ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন সমাজে চলছে নানামুখী আলোচনা। ডেমোক্র্যাট দলকে রীতিমতো ধরাশায়ী করে ক্ষমতার মঞ্চে আসছেন ট্রাম্প। সরকারের সবগুলো স্তম্ভে আধিপত্য নিয়ে এমন ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র নিকট অতীতে কখনো পায়নি। রাজনীতির চেনা পথ মাড়িয়ে একজন ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হননি। ফলে কেউ আগাম কিছু বলতে পারছে না, কেমন হবে দ্বিতীয় দফা ট্রাম্পের আমেরিকা। নির্বাচনি প্রচারণার ট্রাম্পকে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কতটা ভিন্ন দেখা যাবে? এ নিয়ে যেমন আশাবাদ আছে। তেমনি আছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। আসছে ২০ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে শপথ গ্রহণ করবেন ট্রাম্প। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন, জারি করবেন নির্বাহী আদেশ এবং সেদিন থেকেই শুরু হবে ওয়াশিংটনে ট্রাম্পীয় অস্থিরতার আরও চারটি বছর।
ট্রাম্পের কর্মপরিকল্পনার প্রধান অংশ হচ্ছে অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, দেশের ভিতরে অবস্থানরত অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত নির্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও, মেক্সিকো সীমান্তে সম্পূর্ণরূপে প্রাচীর নির্মাণ এবং সীমান্ত রক্ষা করতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার মতে, এই পদক্ষেপগুলো আমাদের দেশকে সুরক্ষিত করবে এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প এই নীতিমালার আওতায় ‘ক্যাচ অ্যান্ড রিলিজ’ নীতি বাতিল করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যাতে সীমান্তে গ্রেপ্তার অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে দ্রুত ফেরত পাঠানো যায়।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন অভিবাসী ও আমেরিকান মুসলমানরা। জন্মসূত্রেই আমেরিকান হওয়া ছাড়াও অবৈধভাবে প্রবেশ করা লাখ লাখ লোকজনকে নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করার ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প নির্বাচনে প্রার্থী হয়েই। ডেমোক্র্যাটদের উপর নানা কারণে বিরক্ত বিভিন্ন অভিবাসী গ্রুপ গত নির্বাচনে ট্রাম্পকেই ভোট দিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় অভিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে হিসপানিকরাও রয়েছে।
বিভিন্ন রাজ্যে হিসপানিক ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। ব্যাপক বিতাড়নের উদ্যোগ নেয়া হলে এ অভিবাসী গোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জন্মসূত্রে আমেরিকান হওয়া যাবে না, এমন নির্দেশ কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতীয় অভিবাসীরা। কর্মসূত্রে আমেরিকায় থাকা বিপুলসংখ্যক ভারতীয়দের সন্তানরা এমন নির্দেশের খড়গে পড়বে। অথচ গত নির্বাচনে ভারতীয় আমেরিকানরা একাট্টা হয়েই ভোট দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে অভিবাসীদের সংকট হবে, এমন প্রচারণার বিপরীতে ডেমোক্র্যাটদের কোন বার্তা ছিল না। অভিবাসন সমস্যায় জর্জরিত লোকজনের অভিবাসন সমস্যার সমাধান নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্যের অবস্থানের কারণেই ডেমোক্র্যাটরা এবারের নির্বাচনে ভোট পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি নথিপত্রহীন অভিবাসী এখন। আমেরিকার কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে, কারো বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখতে গেলে, কর্মজীবী কোন পরিবারের সন্তান দেখভালের কাজ - এসবের জন্য অভিবাসী ছাড়া কোন উপায় নেই। মার্কিন অর্থনীতির চালিকা শক্তি যে অভিবাসী, তাদের প্রায় দুই কোটি লোকজনকে বের করে কি আদৌ সম্ভব? - এ প্রশ্নও উঠেছে।
যদিও ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগাম সংবাদে বিভিন্ন সীমান্ত রাজ্যগুলোতে এক ধরনের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা গেছে। লোকজনকে তল্লাশি করে, যাদের কাজের অনুমতি নেই বা বৈধ ভিসা নেই তাদের আটক করে রাখার জন্য প্রাইভেট জেলখানা প্রস্তুত করা হচ্ছে। সরকারি স্থাপনায় এতো বেশি লোকের ব্যবস্থাপনা করার কোনো সুযোগই নেই। ফলে সরকার এধরনের কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেবে। মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের অর্থে লোকজনকে আটক রাখা এবং এদের যথা নিয়ম অবলম্বন করে বিতাড়ন করা শুধু ব্যয়বহুলই নয়, অনেকটা অসম্ভব কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। অভিবাসীরা আমেরিকা দখল করে নিচ্ছে বলে রাজনীতির মাঠ গরম করা যায়, অভিবাসী ছাড়া আমেরিকাকে চিন্তাই করা যায় না।
ইমিগ্রেশন কোয়ালিশনগুলো এমনিতেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক অভিবাসন আইন প্রণয়নে আন্দোলন করা ছাড়াও আইনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ট্রাম্পকে। যদিও মার্কিন সর্বোচ্চ আদালতে এখন রক্ষণশীল বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আইনের ধাপগুলো অতিক্রম করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এরমধ্যে অভিবাসী আইনজীবীরা যেকোনো নির্বাহী আদেশকে কংগ্রেসে পাশ করইয়ে আনার জন্য আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষতেও রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও আইন প্রণয়ণের বিতর্ক শুরু হলে দলীয় সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি প্রকাশ্য হয়ে উঠে। অভিবাসনের মতো একটি জ্বলন্ত ইস্যু নিয়ে মার্কিন রিপাবলিকান আইন প্রণেতারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন, এমন সম্ভাবনাও বেশ দুর্বল বলে মনে করছেন অনেক অভিবাসী আইনজীবী।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প সমর্থকদের একটি বিশাল ভিড় ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায় যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। ওই হামলার পর ১৫শ জনেরও বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প দাঙ্গাকারীদের ক্ষমার ঘোষণা করবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে চলমান ফেডারেল মামলাগুলোর বিচার বন্ধ করবেন। ট্রাম্প দাঙ্গাকারীদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলে মন্তব্য করে বলেন, এই হামলাকারীরা জাতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও দেশপ্রেম দেখিয়েছিল। তিনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া কিছু লোক ছাড়া বাকিরা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন।
