উদ্বেগ বাড়াচ্ছে চিকেন পক্স

হাসপাতালে ভর্তি ৬৫ মৃত্যু ৩
নিজস্ব সংবাদদাতা
  ২৬ মার্চ ২০২৩, ১৪:১৬

শীত পেরিয়ে বসন্তকালে মাত্র পা রেখেছে দেশ। ঋতু বদলের এই সময়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে ছোঁয়াচে রোগ চিকেন পক্স বা জলবসন্ত। শিশু-বুড়ো সবাই এতে ভুগছেন। বিস্তার বাড়ায় হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে রোগীদের। ঘটছে প্রাণহানিও। যা রীতিমতো উদ্বেগের বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
চিকৎসকরা বলছেন, সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা ও শরীর ম্যাজম্যাজ করলে চিকেন পক্স হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ৫ থেকে ৯ বছরের শিশু এবং ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা এতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। মূলত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। তবে চলতি বছর আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি। হাঁচি, কাশি, থুতুর মাধ্যমে, একসঙ্গে থাকা ও খাওয়ার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। চিকেন পক্সের যে ফোসকায় জীবাণু থাকে, এটি ফেটে গিয়েও রোগ ছড়াতে পারে। এ রোগে মৃত্যুও ঘটে।
এ বছর বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মইনুল খোকন আমাদের সময়কে বলেন, ‘অতিমারী করোনায় মানুষ ঘরে ছিল, ফলে তারা ডায়াগনসিস সেভাবে করতে পারেনি। ভ্যাকসিনও সেভাবে নেয়নি। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় এই ডায়াগনসিস বেশি হচ্ছে। আক্রান্তও বাড়ছে।’ সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় দেশের
একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। জরুরি বিভাগে চিকেন পক্সের রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি সংকটাপন্নদের ভর্তির জন্য ২৫ শয্যার ওয়ার্ডও রয়েছে হাসপাতালটিতে, যা প্রায় সময়ই পূর্ণ থাকে রোগীতে।
দুই সপ্তাহ আগে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হন রাজধানীর ভাটারা থানার শাহজাদপুরের মো. রিয়াজ-নূরজাহানের সাত বছরের মেয়ে নুসরাত জাহান তানজিলা। শুরুতে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে, পরে হোমিও ওষুধ খাওয়ানো হয়। তবে তানজিলার উন্নতি তো দূরের কথা, অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। মেয়েকে বাঁচাতে পারবে কিনা, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে এই দম্পতি। পরে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা।
গতকাল বেলা ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন তানজিলা। মাথা, মুখ থেকে শুরু করে শরীরের সবখানে ফোসকা পড়েছে। শরীর এতটাই দুর্বল যে ঠিকমতো কথা বলা কিংবা নড়াচড়া করতে পারছে না শিশুটি।
তানজিলার বাবা মো. রিয়াজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘পরিবারের অন্যান্য সদস্যের চাপাচাপিতে ভুল চিকিৎসা পেয়েছে আমার মেয়ে। একটু ভুলে মেয়েকে হারাতে বসেছিলাম। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে এখানে (সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল) গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে নিয়ে এসেছি। চিকিৎসক বলেছেন, মেয়ে এখন সুস্থ হওয়ার পথে।’
পাশের শয্যায় চিকিৎসাধীন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার আলম শেখ। চিকেন পক্স দেখা দিলেও গুরুত্ব দেননি ৬৫ বছর বয়সী এ ব্যক্তি। বাজারে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যান, শরীরের ফোসকা ফেটে প্রচণ্ড রক্তপাত হলে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয় আলম শেখকে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে। আট দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসাধীন তিনি।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসকরা বলেন, ‘প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন চিকেন পক্সে আক্রান্ত রোগী আসছেন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে। ৯০ শতাংশই শিশু। যাদের একেবারে জটিল অবস্থা, তাদেরকেই শুধু ভর্তি নেওয়া হচ্ছে।’
জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. সাথী আমাদের সময়কে বলেন, ‘অন্যান্য বছরও এ সময়ে রোগীর চাপ বেশি থাকে, তবে এবার একটু বেশিই মনে হচ্ছে।’
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর প্রতিষ্ঠানটিতে চিকেন পক্স নিয়ে ২০৬ জন রোগীকে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ জনের। চলতি বছর (গতকাল পর্যন্ত) ৬৫ রোগী ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ২৭ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন তিনজন।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. মো. আরিফুল বাসার আমাদের সময়কে বলেন, ‘সাধারণত চিকেন পক্সে খুব বেশি জটিলতা দেখা যায় না। তবে আক্রান্ত কোনো শিশুর যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকে, বিশেষ করে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত ও স্টেরয়েডনির্ভর শিশুরা এতে সহজে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কখনো কখনো আক্রান্ত ব্যক্তির অস্বাভাবিক রক্তপাত, এনকেঢেলাইটিস, ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ও ব্রেন ইনফেকশন হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এ রোগ প্রতিরোধে দুই ডোজের ভ্যাকসিন অত্যন্ত কার্যকর। ১২ থেকে ১৫ মাস বয়সে এই টিকা শুরু করা যায়। তবে সরকার থেকে এসব টিকা দেওয়া হয় না, বাইরে থেকে রোগীকে কিনতে হয়। একবার এই রোগ হয়ে গেলে শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তাতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে।’ গর্ভবতী মা আক্রান্ত হলে গর্ভের সন্তানও ঝুঁকিতে থাকে বলেও জানান এই চিকিৎসক।
বিএসএমএমইউয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী আমাদের সময়কে বলেন, ‘সাধারণ বসন্তকালেই এই রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। আর আমাদের যে পরিবেশ, তাতে সবসময়ই জীবাণু সহজেই আক্রান্ত করতে পারে। এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় ভ্যাকসিন। কিন্তু সরকার অন্যান্য বহু রোগের টিকা বিনামূল্যে দিলেও চিকেন পক্সের টিকা তাদের কর্মসূচিতে নেই।’
তবে রোগটি সচরাচর না হওয়ায় সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম হাতে নেয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিনের বিষয়টিই হচ্ছে সর্বজনীন। চিকেন পক্স সেভাবে না হওয়ায় এর টিকা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় না। তারপরও কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা ইপিআই বলতে পারবে।’
নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সারাবছরই কমবেশি চিকেন পক্স হয়ে থাকে। অত্যধিক আকারে বাড়লে বিষয়টি নিয়ে আমরাও বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করি। আক্রান্ত হলে আইসোলেশনে থাকা জরুরি। তবে খুব বেশি জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যেতে হবে। এ রোগ ছোঁয়াচে হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’