বরগুনার পাথরঘাটায় মাদরাসা ছাত্র হাসিবুল ইসলামকে (১৩) অপহরণের পর হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটজনের নামে অপহরণসহ হত্যা মামলা করেছে হাসিবুলের বাবা শফিকুল ইসলাম।
মূল হোতা নোমানসহ আটজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর রহস্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদে নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে।
কিলিং মিশনের তথ্য, ভিডিও চিত্র ধারণ করে ডার্ক ওয়েবে আপলোড করতে এবং নিজেই একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে নগদ টাকার প্রয়োজনে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে।
ডার্ক ওয়েবে এসব কিলিং মিশনের ভিডিও আপলোড করে টাকা উপার্জনের জন্য হাসিবকে হত্যা করে এবং অপহরণের পর থেকে কিলিং মিশনের প্রতি মুহূর্তের ভিডিও করে ঘাতক নোমান। টাকা উপার্জনের জন্য নিজেই ডার্ক ওয়েবের মতো ওয়েবসাইট করতে নগদ তিন লাখ টাকার মুক্তিপণের জন্য ওই ভিডিওর কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ হাসিবের বাবা শফিকুল ও চাচা মনিরের মোবাইলে পাঠায় নোমান। নোমান নিজের স্ত্রীর বোরখা পড়ে এবং ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে নারী সেজে হাসিবের লাশ পাথরঘাটা পৌর শহর থেকে অটোরিকশায় করে নিয়ে যায় শ্বশুরবাড়িতে। হাসিবকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিজে বাঁচতে গুগল ম্যাপে সার্চ দিয়ে নিরাপদ জায়গা শনাক্ত করার পর সেখানেই হাসিবকে ড্রামভর্তি করে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের ওই নির্ভরযোগ্য সূত্র আরও বলছে, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে কিনা এমনকি এর সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সবদিক নজর রেখেই কাজ করছে পুলিশ। তবে কাউকেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান ওই নির্ভরযোগ্য সূত্র।
এদিকে সোমবার রাতে পাথরঘাটা থানা পুলিশ মামলাটি আমলে নেয়। এর আগে রোববার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে ঘাতক আবদুল্লাহ আল নোমানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ড্রামে ভর্তি হাসিবুলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায় ঘাতক নোমান অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ছিলেন। তিনি অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অনেক ডলার আয় করেছেন। আরও ডলার আয় করতে তার প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিল বলে জানিয়েছেন ঘাতকের স্ত্রী তাহিরা। তাছাড়া ডার্ক ওয়েবে কিলিং মিশনের ভিডিও, তথ্য আপলোড করলে অনেক ডলার পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও ভিডিও আপলোডের জন্য নোমান নিজের একটি ওয়েবসাইট করতে চান। সেই ওয়েবসাইট করতে নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। এ কারণে তিনি হাসিবুল ইসলামকে অপহরণ করে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, বেশি লেখাপড়া না করলেও তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে অনেক জ্ঞান রয়েছে নোমানের। কিন্তু তিনি সঠিক পথে সে জ্ঞান ব্যবহার করেননি। এমনকি নোমান নারী কণ্ঠসহ একাধিক কণ্ঠে কথা বলতে পারেন বলেও জানান তারা।
পাথরঘাটা থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে হাসিবুল ইসলামকে অপহরণ করে পাথরঘাটা পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডে পল্লি চিকিৎসক মিজানুর রহমানের ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। পরদিন সকালে মিজানুর রহমানের বাসাতেই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। মিজানুর রহমান ঘাতক নোমানের মায়ের পরকীয়া প্রেমিক। ঘটনার সময় মিজান ওই বাসাতে ছিলেন না। এ হত্যাকাণ্ডের মিশনে ঘাতক নোমান একাই ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পরে তার স্ত্রীর লাল রং এর বোরখা পরে প্লাস্টিকের ড্রামে ভরে অটোরিকশায় করে মরদেহ তার শ্বশুরবাড়ি এলাকায় নিয়ে যান। এটি ভিডিওর সিসি ফুটেজেও ধরা পরে। পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় মরদেহ কাঁকচিড়া ইউনিয়নের দণি বাইনচটকী এলাকার বেড়িবাঁধের পাশ একটি গর্তে ফেলে দেন।
