স্পিকার হিসেবে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর ১০ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ রবিবার (৩০ এপ্রিল)। দেশের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ও প্রথম নারী স্পিকার ড. শিরীন শারমিন ইতোমধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের রেকর্ড করেছেন। চলতি মেয়াদে তার আরও ৯ মাস দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে। দায়িত্ব পালনের ১০ বছর পূর্তিতে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন তিনি সংবিধান ও আইনের মধ্যে থেকে সংসদ পরিচালনা করেছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের কথা বলার সর্বোচ্চ সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে সচেতন ও সজাগ থেকেছেন। নিরুৎসাহিত করেছেন কথা বলার সময় মাইক বন্ধ করে দেওয়াকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল নবম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ৪৬ বছর বয়সে তিনি সর্বকনিষ্ঠ স্পিকার হিসেবে অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের (সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতি) স্থলাভিষিক্ত হন। এরপর দশম ও চলতি একাদশ জাতীয় সংসদেও তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন।
স্পিকার হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ তিন টার্ম ও টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের ১১ জন স্পিকারের মধ্যে শিরীন শারমিনের আগে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বেশিদিন দায়িত্ব পালনের রেকর্ড ছিল। জমির উদ্দিন সরকার ৭ বছর ১৪ দিন স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ওয়ান ইলেভেনের সময়কালে ২ বছর তিনি স্পিকার থাকলেও ওই সময় সংসদ ছিল নিষ্ক্রিয়। অন্যান্য স্পিকারের মধ্যে শামসুল হুদা চৌধুরী দুই টার্মে চার বছর ৯ মাস, শেখ রাজ্জাক আলী দুই টার্মে ৪ বছর ৯ মাস, শাহ আবদুল হামিদ (দেশের প্রথম স্পিকার) এক মাসেরও কম, মুহম্মদ উল্লাহ ১০ মাস, মালেক উকিল ৯ মাস, মির্জা গোলাম হাফিজ ৩ বছর, আব্দুর রহমান বিশ্বাস ৮ মাস, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ৫ বছর, অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ দুই টার্মে সাড়ে ৪ বছর এবং ভারপ্রাপ্ত স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী আড়াই মাস দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার আগে শিরীন শারমিন চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শিরীন শারমিন সংরক্ষিত আসনে মহিলা এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে রংপুর-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
ব্যক্তিগতভাবে আইন পেশার সাথে যুক্ত শিরীন শারমিন ২০০৯ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে দলটি তাকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত করে। তবে স্পিকার হওয়ার আগে তিনি দলীয় পদ থেতে পদত্যাগ করেন। তিনি ২০০৮-২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন মামলার প্যানেল আইনজীবী ছিলেন।
১৯৬৬ সালের ৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণকারী শিরীন শারমিন চৌধুরী তুখোড় মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা বোর্ডে থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার এবং ১৯৮৫ সালে এইচএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তিনি একজন কমনওয়েলথ স্কলার। ২০০০ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পিএইচডি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকার। তিনি প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৪ সালে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
শিরীন শারমিন রাষ্ট্রে স্পিকারের দায়িত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, সাংবিধানিক এই উচ্চ পদে প্রথমবারের মতো নারী ও সর্বকনিষ্ঠ স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটিয়ে দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করেছেন।
দায়িত্ব পালনে তিনি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশাপূরণে সব সময় সচেতন ও সজাগ থেকে সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধির আলোকে সংসদ পরিচালনা করেছেন উল্লেখ করে বলেন, ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার দ্বারা সংসদ পরিচালিত না হয়—এসব ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। অনেক ধরনের চাপ স্পিকার অনুভব করে। সেই চাপ সহ্য করে নিয়ে ব্যালেন্স করতে হয়।
তিনি বলেন, অনেক সময় বিরোধীদল কোনও প্রসঙ্গে কথা বললে সরকারি দলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। সরকারি দলের চাপে বা চিৎকারে ভীত হওয়া—একজন স্পিকার হিসেবে সুযোগ নেই। সংখ্যালঘু হিসেবে তাকেই প্রটেকশন দিতে হয়।
স্পিকার জানান, জাতীয় সংসদ পরিচালনায় সকল সংসদ সদস্যের যতখানি সময় পাওয়ার প্রয়োজন আছে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ আছে সেগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সংসদ সঠিকভাবে কার্যকর থাকে। বিরোধীদলকে যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে—তাদের কথাগুলো বলার, তাদের বিষয়গুলো উপস্থাপন করার তাহলে তাদের ভেতর কোনও অসন্তোষ তৈরি হবে না। সংসদ বর্জন করা বা সংসদ বয়কট করার প্রয়োজন হবে না।
ড. শিরীন বলেন, সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনাকে আরও বেশি সুযোগ দিতে বিরোধী দলকে যত সম্ভব বেশি সময় দেওয়া যায়—সেই বিষয়ে সচেষ্ট ছিলাম। বিরোধী দল যাতে সংসদে এসে কথা বলতে পারে। তাদের মাইক বন্ধ করে দেওয়ার মতো প্রাকটিসকে আমি উৎসাহিত করিনি। মনে করি একজন জনপ্রতিনিধি সংসদে এসেছেন মানুষের কথা বলতে। তার নির্বাচনি এলাকার মানুষের চাওয়া-পাওয়া সমস্যাসহ সব বিষয় সংসদে তুলে ধরার জন্য। কাজেই তাদের মাইক অফ করে দেওয়ার কালচার গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না, অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়। সেই কারণে সময়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সবাইকে অংশগ্রহণে যতখানি সুযোগ দেওয়া সম্ভব—আমি সেটা চেষ্টা করেছি।
স্পিকারের বিশেষ কিছু দায়িত্ব আছে এবং তাকে খুব সচেতনভাবে তা পালন করতে হয় উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, হাউজে ৩৫০ জন মানুষ থাকেন। প্রত্যেকেই একজন রাজনীতিবিদ এবং প্রত্যেকেরই একটি নির্বাচনি এলাকা রয়েছে। নিজ জনগণের কাছে তাদের একটি কমিটমেন্ট আছে। কাজেই তাকে সেই সম্মানটা হাউজের ফ্লোরে দেখাতে হয়। কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা উপেক্ষা করে কাউকে বসিয়ে দিলে তা বায়াসড হয়ে যায়। এটা হলে সদস্যরা কিন্তু আস্থা হারাবে। আপনি স্পিকার সর্বময় ক্ষমতা এক্সারসাইজ করেন—কিন্তু সেটির একটি ব্যাল্যান্স, একটা অ্যাপ্রোচ থাকতে হবে। এবং যাতে কোনও সংসদ সদস্যকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত না করি। এভাবে অনেক ব্যালেন্সিংয়ের জায়গা স্পিকারকে বুঝতে হয়।
তিনি সংসদকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত রেখে সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সংসদ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান।
টানা ১০ বছর স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালনে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সব সংসদ সদস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।