আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় সিদ্ধান্ত

৫ সিটিতে নৌকার প্রার্থী হলেন যারা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৩৫

আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজেদের মেয়রপ্রার্থী চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, বরিশালে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত, খুলনায় তালুকদার আব্দুল খালেক, রাজশাহীতে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও গাজীপুরে আজমতউল্লাহ খান নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। গতকাল শনিবার দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ পাঁচজনের নাম চূড়ান্ত হয়। সভার পর দলের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের নাম জানানো হয়।
গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা শুরু হয় গতকাল বেলা ১১টায়। চলে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। সভায় আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, কাজী জাফরউল্লাহ, ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) মুহাম্মদ ফারুক খান, মো. রাশিদুল আলম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও ড. আবদুস সোবহান গোলাপ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে পাঁচ সিটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পর নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়া এবং নতুন মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বরিশালে সাদিক আবদুল্লাহ ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ডের জন্য মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। সে জায়গায় তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে
খোকন সেরনিয়াবাত আওয়ামী রাজনীতির স্বীকৃতি পেলেন। অন্যদিকে গাজীপুরে তুলনামূলকভাবে ‘শিক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন’ ব্যক্তি আজমতউল্লাহ খানকে খুঁজে নিয়েছে আওয়ামী লীগÑ এমনটাই কেন্দ্রীয় নেতাদের ভাষ্য। সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগে চ্যালেঞ্জিং রাজনীতির স্বীকৃতি পেলেন। খুলনা ও রাজশাহীতে বিগত দিনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফের মনোনয়ন পেলেন যথাক্রমে তালুকদার আবদুল খালেক ও এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
গত সিটি নির্বাচনে সিলেট থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাবেক মেয়র প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান। ২০২০ সালের ১৫ জুন মারা যান সিলেট আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট এই নেতা। তার পরিবর্তে এবার নৌকার মাঝি হলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, তিনি স্থানীয় সব নেতাকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচন করবেন। আর জিতলে সবার সহায়তা ও পরামর্শ নিয়ে শহর গোছাবেন।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগে এত দিন প্রকাশ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও বিভেদ দেখা যায়নি। মহানগর আওয়ামী লীগ ও নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের কমিটিগুলো বর্তমান মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছিলেন। সে জন্য অন্য কেউ মনোনয়ন চাইবেন, এমনটা ভাবার সুযোগ ছিল না। ফলে এত দিন ধরে নেওয়া হয়েছিল, আগামী সিটি নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহই এখানে একক প্রার্থী। কিন্তু তফসিল ঘোষণার আগেই এই সিটি করপোরেশনে মনোনয়ন পেতে মাঠে নামেন সাদিক আবদুল্লাহর ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার ইতি হয়েছে তাকে দলের মনোনয়ন দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন না পাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই বলছেন, তিনি গত পাঁচ বছর শহরবাসীকে অবমূল্যায়ন করেছেন। সাদিক আবদুল্লাহ বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা ভুলে গিয়েছিলেন। করপোরেশন অফিসে নিয়মিত অফিসও করেননি।
কেউ কেউ বলছেন, ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা-ভাঙচুর এবং ২০২২ সালে ১৭ অক্টোবর ইউএনওর সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন। এসব ঘটনাও প্রভাব ফেলেছে। কাউন্সিলরদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল না তার।
বরিশাল মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক নিজামুল ইসলাম নিজাম বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে এ শহরের কোনো সম্মানিত ব্যক্তি ইজ্জতের সঙ্গে বসবাস করতে পারেননি। মেয়রের হাতে লাঞ্ছিত হননিÑ এমন নেতাকর্মীর সংখ্যা খুবই কম।’
মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া হিসেবে খোকন সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। উন্নত আধুনিক বরিশাল নগর গড়তে চাই। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই।’ মনোনয়ন ঘোষণার পর বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগমের ছোট ছেলে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। তিনি বর্ষীয়ান নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ভাই ও বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ছোট চাচা।
জানা গেছে, আড়ালে থাকা ‘ব্যক্তিত্ব’ খোকন সেরনিয়াবাতের দলে কোনো পদ-পদবি নেই। সাবেক সংসদ সদস্য ও সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর প্রথম মহানগর আওয়ামী লীগের শোকসভা ও দোয়া-মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এখন মাঝেমধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করেন।
এদিকে আজমতউল্লাহ খান ছিলেন টঙ্গী পৌরসভার তিন বারের নির্বাচিত মেয়র। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটিতে আওয়ামী লীগের ‘একক প্রার্থী’ ছিলেন তিনি। কিন্তু বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। পরের বার আর দল থেকে সবুজ সংকেত পাননি। মনোনয়ন পান জাহাঙ্গীর আলম। তবে থেমে যাননি আজমত। নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি রাজনীতির মাঠে ছিলেন সক্রিয়। হঠাৎ করে জাহাঙ্গীর আলম বিতর্কিত হয়ে পড়লে আলোচনায় চলে আসেন আজমতউল্লাহ খান।
২০১৩ সালে প্রথম সিটি নির্বাচনের সময় মনোনয়ন নিয়ে আজমতউল্লাহ খান ও জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে দ্বৈরথ শুরু হয়। জাহাঙ্গীরের বিরোধে আজমতউল্লাহর পরাজয়ের কথাও বলেছিল অনেকেই। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দলেও। ২০১৫ সালে আজমতউল্লাহ খান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাহাঙ্গীর আলম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে জাহাঙ্গীর আলমের একটি বিতর্কিত অডিও ভিডিও ক্লিপ নিয়ে সরব হয় আজমতউল্লাহর সমর্থকরা। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলনে নেমে নানা কর্মসূচি পালন করে এ ঘটনা আলোচনায় আনেন। পরে জাহাঙ্গীর আলমকে দল ও মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। ক্ষমা চাওয়ায় জাহাঙ্গীর আলমকে এ বছর দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এদিকে গত বছরের ১৯ নভেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আজমতউল্লাহ পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। সে কমিটির কোথাও জাহাঙ্গীর সমর্থকদের জায়গা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেন। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ারও চাপ বাড়ছে জাহাঙ্গীর আলমের ওপর। কেন্দ্র যদি কোনোভাবে তাকে নিবৃত্ত না করে, তা হলে জাহাঙ্গীর আলম যে আবারও নির্বাচন করবেন, তা অনেকটা নিশ্চিত।
মনোনয়ন না পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মহানগরে তার বিপুল কর্মী-সমর্থক রয়েছে। তারা যদি মনে করেন তার নির্বাচন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা হলে তিনি তা ভেবে দেখবেন।
আজমতউল্লাহ খান দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, এবার সিটি নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী। আর দলের কেউ যদি নির্বাচন করেন, সে বিষয়ে দল দেখবে।
খুলনা ও রাজশাহীতে তেমন চ্যালেঞ্জ না থাকলেও সিলেটে ‘খেলা’ এখনো বাকি আছে বলে অনেকে মনে করছেন।
তফসিল অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট হবে ২৫ মে। খুলনা ও বরিশাল সিটিতে হবে ১২ জুন। ২১ জুন ভোট হবে রাজশাহী ও সিলেটে।