কোভিড মহামারীর পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ থেকে প্রায় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও দেশে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের হার কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির খানা আয় ও ব্যয় জরিপ (২০২২) বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং হতদরিদ্রের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গতকাল বুধবার বিবিএস মিলনায়তনে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমসহ সংশ্লিষ্টরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সময়ে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ৭ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে।
কোভিড মহামারীর মধ্যে দেশে দারিদ্র্য হ্রাসের এই চিত্র আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন বিবিএসের কর্মকর্তারা। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নেওয়া নানা কর্মসূচির কারণে দেশে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের হার কমেছে। বিবিএস মনে করে, দারিদ্র্য বিমোচনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সালের মধ্যে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, দারিদ্র্য ২৪ থেকে ১৮ শতাংশে নামা একটি বিশাল অর্জন। বিশেষ করে মহামারী আর যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে এমন অর্জন বড় আনন্দের বিষয়। করোনার সময় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত আর ১০০ কোটি ডলারের বিভিন্ন প্যাকেজ এটা অর্জনে সহায়তা করেছে। আমরা উৎপাদন এবং চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করিনি। আর মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় মানুষকে সুলভ মূল্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। রমজানেও এক কোটি পরিবার সহায়তা পেয়েছে। নয়তো মূল্যস্ফীতি ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হয়ে যেতেও বলে মনে করছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের পর বিবিএস এ সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সংস্থাটি সর্বশেষ ‘হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬’ প্রকাশ করেছিল।
বর্তমান প্রতিবেদনে ছয় বছরের ব্যবধানে দেশের প্রতিটি পরিবারের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে বর্তমানে (২০২২) একটি পরিবারের মাসে গড় খরচ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, ২০১৬ সালে যা ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। এর আগে ২০১০ সালে প্রতি পরিবারের খরচ ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। অপরদিকে ২০২২ সালে খানাপ্রতি মাসিক আয় ছিল ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। মাসিক খরচ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ খানাপ্রতি মাসে এক হাজার টাকা সঞ্চয় হচ্ছে। ২০১৬ সালের জরিপে খানাপ্রতি মাসিক আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। সেই হিসেবে ছয় বছরের ব্যবধানে আয়ও দ্বিগুণ হয়েছে।
জরিপে খানার আয়ে দেখা যায়, গ্রামে একটি খানার গড় আয় ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। আর শহরে গড় আয় ৪৫ হাজার ৭৫৭ টাকা। যেখানে ২০১৬ সালে গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় ছিল ১৩ হাজার ৯৯৮ টাকা এবং শহরের একটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২২ হাজার ৬০০ টাকা। খানার ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, ২০২২ সালে গ্রামে একটি খানার মাসিক গড় ব্যয় ২৬ হাজার ৮৪২ টাকা এবং শহরের একটি খানার মাসিক গড় ব্যয় ৪১ হাজার ৪২৪ টাকা। যেখানে ২০১৬ সালে গ্রামে একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় ছিল ১৪ হাজার ১৫৫ টাকা এবং শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় ছিল ১৯ হাজার ৬৯৭ টাকা। জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে খানাভিত্তিক ভোগ্যপণ্য বাবদ একটি খানার গড় ব্যয় ৩০ হাজার ৬০৩ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৪২০ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের একটি খানার মাসিক ভোগ্যপণ্য ব্যয় ২৬ হাজার ২০৭ টাকা এবং শহরের একটি খানার গড় ব্যয় ৩৯ হাজার ৯৭১ টাকা।
অপরদিকে ২০২২ সালে একটি খানার খাদ্যবহির্ভূত ভোগ ব্যয় ১৪ হাজার ৩ টাকা। ২০১৬ সালে একটি খানার খাদ্যবহির্ভূত গড় ভোগ ব্যয় ছিল ৭ হাজার ৩৫৪ টাকা। যার মধ্যে গ্রামের একটি খানার মাসিক গড় ব্যয় ১৩ হাজার ১২৫ টাকা। এবং শহরের একটি খানার গড় ব্যয় ১৫ হাজার ৮৭৫ টাকা।
২০২২ সালে আগের তুলনায় আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। বর্তমানে গড় আয় বৈষম্য ছিল দশমিক ৪৯৯ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের জরিপে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২ শতাংশ। আগের জরিপের তুলনায় ভোগের বৈষম্য বেড়েছে। ২০১৬ সালে ভোগ বৈষম্য ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪ শতাংশ। ২০২২ সালে ভোগ বৈষম্য শূন্য দশমিক ৩৩৪ শতাংশ।
বৈষম্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। বৈষম্য হ্রাস আর দারিদ্র্য দূরীকরণকে প্রধান সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন তিনি। বৈষম্য রোধে উন্নয়নের নামে বালু মহল, মাছ মহল, পানি মহল ইজারা দেওয়া বন্ধ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
