ভারী বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রেললাইন পানির নিচে, পাবনায় যান চলাচল বন্ধ, রাঙামাটিতে সতর্কতা জারি
ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১৩

দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। লালমনিরহাটে তিস্তার চরে ভেসে এসেছে আরও দুই লাশ। তলিয়ে গেছে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটের রেললাইন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস মোড়ে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকায় বিঘœ ঘটছে যান চলাচলে। স্মরণকালের ভয়াবহ বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে ময়মনসিংহ মহানগরী। টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে সাতক্ষীরার চার উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। ১০ বছরে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে রাজশাহীতে। সিরাজগঞ্জে ভারী বর্ষণে বাড়ছে যমুনার পানি। বগুড়ায়ও নদনদীর পানি বাড়ছে। জেলার শেরপুরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২ হাজার পরিবার। পাবনার সাঁথিয়ায় ভারী বর্ষণে সড়ক ধসে গেছে। বন্ধ হয়ে পড়েছে যান চলাচল। রাঙামাটির সংযোগ বাঁধ ধসে বিলীন হওয়ার শঙ্কায় লাল পতাকা উড়িয়ে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে পানি কমলেও ভাঙন-আতঙ্কে রয়েছেন তিস্তাপারের মানুষ। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
লালমনিরহাট : সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ এলাকার তিস্তা নদীর চর থেকে অজ্ঞাত দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল বেলা ১১টায় সদর উপজেলার খুনিয়াগাছের তিস্তা নদীর কালমাটি চরে লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে আরও এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, লাশ দুটি সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এদিকে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, জেলার কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙছে তিস্তা।
কিশোরগঞ্জ : টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জ   পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষের ঘরে ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। বৃষ্টিতে ঘরবন্দি মানুষ। ডুবে গেছে অনেকের মৎস্য, হাঁস-মুরগি ও কৃষি খামার। কিশোরগঞ্জ শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়-সংলগ্ন রেললাইনের কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনের মাস্টার মিজানুর রহমান। একাধিক শহরবাসী জানান, অপরিকল্পিত ও নি¤œমানের উন্নয়নকাজ, নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করা, অপরিকল্পিত ভবন, রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে জেলার অনেক এলাকায় মৎস্য, হাঁস-মুরগি ও কৃষি খামার ডুবে গেছে।
পাবনা : সাঁথিয়ায় ধসে গেছে কাশিনাথপুর রেলস্টেশনের সংযোগ সড়ক। এই সড়ক দিয়ে ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের যাতায়াত বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। পাবনা শহরের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। পাবনা সদর গোরস্থানও তলিয়ে গেছে।
রাঙামাটি : টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে হুমকিতে পড়েছে রাঙামাটি শহরের সংযোগ সড়ক বাঁধ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তলিয়ে যাচ্ছে হ্রদ-তীরবর্তী নি¤œাঞ্চল। প্লাবিত হচ্ছে বসতঘর ও ফসলি জমি। ঝুঁকিতে পড়েছে জেলা শহরের সঙ্গে একমাত্র সংযোগ সড়ক বাঁধটিও। বাঁধের ওপর লাল পতাকা উড়িয়ে সতর্কতা জারি করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
ময়মনসিংহ : স্মরণকালের ভয়াবহ বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ নগরীর বেশির ভাগ সড়ক। অনেক এলাকায় বাসাবাড়িতেও উঠেছে পানি। অনেকের রাত কেটেছে নির্ঘুম। টানা অঝোর বর্ষণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সরকারি হাসপাতাল, বাসাবাড়ি, বিপণিবিতানে পানি ঢুকে ব্যাপক দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া তলিয়ে গেছে ধানখেত, ভেসে গেছে পুকুর-ঘেরের মাছ।
জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিরা। ১৩ উপজেলায় প্রচুর ফিশারি তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়া প্রতি উপজেলায় অনেক ধানখেত তলিয়ে গেছে।
গাজীপুর : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস মোড়ে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত যানজটের কবলে পড়ে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ ছাড়া আঞ্চলিক সংযোগ সড়ক ও বসতবাড়ি এবং মার্কেটে পানি ঢুকে পড়েছে। নগরীর চান্দনা চৌরাস্তার পশ্চিম পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও বৃষ্টির পানি জমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে অচল হয়ে পড়ে যানবাহন। দেখা দেয় দীর্ঘ যানজট। ভোরে যানজট সালনা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার পৌরসভাসহ চারটি উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে ছোট বড় পুকুর ও মৎস্য ঘের। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে আছে। চরম দুর্ভোগের মধ্যে মানুষ চলাচল করছে।
রাজশাহী : রাজশাহীতে এক দিনের বৃষ্টিপাতে ১০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বুধবার বেলা ১টা থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ২৬০ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাঘাট জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। অনেক বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : গত কয়েক দিন ধরে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায়  সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩২ ও কাজিপুর পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এতে তৃতীয় দফায় যমুনার চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বগুড়া : বগুড়ার সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কিত নদীপাড়ের বাসিন্দারা। জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার ১৭৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও শুক্রবার প্রায় ৩২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। এ ছাড়া টানা বৃষ্টির ফলে পথচারীরা দুর্ভোগে পড়ে। এ ছাড়া জেলার শেরপুরে বিগত চারদিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঙালি ও করতোয়া নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পৌর শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডসহ উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাসাবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন ২ হাজার পরিবার। ওইসব পরিবার চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে।
রংপুর : তিস্তার পানি দুই দিন আগে বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও গতকাল  রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বিকাল ৩টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দুপুর ২টা  থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ৪ সেন্টিমিটার বাড়লেও কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ স্থিতিশীল ছিল।
গাইবান্ধা : বৃহস্পতিবার বিকালের পর থেকে কমতে শুরু করে পানি। এতে বন্যার শঙ্কা কাটলেও নদীপাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে ভাঙন নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
কুড়িগ্রাম : তিস্তা নদীর পানি বৃহস্পতিবার রাত থেকে কমতে শুরু করেছে। ফলে নি¤œাঞ্চল থেকে পানি সরে যেতে শুরু করেছে। তবে নদী অববাহিকায় প্রবল স্রোতে ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি পরগনা দিনারপুরে টিলা ধসে তিনটি ঘর ভেঙে গেছে। এ ঘটনায় তিন পরিবারের ১০ জন আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম দাস অনুপ। টিলা ধসের খবরে দিনারপুর পরগনার তিনটি ইউনিয়নের পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের মীরটিলার পাদদেশে টানা বৃষ্টির কারণে এ ঘটনা ঘটে। জেলার আজমিরীগঞ্জে তলিয়ে গেছে প্রায় ৪৭ একর আমন ধানের নিচু জমি। হঠাৎ করে আশ্বিনের এমন বৃষ্টিতে কষ্টের রোপণ করা আমন ধানের জমি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ছে কৃষক। জানা গেছে, এবার আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় মোট ৭ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে লাগানো হয়েছে আমন ধানের চারা। চারা লাগানোর পর থেকে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমেই বেড়ে উঠছিল সোনালি আমন ধান। কিন্তু হঠাৎ করেই টানা দুই দিনের বৃষ্টিপাত যেন সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে।