নিয়োগ বাণিজ্যের ফাঁদে খুকৃবির ৭৩ শিক্ষক 

শিক্ষকদের আন্দোলন-কর্মসূচি অব্যাহত
খুলনা সংবাদদাতা
  ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:০৯

প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খানের নিয়োগ বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছেন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) ৭৩ জন শিক্ষক। এই শিক্ষকদের নিয়োগের বৈধতা যাচাই সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে চাকরির অনিশ্চয়তায় উল্লেখিত শিক্ষকরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। 
এদিকে, ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা দ্রুত সমাধানের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন-কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে সোমবার (১৬ অক্টোবর) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ডিন ও বিভাগীয় অফিসের কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। 
এর আগে, নিয়োগ বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খানের পরিবারের ৯ সদস্যসহ ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মো. মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশনাপত্র গত বছরের ৩ আগস্ট প্রেরণ করা হয়। যদিও গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ভিসি হিসেবে শহীদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয়।
খুকৃবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান জানান, সমস্যার প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ১১ মাস স্থগিত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ জন প্রভাষকের পর্যায়োন্নয়ন (আপগ্রেডেশন)। কয়েকজন ব্যক্তি এই জটিলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা আমাদের এই সমস্যাটাকে খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ইউজিসি’র তদন্ত কমিটির কাছে ভিসি নিজেই স্বীকার করায় তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় ৯ জনের নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ, বিষয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া একই ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে সিলেকশন বোর্ড গঠন করে ২০টি বিষয়ে ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ, সরাসরি প্রফেসর পদে নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে ভিসির স্ত্রী আবেদন করেছেন সেটি বাতিল করার ব্যবস্থা করা, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ করে যুগোপযোগী করার ব্যবস্থা গ্রহণ, ভবিষ্যতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ, বিষয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া সিলেকশন বোর্ড গঠন না করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়- এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশসমূহ অনুসরণ করা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগে অনিয়মের চিত্র বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে প্রমাণিত হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তা আটকে যায়। সবমিলিয়ে ভিসি নিজের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে ৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। ইউজিসি’র তদন্তে স্বজনপ্রীতি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণও উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভিসি’র বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৫ জন সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির অপর সদস্যরা ছিলেন- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফরোজা পারভীন ও ইউজিসি’র সিনিয়র সহকারী পরিচালক গোলাম দস্তগীর (সদস্য সচিব)। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি।
তদন্তে উঠে আসে, ভিসি নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দীনকে নিয়োগ দিয়েছেন শাখা কর্মকর্তা পদে। চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা ভিসি’র ভাতিজা। তারা হলেন- হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মুরাদ বিল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান। শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেওয়া হয় সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নিজামউদ্দিন ভিসি’র আত্মীয়। তাদের সবাইকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি’র মেয়ে ইসরাত খানকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি ত্রুটিযুক্ত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 
তদন্তে বলা হয়, ভিসি’র মেয়ে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রভাষক পদে আবেদন করেন। এ পদে ৩০ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন, যাদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ের ফলাফলে পিছিয়ে ছিলেন ভিসি’র মেয়ে। তার সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০। তদন্ত কমিটি বলেছে, ভিসি’র মেয়েকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। শুধু মেয়েকে নয়, ভিসি নিজের স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। ভিসি’র স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তবে এ নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি বলছে, ভিসি’র স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেননি।
তবে ভিসি’র বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠলেও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। রেজিস্ট্রার নিজেও নিয়োগে স্বজনপ্রীতি করেছেন। তার আত্মীয় ও এলাকাবাসী পরিচয়ে অনেকে চাকরি পেয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন, ভাতিজি জান্নাতুল নাঈম (প্রশাসনিক কর্মকর্তা), চাচাতো ভাই কালাম (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) দূরসম্পর্কের নাতি কামরুল হাসান (অফিস সহায়ক), চাচাতো ভাই আল মামুন (ল্যাব এটেনডেন্ট), নিকটাত্মীয় হান্নান আকন্দ (ফটোকপি মেশিন অপারেটর), নিকটাত্মীয় আবদুল মতিন (কম্পিউটার অপারেটর), এলাকাবাসী জাহাঙ্গীর আলম (অফিস সহায়ক) ও এলাকাবাসী শহিদুল ইসলাম (উন্নয়ন কর্মকর্তা)।
ইউজিসি’র তদন্ত প্রতিবেদনে ভিসি কন্যার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া, স্ত্রীকে সরাসরি অধ্যাপক বানানোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা এবং সব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতি না করাসহ ৭ দফা সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের প্রতিটি বাছাই বোর্ডে পর্যবেক্ষক হিসেবে ইউজিসি’র একজন প্রতিনিধি মনোনয়নের সুপারিশ করা হয়।
এদিকে, খুকৃবির ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ জন শিক্ষকের প্রমোশন নিশ্চিত করা ও তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকরা গত ৭ অক্টোবর মানববন্ধন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা। গত বছরের ৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যা পরে একটি বিশেষ কমিটির মাধ্যমে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আশিকুল আলম বলেন, পুনর্মূল্যায়ন কমিটি ৭৩ জনের ফাইল ও নিয়োগের বৈধতা যাচাই করেছে। দুই মাস ধরে প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে পড়ে রয়েছে। যার ফলে আমরা প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্নসহ হতাশায় ভুগছি। অবিলম্বে শিক্ষকদের সমস্যা নিরসনের জন্য দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৫ জুলাই সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খান। তিনি ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর রেজিস্ট্রার পদের বিপরীতে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে ৬ মাসের জন্য অস্থায়ী (এডহক) ভিত্তিতে নিয়োগ দেন ডা. মো মাজহারুল আনোয়ারকে। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। 
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৭৩ জন শিক্ষক, ৩০ জন কর্মকর্তা (স্থায়ী ও অস্থায়ী) এবং ২৩১ জন কর্মচারীসহ (স্থায়ী ও অস্থায়ী) মোট জনবল আছে ৩৩৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০ জন কর্মকর্তা ও ৪৭ জন কর্মচারী নিয়োগ হয় অস্থায়ী ভিত্তিতে। শুরু থেকেই অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে।