গোল করিয়েছেন, আবার গোলও করে আর্জেন্টিনার ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠেন মেসি। দলকে যখন তিনি সেমিফাইনালে নিয়েই যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই খলনায়ক হয়ে আসেন বদলি হয়ে নামা ডাচ স্ট্রাইকার ভুট ভেগহোর্স্ট। পরপর দুই গোল করে ড্র এনে নিজের দলে স্বস্তি ফেরান তিনি। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও ড্র হলে পেনাল্টিতে যায়।
পেনাল্টিতে ম্যাচের নায়ক হয়ে ওঠেন আলবিসেলেস্তে গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেস। শুরুতেই ভার্জিল ফন ডাইকের গোল ঠেকিয়ে শুরু করেন টাইব্রেকার। পরেরবার ঠেকান স্টিফেন বার্গভিনের শট। মাঝে মেসি এসে সফল স্পট কিক নেন। পারেদেস ও মন্তিয়েল এসেও হন সফল। তিনে স্পট কিক নেওয়া ডাচ ফুটবলার সফল স্পট কিক নিলেও চারে আর্জেন্টাইন এনসো ফার্নান্দেস এসে পারেননি। এদিকে নেদারল্যান্ডসের ভুট ভেগহোর্স্ট ও লুক ডি জং সফল হন। বাকি ছিলো আর্জেন্টাইন কারও সফল কিক নেওয়ার। সেটিই করে দেখালেন লাওতারো মার্তিনেস।
কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আজ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২-২ ব্যবধানে ড্র করে নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ করে আর্জেন্টিনা। মেসির সহায়তায় প্রথমার্ধে দলকে এগিয়ে নেন নাহুয়েল মোলিনা। বিরতির পর পেনাল্টি করে গোল ব্যবধান আরও বাড়ান পিএসজি ফরোয়ার্ড। শেষদিকে পরপর দুই গোল করে ম্যাচে রোমাঞ্চ তৈরি করেন বদলি হয়ে নামা ডাচ স্ট্রাইকার ভুট ভেগহোর্স্ট। অতিরিক্ত সময়ে কোনো গোল না হলে ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়। সেখানে ৪-৩ ব্যবধানে জেতেন মেসিরা।
ম্যাচের শুরুটা হয় সমানে সমান। যদিও বল দখলে এগিয়ে থাকে নেদারল্যান্ডস। তবে সুযোগ পেলেই আক্রমণ করতে পিছপা হয়নি আর্জেন্টিনা। ২২তম এগিয়ে যেতে পারতো আর্জেন্টিনা। তবে বক্সের সামনে থেকে মেসির বাঁকানো শট অল্পের জন্য পোস্টের ওপর দিয়ে যায়।
৩৭তম মিনিটে মেসি-মোলিনা যুগলবন্দীতে ঠিকই সাফল্যের দেখা পায় আর্জেন্টিনা। কাঁধ দিয়ে বল নামিয়ে প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডকে পরাস্ত করে বক্সের ভেতরে বল বাড়িয়ে দেন মেসি। বল দখলে নিয়ে দারুণ দক্ষতায় প্রতিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন মোলিনা। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারের এটি জাতীয় দলের জার্সিতে ২৫ ম্যাচে প্রথম গোল।
মোলিনাকে বল বানিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপে নিজের সপ্তম অ্যাসিস্টের দেখা পেলেন মেসি। ১৯৬৬ সালের পর তার চেয়ে শুধু দিয়েগো ম্যারাডোনা (৮) বেশি অ্যাসিস্ট করেছেন। মেসির সাত অ্যাসিস্টে আবার ভিন্ন সাত খেলোয়াড় গোল করেছেন।
বিরতির পর বল দখলে নেদারল্যান্ডস এগিয়ে থাকলেও সুযোগ খুঁজতে থাকে আর্জেন্টিনা। ৬২তম মিনিটে বক্সের বাইরে ফন ডাইকের ফাউলের শিকার হন মেসি। সেখান থেকে নেওয়া স্পট কিক ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ৭৩তম মিনিটে আকুনিয়া বক্সে ফাউলের শিকার হলে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। সফল স্পট কিকে ডাচদের জাল খুঁজে নেন মেসি।
৭৮তম মিনিটে মেমফিস ডিপেইয়ের বদলি হয়ে মাঠে নামেন ভেগহোর্স্ট। নামার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দলের ব্যবধান কমান তিনি। স্টিভেন বেরহাসের ক্রস থেকে দারুণ হেডে জাল খুঁজে নেন বেসিকতাসের এই ফরোয়ার্ড। যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে বক্সের কাছাকাছি এই ভেগহোর্স্টকেই ফাউল করেন হেরমান পেস্সেইয়া।
