আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে দিনটি। আজ এ দিবসটি এমন সময় পালিত হচ্ছে, যখন চাল ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই ভাতে-মাছে বাঙালি করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাংস ও সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এছাড়া ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে।
১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির তৎকালীন খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. প্যাল রোমানি বিশ্বব্যাপী এই দিনটি উদযাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিকে (১৬ অক্টোবর, ১৯৪৫) বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালনের সিদ্দান্ত হয়। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবৃত্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এখন এই দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়ে থাকে।
এ বছর খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। বাংলাদেশে প্রতি বছর কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে এই দিনটি নানা কর্মশালা ও কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপন করে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য। এই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বর্তমান সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক কর্মসূচি। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেরও অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আমরা কী খাই, কীভাবে খাই, খাবারটা কোথা থেকে আসে, খাবারের মান কেমন, নিজেদের আয় এবং রুচি অনুযায়ী কী খেলে আমাদের শরীর ভালো থাকবে- এসব ভাবনা আমাদের জীবনযাপনের অন্যতম অংশ। তবে এই ভাবনাগুলোর সিংহভাগই আমাদের নিজের ও আপনজনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদের পুরো বিশ্বের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা জরুরি। ভবিষ্যতের অনাগত শিশু বা বর্তমান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, পৃথিবী নামের গ্রহটাই তাদের বসবাসের উপযোগী থাকবে কিনা, সেই প্রশ্নগুলোই আমাদের বর্তমান খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাধীনতাপরবর্তী ৫২ বছরে বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচগুণ। ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। এই সাফল্যের পাশাপাশি গত ১০ বছরে কৃষির বড় ধরনের বিবর্তন সূচিত হচ্ছে। একসময় বড় বিনিয়োগমুখী শিল্প হিসাবে মানুষ গার্মেন্টস কারখানা স্থাপন করেছে। অন্যান্য শিল্পে বেশি লাভ খুঁজেছে। এখন সেই বিনিয়োগকারীরাই কৃষিতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। গার্মেন্টস কারখানার শেডেই হয়তো গড়ে তুলছেন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি খামার।
সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদন বাড়ানোয় বড় ভূমিকা ইলিশের
খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ এখন প্রধান চার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাল, মাছ, মাংষ ও সবজি উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী দেশ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পোল্ট্রি শিল্পে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০০ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালে হাঁস-মুরগির শিল্পে উৎপাদন আয় ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। যা বেড়ে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিল জানিয়েছে, দেশের প্রায় ১ দশমিক ৬৫ লাখ মানুষ ডিম ও মাংস উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর দাবি করেছে, দেশে এখন মোট ৮১ হাজার ৬১৪টি পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির শরীরে দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা থাকে। ২০১৭ সালেই সে চাহিদা পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৫ লাখ টন সাদা ও লাল মাংস উৎপাদন করেছে। এখন তা আরও বেড়েছে। যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল ১২ দশমিক ৬০ লাখ টন। সে হিসাবে গত ১০ বছরে মাংস উৎপাদন প্রায় ছয়গুণ বেড়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ সালে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ফসলের উৎপাদনেও ধারাবাহিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
গত ১৫ বছরে ভুট্টা উৎপাদন বেড়ছে প্রায় ৯ গুণ, আলু ২ গুণ, ডাল ৪ গুণ, তেলবীজ ২.৫ গুণ ও সবজি ৮ গুণ। বাংলাদেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম।
২০০৮-০৯ সালে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন, যা ২০২২-২৩ সালে ৪ কোটি টনেরও বেশিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে গমের উৎপাদন ছিল ৮ লাখ ৪৯ হাজার টন, ২০২২-২৩ সালে ১১ লাখ ৭০ হাজার টন, ভুট্টা ছিল ৭ লাখ টন যা এখন ৬৪ লাখ টন, আলু ৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টন, সবজি ৩০ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টন।
গত ১৫ বছরে বৈরী পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯৯টি উন্নত বা উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ৭০৮টি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে ধানের জাত ৮০টি।
গত এক দশকে দেশে দুধ ও ডিমের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাৎসরিক হিসাব অনুযায়ী, প্রত্যেক মানুষের জন্য ১০৪টি ডিমের প্রয়োজন। তবে বর্তমানে এর বার্ষিক সরবরাহ ১০৩টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭১১ কোটি পিস। এখন তা দুই হাজার কোটি পিস ছাড়িয়েছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের শরীরে দৈনিক ২৫০ গ্রাম দুধের প্রয়োজন। এ হিসাব অনুযায়ী বাৎসরিক মোট ১ কোটি ৫২ লাখ টন দুধের উৎপাদন প্রয়োজন। গত অর্থবছরে মোট উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল মাত্র ২৩ লাখ টন।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা ছাড়াও বেসরকারি বিনিয়োগ দুগ্ধ খাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে দুধ আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে এখনোও, যদিও ১০ বছরে দুধের উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। ২০০৭ সালে সরকার জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতি চালু করে। তবে জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালার খসড়া ২০১৬ সালে চূড়ান্ত হয়। বর্তমানে পুরো দেশ জুড়ে প্রায় ৬৮ হাজার এর বেশি নিবন্ধিত দুগ্ধ খামার আছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানিয়েছে, খাদ্য উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করায় পুষ্টির ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে গবেষণা ইনস্টিটিউট। মাংসের তুলনায় দুধ ও ডিমের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটিকে আরও বেগবান করতে কাজ করছে ইনস্টিটিউট।
একটা সময় ছিল যখন খোলা পানির (খাল, বিল) মাছই স্থানীয় বাজারে পাওয়া যেত বেশি। তবে বর্তমানে দেশীয় বাজারের ৫৬ শতাংশ দখল করে আছে চাষ করা মাছ। মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৪৩ লাখ টন মাছ উৎপাদন করা হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ টন। বর্তমানে তা বেড়ে ৫৪ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ খোলা মৎস্য চাষে তৃতীয় ও অভ্যন্তরীণ চাষ করা মৎস্য সংস্কৃতিতে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাদেশ। দৈনিক একজন মানুষের শরীরে ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদা থাকে। তবে সরবরাহ হয় ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। গত দুই বছরে সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনে মূল ভূমিকা পালন করছে ইলিশ মাছ। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দেশে ৪ দশমিক ৯৮ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন হয়েছে। পরবর্তী অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে ৫ দশমিক ১৭ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এ বছর তা ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ চাল ও শাকসবজি উৎপাদনে কয়েক বছর আগেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৮৬ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক ফলনের ফলে এ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল ৩ দশমিক ৩৮ কোটি টন। দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ দশমিক ৫ কোটি টন।
কৃষিমন্ত্রী ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, গত ১০ বছরে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। চাল, শাকসবজি ও শস্য উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে এর কিছু রফতানিও করা হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য রফতানি করতে সক্ষম হওয়া দেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। পেঁয়াজ উৎপাদনে এখনও ঘাটতি রয়েছে। তবে আমরা সেখানেও স্বনির্ভরতা অর্জন করবো।