সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উড়োজাহাজে ওঠার জন্য হোয়াইট হাউসের দক্ষিণ লন দিয়ে বের হচ্ছেন তিনি। ১২ মে ২০২৫ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন। আজ মঙ্গলবার তিনি সৌদি আরবে যাবেন। মার্কিন অর্থনীতির জন্য বড় অঙ্কের নতুন বিনিয়োগ নিশ্চিত করাই তাঁর এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরের মূল উদ্দেশ্য।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক অর্থনীতিবিদ ক্যারেন ইয়ং বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ সফরে (যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও বেশি উপসাগরীয় বিনিয়োগের) ঘোষণা প্রত্যাশা করেন।’
ক্যারেন আরও বলেন, ‘বৈঠকে তিনি (ট্রাম্প) একটি বড় পোস্টার রাখতে চান, যেখানে বিনিয়োগগুলো কোথায় হতে পারে, তা লেখা থাকবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ঘরোয়া শিল্পের ওপর এই বিনিয়োগের প্রভাব কী হতে পারে, তার কিছু অনুমানও তিনি পোস্টারে তুলে ধরতে চান।’
ট্রাম্প সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে দেশটির কার্যত শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আজ বৈঠক করবেন। আগামীকাল বুধবার সেখানে উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতাদের এক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন। সেদিনই কাতার সফরে যাবেন তিনি। পরের দিন বৃহস্পতিবার সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সফরের মধ্য দিয়ে তাঁর তিন দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে উপসাগরীয় অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ, তা তাঁর এ সফরের মধ্য দিয়ে আবারও স্পষ্ট হলো। পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্যে যোগ দিতে ট্রাম্প সম্প্রতি রোমে গিয়েছিলেন, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল না। তাই সৌদি আরবের মাধ্যমেই দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট মেয়াদে তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদেশ সফর শুরু হলো।
বৈঠকে তিনি (ট্রাম্প) একটি বড় পোস্টার রাখতে চান, যেখানে এই বিনিয়োগগুলো কোথায় হতে পারে তা লেখা থাকবে।
ক্যারেন ইয়ং, মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক
ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদেও প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নিয়েছিলেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক সময়ের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম। দেশটির আধুনিককালের প্রেসিডেন্টরা প্রথম বিদেশ সফরের জন্য সাধারণত যুক্তরাজ্য, কানাডা কিংবা মেক্সিকোকে বেছে নেন।
উপসাগরীয় দেশগুলোর বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তহবিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে সেটাকে বিশেষ অর্জন হিসেবে প্রচার করবেন ট্রাম্প। দেশে ফিরে তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সাফল্যের কথা প্রচার করতে পারবেন।
ট্রাম্পের সফরকে কেন্দ্র করে ওয়াল স্ট্রিট ও সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ নির্বাহীরা সৌদি আরবে ছুটছেন। আজ রিয়াদে অনুষ্ঠেয় সৌদি-মার্কিন বিনিয়োগ সম্মেলনে ব্ল্যাকরক, প্যালান্টির, সিটিগ্রুপ, আইবিএম, কোয়ালকম, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ও ফ্র্যাঙ্কলিন টেম্পলটনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) অংশ নেবেন।
এমন এক সময়ে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নানা প্রতিকূলতার মুখে রয়েছে। ট্রাম্পের নতুন আমদানি শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগকারীদের আস্থা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থনীতিও চাপে পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উৎপাদন কমেছে, যা গত তিন বছরে এবারই প্রথম।
গত জানুয়ারিতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা করেছিলেন, আগামী চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব। তবে ট্রাম্পের প্রত্যাশা, এ অঙ্ক বাড়িয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২১ লাখ ৫২০ হাজার কোটি টাকা) করা হবে। সৌদি আরব আরও বেশি মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম কিনবে বলেও আশা করেন ট্রাম্প।
সৌদি সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিশ্লেষক ও লেখক আলি শিহাবি জানিয়েছেন, ট্রাম্পের এই সফরে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই বিশ্লেষকের মতে, ‘চুক্তিগুলোর মাধ্যমে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবে। উভয় দেশে যৌথ উদ্যোগ গড়ে উঠবে। পাশাপাশি আরও বেশি মার্কিন অস্ত্র ও পণ্য কেনা হবে।’
সৌদি আরবের বিনিয়োগ তহবিল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (পিআইএফ) অধীন বর্তমানে ৯২৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ রয়েছে। পিআইএফ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বড় বিনিয়োগ করেছে। এসবের মধ্যে অ্যাপভিত্তিক পরিবহনসেবা উবার, ভিডিও গেম নির্মাতা ইলেকট্রনিক আর্টস ও বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা লুসিডে বিনিয়োগ অন্যতম।
আমিরাত প্রসঙ্গ
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ১০ বছরে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), সেমিকন্ডাক্টর, জ্বালানি ও উৎপাদন খাতসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে। গত মার্চে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শেখ তাহনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের বৈঠকের পর হোয়াইট হাউস এসব তথ্য জানিয়েছিল।
