রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে কাপড়ের মার্কেট, অ্যামব্রয়ডারি কিংবা দর্জির দোকানে আগুন লাগার ঘটনাই বেশি দেখা যাচ্ছে। গত ১০ দিনের ব্যবধানে রাজধানীর চারটি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটিই রাজধানীর জনপ্রিয় কাপড়ের মার্কেট। সবগুলোতেই ঈদের বাজারের পোশাক পুড়ে যাওয়ার গল্প।
এছাড়া গত মাসে দুটি বড় বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় হতাহত এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এসব ঘটনার পেছনে কোনও নাশকতা আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
শনিবার (১৫ এপ্রিল) ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে আবারও আগুন লাগে রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটের তিন তলায়। টানা ৩ ঘণ্টা আগুন জ্বলে মার্কেটটিতে। ফায়ার সার্ভিসের ৩০ ইউনিট, সেনাবাহিনী, বিজিবি, নৌ-বাহিনী, আনসার, পুলিশ, র্যাব, সিআইডি এবং সেচ্ছাসেবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় সকাল ৯টা ১০মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে সন্ধ্যা পর্যন্তও আগুন পুরোপুরি নির্বাপন করা সম্ভব হয়নি।
নিউ সুপার মার্কেটের তিন তলায় মিম এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্লাস্টিকসামগ্রীর দোকান ছিল মো. মিজানের। শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরেছিলেন তিনি। সেহরি খেয়ে ভোর হওয়ার আগেই খবর পান, মার্কেটে আগুন লেগেছে। দ্রুত এসে দেখেন, তার দোকান আগুনে জ্বলছে।
তিনি বলেন, ‘তিনতলায় আমার প্লাস্টিকের গুদাম। ৪০ লাখ টাকার মালামাল ছিল, একটি সুতাও বের করতে পারিনি। আগুনে সব পুড়ে গেছে। ২০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ আছে, কর্মচারী আছে ১৩ জন। আমি কীভাবে কী করবো! প্লাস্টিকের পানির বোতল, জগ, বাটি– এসব আমার কাছ থেকে পাইকারী হিসেবে নেয় আশেপাশের ব্যবসায়ীরা। ঈদের জন্য মাল তুলেছিলাম। ঈদের আগে একের পর এক ব্যবসায়ীদেরই এমন সর্বনাশ হচ্ছে কেন?’
দোকানের কর্মচারী উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘মিম এন্টারপ্রাইজে গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করছি। দৈনিক হাজিরা দিয়ে মজুরি নেই। দুই দিন পরই ঈদের বোনাস পেতাম। এর মধ্যে কী হয়ে গেল। আমার আয়ে সংসার চলে। আমাদের জন্য এতো আগুন কোথায় থেকে আসে? শুধু মার্কেটেই আগুন লাগে, তাও ঈদের আগে।’
তিন তলার আরেকটি দোকানে ছেলেদের টি-শার্ট, প্যান্ট বিক্রি করতেন ইমন। মিজানের মতো আগুনে সব হারিয়েছেন তিনিও। আগুন লাগার খবর পেয়ে তার সব কর্মচারীকে ডেকে এনে ওপর থেকে মালামাল নামানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে খুব একটা কাজ হয়নি। সামন্য কিছু সরিয়ে নিতে পেরেছেন। সরিয়ে নেওয়া মালামাল নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য ছুটোছুটি করছেন ইমন।
তার দোকানের কর্মচারী সুমন বলেন, ‘রাত আড়াইটা পর্যন্ত দোকানে ছিলাম। সকাল ৭টায় মালিক ফোন করে দ্রুত মার্কেটে আসতে বলেন। এসে দেখি, আমাদের দোকান আগুনে জ্বলছে। আমাদের দোকানে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মাল ছিল। দুই-একটা বস্তা ছাড়া আর কিছুই নামাইতে পারি নাই। ঈদের কয়েকদিন আগে আমাদের এমন বিপদ আসবে বুঝতে পারিনি। পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম বোনাস-বেতন নিয়ে বাড়ি যাবো। এখন মালিকেরই তো কিছু রইলো না, আমাদের কী দেবে।’
ওই মার্কেটের নিচতলার জুতার ব্যবসায়ী তারেক রহমান বলেন, ‘মার্কেট থেকে বাসায় যাই রাত ৩টার দিকে। বিশ্বাস হচ্ছে না, আগুনে এভাবে সব জ্বলে গেছে। দেখা গেছি, ওভারব্রিজের মাথায় কাজ চলছে। ওখান থেকে কোনও আগুনের সূত্রপাত হয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করা দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কিছু ঋণ ছিল। এবার ঈদের বাজারটা শেষ পর্যন্ত ধরতে পারলে ঋণগুলো পরিশোধ করতে পারতাম। হঠাৎ এমন আগুন সব অনিশ্চিত করে দিল।’
এদিকে ব্যবসায়ী নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, মার্কেটটিতে দেড় হাজারের ওপরে দোকান আছে। সবই ক্ষতিকগ্রস্ত হয়েছে। তিনতলায় আগুন লাগলেও প্রচুর পানি দেওয়ার নিচের দোকানগুলোর মালামালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
নিউ সুপার মার্কেট পরিদর্শনে এসে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটছে রাজধানীতে। ঈদের আগ মুহূর্ত হওয়ায় এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বারবার একই ধরনের ঘটনার পেছনে কোনও নাশকতা রয়েছে কিনা তা গোয়েন্দা সংস্থাকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানানো হয়েছে।’
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এরই মধ্যে এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হয়েছে। শনিবার (১৫ এপ্রিল) বিকালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনাই খতিয়ে দেখছে পুলিশ।’ কোনও নাশকতার ঘটনা থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক।