দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে চুয়াডাঙ্গার জনজীবন। গত ১৩ এপ্রিল থেকে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে টানা তীব্র তাপপ্রবাহ। দেশের মধ্যে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি দাপট দেখাচ্ছে এ জেলায়। প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাপমাত্রার পারদ। বেলা যত বাড়ছে রোদের তীব্রতা যেন ততই আগুনের ফুলকির মতো ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুনঝরা রোদের তেজে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ছে। আর এ অবস্থায় হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। তাই অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দফায় দফায় শহরের অলিগলি, গ্রামগঞ্জে মাইকিং করে মানুষকে সতর্ক করা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন থেকেও দেওয়া হচ্ছে সতর্ক বার্তা। কৃষি অধিদপ্তর বলছে- এমন তাপদাহ আরও কয়েক দিন চলতে থাকলে ধান, সবজি ও ফলের উৎপাদন কমে যাবে।
চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রবিবার সকাল ৯টায় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি থাকলেও দুপুর ১২টায় তাপমাত্রার পারদ ৪১ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। বেলা ৩টায় সর্বশেষ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৪ শতাংশ। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী খুব সহসায় বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা নেই এ জেলায়।
চুয়াডাঙ্গার আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান বলেন, শনিবার বেলা ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রবিবার বেলা ৩টায় রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি। সীমান্তবর্তী জেলায় প্রথম মৃদু তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় গত ৪ এপ্রিল ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর ৮ এপ্রিল তাপমাত্রার পারদ বেড়ে মাঝারিতে পৌঁছায়। ১৩ এপ্রিল থেকে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ, এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৫ শতাংশ।
চুয়াডাঙ্গার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাবদাহে কৃষিতে প্রভাব পড়েছে। ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। ফলে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সবজির পাতা পুড়ে যাচ্ছে ও মাথা নুয়ে যাচ্ছে। আমের গুটি শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। এ তাপদাহ চলতে থাকলে ধান, সবজি ও ফল উৎপাদন কমে যাবে।
দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হেলেনা আক্তার নিপা বলেন, এবারের গরম একটু ভিন্ন রকম। বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকায় ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। গলা-বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের জলীয়বাষ্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে। তীব্র গরমে হার্টের রোগীরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি। পর্যাপ্ত পানি পান, খাওয়ার স্যালাইন, লেবুর শরবতের পাশাপাশি তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। রোদ্রে ছাতা ছাড়া বের হওয়া উচিত নয়।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান বলেন, তীব্র তাপদাহে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে বের না হতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রোজাদারদের সন্ধ্যার পর থেকে বেশি বেশি পানি ও ফলমূল খেতে বলা হচ্ছে। শিশু, কিশোর ও যারা রোজা থাকছেন না তাদের ঘন ঘন পানি ও শরবত পান করতে হবে।
এদিকে চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালক ও কৃষকরা। তীব্র রোদে মাঠে টিকতে পারছেন না কৃষক ও দিনমজুর। রাস্তায় যাত্রী পাচ্ছেন না রিকশা-ভ্যানচালকরা।
ভ্যানচালক ছাদেক আলী বলেন, দুপুর বেলা মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না।
দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম ধান, মিষ্টিকুমড়া, করলা, হলুদ ও তরমুজ চাষ করেছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহের কারণে এসব জমিতে সেচ দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, দুবেলা শ্যালো মেশিন চালাতে হচ্ছে। আর পারছি না। মাঝে মাঝে পানি দিচ্ছি আবার গাছতলায় এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি।
চুয়াডাঙ্গা শহরের অদূরে ঘোড়ামারা ব্রিজের কাছে বাড়ি বদর উদ্দিনের। আধা বিঘা জমিতে আখ লাগিয়েছেন। আখের চারপাশে আগাছা জন্মেছে। কিন্তু বেশ কদিন থেকে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সেগুলো পরিষ্কার করার মতো শ্রমিক পাচ্ছেন না। তাই নিরুপায় হয়ে তাকেই কোদাল ধরে আগাছা পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এ কাজ করতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছেন তিনি।
প্রায় একই দশা শহরের কোর্ট এলাকায় রিকশাচালক সাবান আলীর। তিনি বলেন, এমনিতেই রোজার মাসে রিকশার যাত্রী একটু কম হয়। এ কারণে সংসার খরচ মেটানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে গরমে আরও অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হয় না। যাত্রী একেবারে নেই বললেই চলে।