বিপজ্জনক জায়গা থেকে স্পট কিকি নেন টিউন কুপমেইনার্স। তার নেওয়া শট রক্ষণদেয়ালের ভেতর দিয়ে বের হয়ে পায়ে যেতেই বল জালে পাঠান ভেগহোর্স্ট। আর তাতেই সমতায় ফিরলো ডাচরা। দলটির সমর্থকদের উল্লাসে আবারও জেগে উঠলো গ্যালারি। যোগ করা সময়ও শেষ হয়ে যায়; ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
১০৪তম মিনিটে ফ্রি-কিক থেকে মেসির নেওয়া শট অল্পের জন্য পায়ে লাগাতে পারেননি আকুনা। স্পর্শ লাগলেই গোল হতে পারতো সেটি। ১১০তম মিনিটে সতীর্থের সঙ্গে বল দেওয়া নেওয়া করে দারুণ এক শট নেন মেসি। যদিও সেটি গোলপোস্টের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ১১৪তম মিনিটে ডান দিক থেকে দেওয়া এনসো ফার্নান্দেসের পাস থেকে শট নেন লাওতারো মার্তিনেস। সেটি দারুণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন ফন ডাইক।
এক মিনিট পর আবারও সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। কর্ণার থেকে উড়ে আসা বল নিয়ন্ত্রণে এনে শট নেন ফার্নান্দেস। সেটি ভেগহোর্স্টের পা ছুঁয়ে গোলপোস্টের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ১১৯তম মিনিটে ফার্নান্দেসের পাস থেকে শট নেন লাওতারো। লাফিয়ে সেটি ঠেকান ডাচ গোলরক্ষক নোপার্ট। অতিরিক্ত সময়ের শেষমুহূর্তে ফার্নান্দেসেরই নেওয়া বুলেট গতির শট গোলপোস্টে লেগে ফিরে আসে।
ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে সেমিতে ক্রোয়েশিয়া
রাশিয়া বিশ্বকাপে অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে একটি ম্যাচও হারেনি ক্রোয়েশিয়া। কাতার বিশ্বকাপে যেন একই চিত্রনাট্য লিখছে তারা।
গতবারের মতো এবারও টাইব্রেকারে জিতে সেমিফাইনালে পা রাখলো গত আসরের রানার্সআপরা। কাঁদিয়েছে হেক্সা জয়ের মিশনে আসা ব্রাজিলকে। ভাগ্য নির্ধারণের খেলায় ৪-২ ব্যবধানে জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শেষ চার নিশ্চিত করেন লুকা মদ্রিচরা।
মার্কিনিয়োসের শটটা পোস্টে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই জার্সি দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন রদ্রিগো। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এমন দুর্বিষহ রাতটা কি ভুলতে পারবেন তিনি। নিশ্চিত করে বলা যায় রাতটা নির্ঘুমে কাটবে এই ফরোয়ার্ডের। কেন নয়! টাইব্রেকারে ব্রাজিলের হয়ে প্রথম শটটি নিতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু জালের ঠিকানা খুঁজে পাননি। বাঁ দিকে ঝাপিয়ে পড়ে তার শট ঠেকিয়ে দেন ডমিনিক লিভাকোভিচ। পরে পেদ্রো ও কাসেমিরো গোলের দেখা পেলে ব্রাজিলের আশা কিছুটা বাড়তে। চতুর্থ শটটি পোস্টে লাগিয়ে ব্রাজিলের হেক্সা জয়ের অপেক্ষা আরো বাড়িয়ে দিলেন মার্কিনিয়োস। ২০ বছরেও ফুরোলো না সেই আক্ষেপ। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়ার হয়ে চারটি শটের প্রতিটিতে গোল করেন নিকোলা ভ্লাসিচ, লাভ্রো মায়ের, লুকা মদ্রিচ ও মিসলাভ ওরসিচ। তাদের একজনের শটেও হাতের নাগাল পাননি ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক আলিসন বেকার। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ভুত যেন তাড়া করেছিল। কেননা টাইব্রেকারে ব্রাজিলের সবশেষ হারটা সেই বিশ্বকাপেই। যেখানে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরেছিল সেলেসাওরা। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এবারও বিদায় নিল সেই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। সেটাও টানা দ্বিতীয়বার।
