ধরে ভেবেছে ভারত তাদের জন্য কিছু একটা করবে। ভারত করেনি। কেউ করে না। আওয়ামী লীগও করেনি। এটাই বাস্তবতা। ভারত এ সময়ে হিন্দুদের পক্ষে কথা বলছে, এটিও হিন্দুদের জন্য নয়, ভারত অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে তা বলছে। এটি রাজনীতি।
ভারত বৃহৎ শক্তি। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে এর অঙ্গীকার আছে, আছে বিশ্ব রাজনীতি, চাইলেই ভারত সবকিছু করতে পারে না। নিশ্চয় দিল্লি চাইবে ঢাকায় একটি ‘অনুকূল’ সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার এখন আগের চাইতে অনেক কম ‘অ্যান্টি-ভারত’, কারণ বাস্তবতা। মালদ্বীপের মোহাম্মদ মুইজ্জু ইতিমধ্যে দিল্লিতে এসে ধরনা দিয়েছেন। ভারত সবুজ সিগন্যাল দিলে ড. ইউনূস কালবিলম্ব না করে দিল্লি যাবেন। দেশের জন্যই তাকে যেতে হবে।
সূত্র : ঠিকানা