এদিকে, ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের ‘দুই সেকেন্ডের মধ্যে’ বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে বরখাস্ত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্প দাবি করেছেন, স্মিথ বিচার বিভাগের দীর্ঘস্থায়ী নীতির কারণে মামলাগুলোর সমাপ্তি নিয়ে চিন্তা করছেন এবং তার প্রশাসন দাঙ্গাবাজদের পুনর্বাসন করবে ও তাদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করবে। তবে এখনই স্পষ্ট নয় ট্রাম্প ক্ষমা প্রদানের জন্য কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্যাপিটলে হামলা একটি ভয়াবহ গণতান্ত্রিক সংকট ছিল এবং এমন কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা প্রদানের সিদ্ধান্ত দেশের আইন ও নৈতিকতার প্রতি বিরোধিতা করতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোন ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কোন আদালতে নেয়ার অধিকার কারও নেই। এরমধ্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জ্যাক স্মিথ এসব মামলা প্রত্যাহার করে ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের আগেই পদত্যাগ করবেন, এ কথাটি প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্প চীনের পণ্য আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করেছেন। যার ফলে আমেরিকান উৎপাদন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে বলে তার বিশ্বাস। তার পরিকল্পনায় উল্লেখ রয়েছে, এই শুল্ক রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করে দেশের কর্মসংস্থান বাড়ানো হবে এবং স্থানীয় ব্যবসাগুলোকে সহায়তা করা হবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি একদিকে মার্কিন অর্থনীতির ঘাটতি কমাতে চান। অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করতে চান। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপে মার্কিন ভোক্তাদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়তে পারে, এবং এর ফলে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীদের জন্য বাইডেন প্রশাসনের সুরক্ষামূলক পদক্ষেপগুলো বাতিলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। নিজের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীদের জন্য করা সুরক্ষামূলক নীতিমালা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। যা চলতি বছরের এপ্রিলে বাইডেন প্রশাসন বাস্তবায়ন করেছিলো।
ট্রাম্প বলেছেন, আমরা প্রথম দিনেই এটি শেষ করতে যাচ্ছি। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আমরা এটি বদলাবো।
শিক্ষার্থীদের জন্য ফেডারেল তহবিল বন্ধ করারও হুমকি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, যদি কোনো স্কুলে সমালোচনামূলক জাতি তত্ত্ব বা ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষাবিষয়ক পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে তাহলে ফেডারেল তহবিল বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের সন্তানদের জীবনে এই ধরনের বিষয়বস্তু অনুপযুক্ত এবং আমরা তা মেনে নেব না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া বাস্তবায়িত করা কঠিন হতে পারে। তবে ট্রাম্প কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে নিজেই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন । এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সমকামী গ্রুপগুলো ব্যাপক আন্দোলনে নামবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জ্বালানি খাতে আরও আত্মনির্ভর হতে ‘ড্রিল, ড্রিল, ড্রিল’ নীতি অনুসরণ করে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে গতি আনার এই নীতি পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু নীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ঝুঁকি আরও বাড়াতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
গর্ভপাত, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার মতো জ্বলন্ত ইস্যু মোকাবেলা করতেই ট্রাম্পকে হিমশিম খেতে হবে। সমস্ত বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে উদ্বেগ ও কর্মসূচিগুলো রয়েছে, এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ট্রাম্প আন্তর্জাতিক চাপেই শুধু পড়বেন না। তাঁকে অভ্যন্তরীণ চাপকেও মোকাবেলা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা নেয়ার পর নিজের মতকেই মার্কিন সমাজে চাপিয়ে দেয়ার কাজ সহজ হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামোতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। অভিবাসন ও বাণিজ্য নীতির কড়াকড়ি স্থানীয় শিল্পকে মজবুত করলেও এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে। বিচার ব্যবস্থায় ক্ষমার প্রস্তাব আইনের শাসনের মূলনীতির ওপর আঘাত হানতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে, পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের 'জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক' নীতির কারণে পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে।