বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নানা ইস্যুতে মব জাস্টিসের প্রবণতা বেড়েই চলছে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইকারী কিংবা ধর্ষক আখ্যা দিয়ে এক শ্রেণির একটি চক্র গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিরীহ সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলছে। এই চক্রের হাতে শুধুই যে সাধারণ মানুষ মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছে তা নয়, বিদেশি নাগরিকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও রক্ষা পাচ্ছেন না। পুলিশ সদর দপ্তর ও মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১১৪টি। এতে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন। এছাড়া গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ২২৫টি। এর বাইরেও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। প্রতিনিয়তই এমন বিরূপ আচরণের শিকার হচ্ছেন সড়কে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সদস্যরা। এসব বিষয়ে যথাযথ আইন প্রয়োগ করতে না পারায় খোদ পুলিশের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। ঢাবির সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হকের মতে, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। অনেক ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধনও রয়েছে। মবের মতো ঘটনা দমনে পুলিশকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, বিচারের নামে পিটিয়ে মানুষ মারা ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াও একটি অপরাধ। মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে জড়িত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, মব সৃষ্টি করে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে ও পুলিশের কাজে বাধা দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল শনিবার পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার তোপের মুখে গত বছরের ৫ আপগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার আজ্ঞাবহ মন্ত্রী-এমপি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপর টানা ৩ দিন দেশজুড়ে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিতর্কিত অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও বদলি করা হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনকে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ। অজানা শঙ্কা নিয়েই রুটিন ওয়ার্ক করছেন পুলিশ সদস্যরা। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও ধর্ষক নামে আখ্যা দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মব জাস্টিসের নামে নিরীহ জনসাধারণকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশও নাজেহাল হচ্ছেন।
গত ১৮ মার্চ রাত ১১টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় ধর্ষণের অভিযোগে ‘মব’ তৈরি করে গণপিটুনি দেওয়া হয় এক কিশোরকে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করতে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। তাকে আটক করে পুলিশের গাড়িতে নেওয়ার পথে খিলক্ষেত বাজারে স্থানীয় জনতা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে জনতা। এ ঘটনায় খিলক্ষেত থানার ইন্সপেক্টর তদন্তসহ আটজন আহত হন। এর আগে, গত ৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ছনখোলা এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে দুজনকে হত্যা করা হয়। পরদিন ৪ মার্চ মধ্যরাতে মব তৈরি করে রাজধানীর গুলশানে একটি বাসায় তল্লাশির নামে মালামাল তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাট করে একদল লোক।
মবের শিকার হচ্ছেন বিদেশিরাও। গত ৪ মার্চ দিন-দুপুরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মব সৃষ্টি করে আক্রমণের সময় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ইরানি নাগরিকের ওপর হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় ইরানি দুই নাগরিক আহত হন এবং তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনতাই করা হয়।
এরও আগে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা এলাকার আউটার রিং রোডে মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবককে তল্লাশিচৌকিতে থামার জন্য ইশারা দেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য। এর কিছুক্ষণ পর ১০-১৫ জন এসে ‘ভুয়া পুলিশ’ অপবাদ দিয়ে এসআই ইউসুফ আলীকে মারধর শুরু করেন। ছিনিয়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও ওয়াকিটকি।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর এ ধরনের ২২৫টি হামলা হয়েছে। কোথাও কোথাও হামলা করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটানো হয়েছে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণে বা মব তৈরি করে। পুলিশের বাইরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেখানে গণপিটুনিতে মৃত্যু ও লুটপাট বেশি হয়েছে। এসব পরিসংখ্যানের বাইরেও সড়কে বিভিন্ন সময় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের ঘটনাও ঘটেছে। অযাচিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন দায়িত্বরত অবস্থায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি বড় ধরনের আলোচনা তৈরি করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩ এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮ ও ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটে।
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরেই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি।
বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের মব তৈরি এবং হামলার ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সবশেষ গত ১৮ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক সভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সভায় দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার, রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটনের কমিশনার ও ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠনের অহেতুক হস্তক্ষেপে কাজ করতে পারছে না পুলিশ। তবে পুলিশের কাজে যারা বাধা দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। অনেক ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধনও রয়েছে। মবের মতো ঘটনা দমনে পুলিশকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বিচারের নামে পিটিয়ে মানুষ মারা ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াও একটি অপরাধ। মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে জড়িত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মব সৃষ্টি করে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে ও পুলিশের কাজে বাধা দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: সাপ্তাহিক ঠিকানা