এডুকেশন স্টেডিয়ামে নির্ধারিত ৯০ মিনিটেও যখন আলাদা করা যায়নি তখন খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়। নেইমারের গোলে অবশেষে ডেডলক ভাঙে ব্রাজিল। ১০৫ মিনিটে অপ্রতিরোধ্য থাকা ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক লিভাকোভিচকে পরাস্ত করেন তিনি। লুকাস পাকেতার সঙ্গে ওয়ান-টু করার পর ডান প্রান্ত থেকে সুক্ষ্মকোণ দিয়ে বল জালে জড়ান নেইমার। এই গোলের মাধ্যমে কিংবদন্তি পেলেকে ছুলেন এই ফরোয়ার্ড। ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ৭৭ গোল নিয়ে পেলের সঙ্গে শীর্ষে আছেন তিনি। কিন্তু বেশিক্ষণ এগিয়ে থাকতে পারেনি ব্রাজিল। গোলমুখে একটি মাত্র শট নিল ক্রোয়েশিয়া। আর তাতেই গোল। ১১৭ মিনিটে ওরসিচের পাস থেকে বাঁ পায়ের দুর্দান্ত শটে জাল খুঁজে নেন পেতকোভিচ। তার গোলেই সমতা ফিরিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে ক্রোয়াটরা।
এর আগে পুরো ৯০ মিনিট আক্রমণে পর আক্রমণে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্স ও গোলরক্ষককে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে ব্রাজিল। কিন্তু গোলের দেখা পায়নি। শতচেষ্টা করেও মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছে নেইমার-রিচার্লিসনদের। দুর্গ রক্ষার পাশাপাশি পাল্টা আক্রমণে যায় ক্রোয়েশিয়াও। কিন্তু ব্রাজিলের ডি বক্সে সেভাবে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারেনি। কাতার বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালের শুরুটা হয় ম্যাড়মেড়ে। রেফারির বাঁশি বাজার পর ব্রাজিলকে চেনাই যাচ্ছিল না। ছন্দ খুঁজে পেতে সময় নেয় তিতে শিষ্যরা। তবে মিডফিল্ডে জায়গা হারাচ্ছিল ক্রোয়াটদের কাছে। তারপরও সেই দুঃসময় কাটিয়ে ওঠে সেলেসাওরা। কিন্তু কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক লিভাকোভিচকে। গোলমুখে ব্রাজিলের নেওয়া ৮টি শটের সবগুলোই ঠেকিয়ে দেন তিনি।
প্রথমার্ধে মারিও পাসালিচের নেওয়া ক্রস মিলিতাওয়ের চাপে ঠিকঠাক পায়ে লাগাতে পারেননি পেরিসিচ। ২০তম মিনিটে সুযোগ পায় ব্রাজিল। বক্সে রিচার্লিসনের সঙ্গে বল দেওয়া নেওয়ার এক পর্যায়ে শট নেন তিনি। সেটি অবশ্য ঠেকিয়ে দেন ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক। ৪২তম মিনিটে বক্সের খুব কাছেই ফ্রি-কিক পায় ব্রাজিল। নেইমারের নেওয়া শট ঝাপিয়ে ঠেকান ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক।
৫৫ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে নেইমার রাইফেল ছুঁড়লেও তা জালের দেখা পায়নি। দারুণ দক্ষতায় তা ঠেকিয়ে দেন ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচ। ৬৬ মিনিটে আবারও ব্রাজিলের বাধা হয়ে দাড়ান তিনি। ক্রোয়েশিয়ার ডি বক্সে লুজ বল পেয়েছিলেন লুকাস পাকেতা। তাকে আটকানোর মতো কেউ ছিল না তখন। কিন্তু লিভাকোভিচ জাল রক্ষা করতে কোনো ভুল করেননি। কর্নারের মাধ্যমে পাকেতার সেই শট ফিরিয়ে দেন তিনি।
৭৬ মিনিটে নেইমারকে বাঁ প্রান্ত দিয়ে ঢোকার সুযোগ করে দেন রিচার্লিসন। লিভাকোভিচ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন নেইমারের পায়ে বল থাকা মানেই বিপদ। তাই তাকে আটকাতে নিজের সর্বস্বটা উজাড় করে দেন তিনি। নেইমারের শট পা দিয়ে ঠেকিয়ে দেন এই গোলরক্ষক। দ্বিতিয়ার্ধের যোগ করা সময়ে বাঁ পায়ে কাট করেন আন্তনি। কিন্তু তা সোজা চলে যায় লিভাকোভিচের হাতে। সেই লোকোভিচের হাতের জাদুতেই আজ সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া। স্বপ্ন দেখছে আবারও ফাইনালে ওঠার।