পুলিশ আরও জানায়, ঘটনার মাস্টারমাইন্ড নোমান ওরফে তানভীর ওরফে শিশু ফকিরসহ (১৯) এজাহারনামীয় সব আসামিকেই আটক করেছে পুলিশ।
আসামিরা হলেন- আবদুল্লাহ আল নোমান ওরফে তানভীর ওরফে শিশু ফকির, বাবা মহিউদ্দিন ফরাজী, অটোরিকশা চালক আব্দুর রহিম কাজী (৪৮), নোমানের স্ত্রীর বড় ভাই আব্দুর রহিম মুন্সী (৩৫), পল্লি চিকিৎসক মিজানুর রহমান (৩৪), নোমানের শ্বশুর ইউনুছ মুন্সি (৬৫) নোমানের স্ত্রী মোসা. তাহিরা (১৯), নোমানের শাশুড়ি রাহিমা (৫৫), জ্যাঠ্যুস (স্ত্রীর বড় বোন) মোসা. তানজিলাসহ (২৮) অজ্ঞাত নামা আরও কয়েকজন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাথরঘাটা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলী হোসেন জানান, রোববার রাতে ঘাতক নোমানসহ ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। এর মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও এজাহারনামীয় আটজনকে গ্রেপ্তার করে পাথরঘাটা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং নোমান ও মিজানের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম হাওলাদার বলেন, ঘটনার শুরু থেকেই পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছে। ঘটনার মূল মাস্টার মাইন্ড আবদুল্লাহ আল নোমান ওরফে তানভীর ওরফে শিশু ফকিরকে গ্রেপ্তার করে তার দেওয়া তথ্যমতে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি শুরু থেকেই আমলে নিয়ে কাজ করেছি। যার কারণে দ্রুতই ঘাতকদের আটক করাসহ লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। নোমান খুবই স্বাভাবিক অবস্থায় হত্যাকাণ্ডসহ লাশ গুম করেছে। তবে আটকের পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলায় আমাদের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে।
ডার্ক ওয়েব (ইংরেজি: dark web, প্রতিবর্ণীকৃত: অন্ধকার ওয়েব) হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের একটি অংশ যা ডার্ক নেটে বিদ্যমান। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের ৫ থেকে ৬ শতাংশ জুড়ে ডার্ক নেটের ব্যাপ্তি। উন্মুক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে এটি এক প্রকার লুকায়িত নেটওয়ার্ক। এতে প্রবেশ করতে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার, কনফিগারেশন বা অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
উচ্চ স্তরের এনক্রিপশনের কারণে ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর আইপি এবং ভূ-অবস্থান ট্র্যাক করতে সক্ষম হয় না এবং ব্যবহারকারীও হোস্টের ক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়। এভাবেই ডার্কনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যকার যোগাযোগ যেমন কথা বলা, ব্লগিং এবং ফাইল আদান প্রদান অত্যন্ত নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়।
ডার্কনেট বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ যেমন অবৈধ বাণিজ্য, ফোরাম, পেডোপিলিসদের (একজন ব্যক্তি যিনি শিশুদের প্রতি যৌন আকৃষ্ট হন) জন্য মিডিয়া বিনিময় এবং সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেও ব্যবহার করা হয়।
মূলত পরিচয় গোপন রেখে ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে শুরু হয়েছিল ডার্ক ওয়েব। কিন্তু ক্রমশ তা অপরাধীমূলক কার্যকলাপের আখড়া হয়ে উঠতে শুরু করে। এখানে যেকোনো বড়সড় অপরাধমূলক কাজের পেছনে ডার্ক ওয়েব ব্যবহারের যোগ পাওয়া যায়। তবে শুধু অপরাধমূলক কাজ নয়, পরিচয় গোপন রাখতে অনেক সাংবাদিক নিয়মিত ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করেন।
ডার্ক ওয়েবে মুহূর্তের ভুলে আপনার জীবনে অন্ধকার নেমে আসতে পারে। সঠিক তথ্য না জেনে ডার্ক ওয়েব ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ডার্ক ওয়েবে বেআইনি হ্যাকার ও অপরাধীদের আনাগোনা সর্বত্র। তাই কৌতূহলবশতও ইন্টারনেটের এই অংশ ওপেন করা উচিত নয়।