বৈষম্য খুব বেশি বাড়েনি বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, গত ১৪ বছর বৈষম্য স্থির আছে।
দেশের ৭২০টি নমুনা এলাকায় এ জরিপ হয়। প্রতিটি নমুনা এলাকা থেকে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ২০টি করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপের প্রশ্নপত্রে মোট ১০টি সেকশন রয়েছে। এ ১০টি সেকশনের তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন তথ্য সংগ্রহকারী প্রতিটি খানায় ১০ বার পরিদর্শন করেন। জরিপ পরিচালনার সময়কাল ছিল ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে শুরু হয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সময়ে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, খানায় খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ব্যয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে। খানার খাদ্যপণ্য ক্রয়সংক্রান্ত ব্যয়ের তুলনায় খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ভোগ্যপণ্য সম্পর্কিত ব্যয় বেড়েছে।
জরিপের তথ্য-উপাত্তের ধারা বিশ্লেষণে দেখা যায়, খানার খাদ্যপণ্য কেনা সংক্রান্ত ব্যয় ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ভোগ্যপণ্য সম্পর্কিত ব্যয় ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৬ সালে যা ছিল যথাক্রমে খাদ্যপণ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ।
এ থেকে দেখা যায়, একটি পরিবারে যে আয় হয়, তার প্রায় অর্ধেকই (৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ) চলে যায় খাদ্যপণ্য কিনতে। তবে ২০১৬ সালের তুলনায় এটি কমেছে। তখন খাদ্যপণ্যে খরচ হতো ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ। অপরদিকে বর্তমানে (২০২২ সাল) খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ব্যয় (৫৪ দশমিক ২ শতাংশ) খাদ্যপণ্য কেনা সংক্রান্ত ব্যয়ের থেকে বেশি। ২০১৬ সালে যা ছিল ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় বছরে খাদ্যদ্রব্য বহির্ভূত ভোগ্যপণ্যের পেছনে খরচ ১ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে।
অপরদিকে জরিপ থেকে আরও জানা গেছে, জনপ্রতি দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ইতিবাচকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে জনপ্রতি ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ দৈনিক ২ হাজার ৩৯৩ কিলোক্যালরি, যা ২০১৬ সালে ছিল দুই হাজার ২১০ কিলো ক্যালরি। এর আগে ২০১০ সালে জনপ্রতি দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩১৮ দশমিক ৩ কিলো ক্যালরি।
বিবিএসের জরিপের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ৭ বছর ও তার ঊর্ধ্বে বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ, যা ২০১৬ ও ২০১০ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৫৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ সাক্ষরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের জরিপে দেখা যায়, আয়ের জন্য গিনি সহগের মান দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল দশমিক ৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৪৫৮। এতে দেখা যায়, বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে ভোগ ব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান দশমিক ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল দশমিক ৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৩২১।
প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থায় খানার (পরিবার) অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে বর্তমানে প্রায় ১৪ দশমিক ১ শতাংশ খানার (পরিবার) অন্তত একজন সদস্য জরিপের আগের ১২ মাসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, যা ২০১৬ সাল (৭ দশমিক ৫ শতাংশ) ও ২০১০ সালের (৭ দশমিক ৪ শতাংশ) তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থায় খানার অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের ৯২ দশমিক ৩২ শতাংশ মানুষই উন্নত টয়লেট ব্যবহার করে। ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ খানা অনুন্নত টয়লেট ব্যবহার করে। আর দশমিক ৬৯ শতাংশ খানা উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করে।
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার অগ্রগামিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে খানার আয় ও ব্যয় জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী খানার শতকরা হার ৯৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা ২০১৬ ও ২০১০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ৯২ শতাংশ ও ৫৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে বিদ্যুতায়নের হার শতকরা শতভাগ। পাশাপাশি সাক্ষরতার হার বেড়ে ৭৪ শতাংশ হয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, খাবার পানির উৎস হিসেবে সাপ্লাই পানির ওপর নির্ভরশীল ১৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ। ৭৬ দশমিক ৮১ শতাংশ ব্যবহার করে টিউবয়েলের পানি। ৩ দশমিক ৫ শতাংশ খানা পানির উৎস হিসেবে পুকুর নদী খাল বিল কুয়ার পানি ব্যবহার করে। যেখানে ২০১৬ সালে ১২ দশমিক ১ শতাংশ সাপ্লাইয়ের পানি, ৮৫ দশমিক ১৮ শতাংশ টিউবয়েলের পানি এবং ২ দশমিক ৮১ শতাংশ অন্যান্য উৎস থেকে পানি ব্যবহার করত।