মসজিদ-কবরের নামে নিউইয়র্কে রমরমা ব্যবসা

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০১ জুন ২০২৫, ১৩:১৮

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ধর্মের নামে বেড়ে চলেছে এক ধরনের নৈতিক বিচ্যুতি ও অর্থনৈতিক ফাঁদ। আপাদমস্তক তথাকথিত সুন্নতের পোশাকে নিজেকে আচ্ছাদিত করা কিছু ব্যক্তি, যাদের শরীরে আতরের ঘ্রাণ লেগে থাকে, তারা ধর্মীয় আড়ালে নিজেদের স্বার্থে জড়িয়ে পড়েছেন নানা অনৈতিক ব্যবসায়। এদের কেউ কেউ নিজেদের পরিচয় দেন আলেম হিসেবে, আবার অনেকের রয়েছে একদল অন্ধ অনুসারী, যারা ধর্মীয় কাজের অংশ মনে করে তাদের এই কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন।
সম্প্রতি নিউইয়র্কে এক ব্যবসায়ী- যিনি বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সরাসরি জড়িত- টেলিভিশনে সরাসরি অভিযোগ করেছেন এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, অনেক এলাকায় মসজিদ থাকা সত্ত্বেও নতুন মসজিদের নাম করে চাঁদা সংগ্রহের প্রবণতা বেড়েছে। কেউ কেউ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিটির ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু নিউইয়র্ক সিটিতেই ২৮০টির বেশি ইসলামিক সেন্টার ও মসজিদ রয়েছে। অথচ নিউইয়র্কের কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় কিছু গোষ্ঠী পুরাতন মসজিদের পাশাপাশি ‘নতুন মসজিদ’ তৈরির অজুহাতে বারবার চাঁদা তোলার ফর্মুলা চালু করেছেন।
কমিউনিটির একটি অনুসন্ধানী গ্রুপ বাংলাদেশ কমিউনিটি ওয়াচ এনওয়াইসি, ২০২৪ সালে তাদের এক রিপোর্টে জানায়- সাধারণ প্রবাসীদের কাছ থেকে ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে বছরে প্রায় ৩-৫ লাখ ডলারেরও বেশি তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মসজিদ নির্মাণ ও উন্নয়নের নামে, যার বড় অংশের হিসাব নেই বা অস্বচ্ছ।
আরেকটি বিস্ময়কর দিক হলো- কবরের ব্যবসায়। কিছু ব্যক্তি মানুষের কাছে কবরস্থানের ‘সংকটের’ গল্প শোনিয়ে জমজমাট কবর বিক্রির ব্যবসায় শুরু করেছেন। লেখকের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, তাঁর ব্লকে তাঁর নিজের পরিবার ছাড়া প্রায় সবাই আগেভাগেই কবরের জায়গা কিনে রেখেছেন।
নিউইয়র্কে মুসলিম কবরস্থানের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইসলামিক বিউরাল কাউন্সিল অব নিউ ইয়র্ক জানায়, ২০১৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র নিউইয়র্ক রাজ্যে অন্তত ১২টি নতুন মুসলিম কবরস্থান চালু হয়েছে। কিন্তু কবর ব্যবসায়ীদের দাবি, ‘জায়গার সংকট’ একটি বড় সমস্যা।
কিন্তু বাস্তবতা হল- ইসলাম ধর্মে আগাম কবর কেনা বা দখল করে রাখার সংস্কৃতি নেই। বরং ২০২১ সালে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, মক্কা ও মদীনার পাবলিক কবরস্থানে পুরনো কবরের জায়গা রিসাইকেল করে নতুন দাফন কার্যক্রম পরিচালিত হয় নিয়মিতভাবে। এক্ষেত্রে কেউ নামফলক স্থাপন করে চিরস্থায়ী স্মৃতি রাখে না, কারণ ইসলাম এটি সমর্থন করে না (সূত্র: সৌদে গেজেট, জুলাই ২০২১)।
ইসলামে কবরস্থানের ব্যবস্থাপনায় মানবিকতা, স্থিতিশীলতা ও দুনিয়ার সাময়িকতার বোধ স্পষ্ট। হাদিস অনুযায়ী, ‘যে স্থানে মৃত্যু ঘটে, সেখানেই মাটি হওয়াই মানুষের জন্য কল্যাণকর।’ (আবু দাউদ, কিতাব আল-জানায়িজ)। এছাড়া, রাসুলুল্লাহর (সা.) যুগেও কবর পুনঃব্যবহারের প্রথা ছিল।
ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘ধর্মকে যদি ব্যবসায়ের মোড়কে মুড়ে ফেলা হয়, তবে তা আর ধর্ম থাকে না, হয়ে ওঠে এক ধরনের উপাস্য বাণিজ্য।’
নিউইয়র্কে এই কথিত ‘আলেম ব্যবসায়ীদের’ কাছে ধর্ম এখন যেন সেই রূপেই হাজির হয়েছে।