তবে স্বল্প মেয়াদে এসব বিনিয়োগ বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ ক্যারেন ইয়ং। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পদক্ষেপ মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিনিয়োগের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হচ্ছে, তা ‘কিছুটা সংশয় নিয়ে দেখা উচিত’।
সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি
ট্রাম্পের চলতি মধ্যপ্রাচ্য সফরে একাধিক চুক্তির ঘোষণা আসতে পারে। এর মধ্যে সৌদি আরবের ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার সিদ্ধান্ত অন্যতম। এ চুক্তির আওতায় ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার সিস্টেম ও পরিবহন বিমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রিয়াদে মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় সৌদি-মার্কিন বিনিয়োগ সম্মেলনে ব্ল্যাকরক, প্যালান্টির, সিটিগ্রুপ, আইবিএম, কোয়ালকম, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ও ফ্র্যাঙ্কলিন টেম্পলটনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) অংশ নেবেন।
সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের অন্যতম বড় ক্রেতা। তবে ২০২১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন সৌদি আরবকে হামলায় ব্যবহারের উপযোগী অস্ত্রের বিক্রি স্থগিত করেছিল। সৌদি জোটের নেতৃত্বে প্রতিবেশী ইয়েমেনে চলা যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন।
সৌদিতে বাইডেন প্রশাসনের অস্ত্র বিক্রি স্থগিতের আরেকটি বড় কারণ ছিল ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছির, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেই খাসোগি হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন।
বাইডেন প্রশাসন গত বছর থেকে সৌদি আরবে আবার অস্ত্র বিক্রি শুরু করেছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বলা হয়েছিল, সৌদি আরব প্রতিবেশী ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ বন্ধ করেছে বলেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, গাজা সংকটের সমাধান ও এখানকার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনে সৌদি সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যেই ওয়াশিংটন এমনটি করেছে।
সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবির মতে, রিয়াদ হোয়াইট হাউসের কাছে একটি ‘কার্যকর ও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থার’ নিশ্চয়তা চাইবে, যাতে তারা আরও সহজে ও দ্রুত মার্কিন গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম পেতে পারে।
সৌদি সরকারের ঘনিষ্ঠ এই বিশ্লেষক বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যেই এসব চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাই আশা করা হচ্ছে, এ প্রক্রিয়া অবিলম্বে আরও সহজ হবে।’
এ সফরে ট্রাম্পের আলোচ্যসূচির আরেকটি বড় বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। আলোচনায় প্রধানত দুটি বিষয় উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে—এক. মার্কিন প্রযুক্তি খাতে উপসাগরীয় দেশগুলোর বিনিয়োগ আরও বাড়ানো এবং দুই. অঞ্চলটিকে সর্বাধুনিক মার্কিন সেমিকন্ডাক্টরে প্রবেশাধিকার দেওয়া।
আমিরাত ও সৌদি আরবের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত প্রধানত জ্বালানি তেলনির্ভর। তারা নিজেদের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে চাইছে। এ জন্য প্রযুক্তি ও এআই খাতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে আমিরাত নিজেদের একটি আন্তর্জাতিক এআই কেন্দ্রে পরিণত করতে চায়।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন বাইডেন আমলের চিপ-সংক্রান্ত নিয়মাবলি বাতিল করেছে। বাইডেন প্রশাসনের এ আইনে উপসাগরীয় দেশগুলোসহ ১২০টির বেশি দেশে উন্নত মার্কিন চিপ রপ্তানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল।
এখন হোয়াইট হাউস নতুন নিয়ম তৈরির পরিকল্পনা করছে। এসব নিয়ম তৈরির ক্ষেত্রে আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা হতে পারে।
ক্যারেন ইয়ংয়ের মতে, ‘আমিরাতের জন্য এটি অপরিহার্য। তারা আগ্রাসীভাবে নিজেদের এআই সক্ষমতা তৈরি করছে। তাই তাদের জন্য মার্কিন প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার পাওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা সেরা হতে পারে।’
সৌদিতে মার্কিন বিনিয়োগ
ট্রাম্পের এ সফরের প্রায় সব মনোযোগ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ আনার দিকে নিবদ্ধ থাকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ট্রাম্পের এ সফর সৌদি আরবের ‘ভিশন ২০৩০’–এর জন্য মার্কিন বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সৌদি সরকার নিজেদের অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার কেন্দ্রে আছে ভিশন ২০৩০। এর আওতায় বিশাল বিশাল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ‘দ্য লাইন’ নামের একটি লিনিয়ার শহর তৈরি অন্যতম। ভিশন ২০৩০–এর অধীন বিনোদন, পর্যটন, খনি ও ক্রীড়া খাতেও বিপুল বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
তবে সৌদি আরবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তৃতীয় বছর বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। দেশটি যে বিদেশি মূলধন আকর্ষণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জে রয়েছে, এর মধ্য দিয়ে সেটা বোঝা যায়।
চলতি বছরের শুরু থেকে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম পতনের কারণে রিয়াদের অর্থনীতির ওপর চাপ আরও বেড়েছে। ফলে উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো টিকিয়ে রাখতে দেশটির ওপর ঋণ বাড়াতে বা ব্যয় কাটছাঁট করতে ক্রমশ চাপ বাড়ছে।