খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড

‘দুলাভাই আমার অফিসে আগুন লাগছে, আমারে বাঁচান’

নিজস্ব সংবাদদাদা
  ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০১:১৪

রাজধানীর মহাখালী খাজা টাওয়ারে ‘রেইস অনলাইন লিমিটেডের’ কল সেন্টারে চাকরি করতেন হাসনা বেগম রাণু ও আকলিমা রহমান। আগুন লাগার পর সবার মতো তারাও বাঁচতে চেষ্টা করেন। এর মধ্যে রাণু ১১ তলা থেকে পাশের ভবনের যাওয়ার সময় পড়ে মারা যান। আর রাত ১২টার পর ওই তলা থেকে আকলিমার মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১১ ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর সকাল ৮টা ৪৫মিনিটে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়।
ভবনটিতে আগুন লাগার পর বিকেল ৫টায় ভগ্নিপতিকে ফোন করে আকলিমা বলেন, ‘দুলাভাই আমার অফিসে আগুন লাগছে, আমারে বাঁচান।’ এরপর থেকে তার ফোন বন্ধ পায় পরিবারের সদস্যরা। তারা ঘটনাস্থল ও বিভিন্ন হাসপাতালে খুজে তাকে খুজতে থাকেন। পরে রাতে ১১তলায় তার নিথর দেহ শনাক্ত করেন ছোট ভাই মো.রাশেদ। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাকে উদ্ধারে পর হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
মো. রাশেদ অভিযোগ করেন, ‘বোনের ফোন পাওয়ার পর আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসসহ সবাইকে আকলিমার নিখোঁজের বিষয়টি জানাই। কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেয়নি। আমাদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ করলে বোনটাকে বাঁচাতে পারতাম’। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার বোন যদি ফোন না দিতেন, তাহলে মনের বুঝ দিতে পারতাম। কিন্তু বোন এখন কি ভাবছে, বাঁচানোর জন্য পরিবারকে বললেও তারা আমাকে বাঁচাতে কোনো চেষ্টায় করি নি! বোনকে বলতে পারলাম না ওর বাঁচানোর জন্য কত কি করেছি আমরা।’ আমার বোনের অফিস ছিল ৯ তলায় কিন্তু সে বাঁচার জন্য সবার সঙ্গে হয়তো ওপরে উঠেছে। কিন্তু তাও বাঁচতে পারলো না।
এদিকে রেইস অনলাইন লি.এর দুই কর্মীকে হারিয়ে শোকে কাতর প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ম্যানেজার নাজমুল হুদা সমকালকে বলেন, আমাদের ফ্লোরে কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটে নি। প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, দুজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। আরও ৭–৮ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপনের ঘোষণা দেওয়ার পর বিভিন্ন কোম্পানির মালিক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ভবনে প্রবেশ করেন।
এসময় ভবনের সামনে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য পুলিশ অবস্থান করছে। এর পাশাপাশি ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরাও কাজ করছেন। কোম্পানির লোক ব্যতীত কাউকে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া ধোঁয়া বের করতে সামনে গ্লাস ভেঙে ফেলতে দেখা গেছে।
দুপুরের পর থেকে তারা অক্ষত মালামাল বের করে আনতে দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। এসময় সার্কেল নেটওর্য়াকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে আমাদের ফেসবুকের সার্ভার ছিল। ১০ তলায় অফিস। সেখানে আগুনে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১১ তলা থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত আগুনে পুড়েছে। আর বাকি ফ্লোরগুলো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এখনও ভবনের মধ্যে ধোঁয়া রয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা ভবনের মধ্যে। তবে টাওয়ারের ডার্ক লাইন পুরো পুড়ে গেছে।’
আগুনের বিষয়ে কথা হয় খাজা টাওয়ারের পেছনে নিপুন রোকেয়া নিবাসের বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি আছরের নামাজ শেষ করে বাসার সামনে এসে দাঁড়াই। তখনই আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনি। ওপরে তাকিয়ে দেখি গ্রামীণ টেলিকম অফিসের পেছনের পাশে আগুন দেখা যাচ্ছে। তখন ৯ ও ১০ তলা থেকে অনেকে ভবনের পিছনের বাম পাশের রেলিং দিয়ে নামতে শুরু করে। তাদের নিষেধ করলেও শোনে না। ১০-১২ জন এখান দিয়ে নেমেছে,
তাদের পেছনে একটা মেয়ে নামতে গিয়ে রেলিং থেকে ছিটকে পড়ে মারা যায়।’
রেডিসন টেকনোলজিসের ম্যানেজার মফিজুর রহমান বলেন, ১ ঘণ্টা সময় লেগেছে শুধু ১১ তলায় ডাটা সেন্টারে পৌঁছাতে। ভবনের মধ্যে ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই ধোঁয়ায় চোখ পুড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে দুইজন কর্মী বমিও করেছে। কোম্পানির কোন মালামাল পোড়েনি। তবে ধোঁয়ায় কালো হয়ে আছে। অনেক কষ্টে মালামালগুলো বের করে আনছি। এখন সব কানেকশন দেওয়ার পর বুঝব কী কী মালামালে ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তরফদার মোহম্মাদ রুহুল আমিন বলেন, অগ্নিকাণ্ডে নিহত তিনজনের মধ্যে আমাদের এক সহকর্মী রয়েছেন। তিনি কোম্পানির সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন কর্মী এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, কোম্পানির হিসাব শাখা পুরোটাই পুড়ে গেছে। অন্যান্য অফিসগুলো অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে। আমাদের অফিসে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকলে, আরও বেশি ক্ষতি হতো। কর্মীরা এক্সট্রিংগুইশার ব্যবহার করেছিল। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হতে পারে। তবে এই অবস্থা কাটিয়ে কবে নাগাদ অফিস চালু করতে পারবো, তা এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।
আগুনের কারণ খুঁজতে শুক্রবার পাঁচ সদস্যের একটি টিম গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। কমিটিকে অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য ১৫ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছে।