চুলার শিখার চেয়ে দ্বিগুণ ভয়াবহ জেট ফুয়েলের আগুন, পানিতে আরও বাড়ে

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২১ জুলাই ২০২৫, ২৩:৪১

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীবাহী ও কার্গো বিমান উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। অথচ এই বিশাল আকাশ পরিবহন ব্যবস্থার প্রাণশক্তি ‘জেট ফুয়েল’ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা এখনো সীমিত। তেলের বাজারে ব্রেন্ট বা ক্রুড নিয়ে আলোচনা যতটা হয়, জেট ফুয়েল নিয়ে হয় না তেমনটি, অথচ এই জ্বালানিই আধুনিক বিমানচালনার অপরিহার্য ভিত্তি। আজ আমরা এই জ্বালানি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

জেট ফুয়েল কী?
জেট ফুয়েল এক ধরনের বিশেষায়িত তরল হাইড্রোকার্বনভিত্তিক জ্বালানি, যা মূলত জেট ইঞ্জিন ও গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিনসমৃদ্ধ বিমানে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত এটি উচ্চ তাপমাত্রা ও নিম্ন তাপমাত্রা উভয়ই সহ্য করতে সক্ষম, দাহ্য হলেও তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও কম সালফারযুক্ত।
বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত জেট ফুয়েলের সবচেয়ে প্রচলিত রূপ হলো জেট এ-১, যা আন্তর্জাতিকভাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে ব্যবহৃত হয়। সামরিক খাতে ব্যবহারের জন্য জেপি-৪, জেপি-৫, জেপি-৭ ও জেপি-৮ নামে কিছু ভিন্ন মানের জেট ফুয়েল ব্যবহৃত হয়।

জেট ফুয়েলের রাসায়নিক প্রকৃতি
জেট ফুয়েল মূলত কেরোসিন ফ্র্যাকশন থেকে উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ এই জ্বালানি মূলত কেরোসিনের পরিশোধিত রূপ। এর গঠন অনেকটা ডিজেল ও কেরোসিনের মাঝামাঝি।

ফ্ল্যাশ পয়েন্ট বা জ্বলার জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা
জেট ফুয়েল জ্বলার জন্য প্রয়োজন হয় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার। সাধারণত জেট এ ও জেট এ-১ ফুয়েলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট প্রায় ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০০ ফারেনহাইটের মতো। অর্থাৎ, এই তাপমাত্রার নিচে এটি নিজে নিজে বাষ্প হয়ে জ্বলবে না।

ফ্রিজিং পয়েন্ট বা জমে যায় যে তাপমাত্রায়
জেট এ ফুয়েলের ফ্রিজিং পয়েন্ট হলো প্রায় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও জেট এ-১ ফুয়েলের ফ্রিজিং পয়েন্ট হলো প্রায় মাইনাস ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই জেট ফুয়েল দীর্ঘসময় উচ্চতাপ ও নিম্নতাপে উড়ন্ত অবস্থায় স্থিতিশীল থাকে।

সাধারণ চুলার আগুন ও জেট ফুয়েলের আগুনের মধ্যে পার্থর্ক্য

এলপিজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসের শিখার তাপমাত্রা সাধারণত ১০০-১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। আবার কাঠ বা কয়লার আগুনের তাপমাত্রা ৬০০-১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। কিন্তু জেট ফুয়েলের শিখা খোলা পরিবেশে ১৫০০-২০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উৎপন্ন করতে পারে। অর্থাৎ সাধারণ আগুনের তুলনায় জেট ফুয়েলের আগুনের তাপমাত্রা দ্বিগুণ হয়।

জেট ফুয়েলের আগুন নেভানোর উপায়

১. বিশেষ ধরনের ফোম
একুয়াস ফিল্ম ফর্মিং ফোম বা এএফএফএফ হলো জেট ফুয়েল বা তরল হাইড্রোকার্বন আগুন নেভানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এই ফোম আগুনের ওপর একধরনের স্তর তৈরি করে, যা অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ও আগুনের উপরিভাগ ঠান্ডা করে। সেই সঙ্গে এটি জ্বালানি ও বাষ্পের সংস্পর্শ রোধ করে পুনরায় জ্বলার সম্ভাবনা কমায়।

২. শুকনো রাসায়নিক পাউডার
বেশ কিছু ধরনের আগুন নেভানোর পাউডার রয়েছে, যেমন- মনোঅ্যামোনিয়াম ফসফেট বা সোডিয়াম বাইকার্বোনেট জেট ফুয়েলের আগুন দমনে কার্যকর। এগুলো আগুনের রাসায়নিক বিক্রিয়া থামিয়ে দেয় ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সহায়তা করে। তবে এগুলো সাধারণত ছোট বা প্রাথমিক আগুনে বেশি ব্যবহৃত হয়।

৩. কার্বন ডাই-অক্সাইড
কার্বন ডাই-অক্সাইড আগুনের স্থান থেকে অক্সিজেন সরিয়ে নেয়, ফলে আগুন দ্রুত নেভে। তবে এটি বদ্ধ জায়গায় বেশি কার্যকর। খোলা জায়গায় বা বড় অগ্নিকাণ্ডে খুব একটা কার্যকর নয়।

পানি ঢালা যাবে না
জেট ফুয়েলে লাগা আগুন নেভাতে কোনোভাবেই পানি ব্যবহার করা যাবে না। পানি ঢাললে এই জ্বালানির আগুন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে, কারণ জেট ফুয়েল পানির চেয়ে হালকা ও পানির সাথে মেশে না। ফলে, পানি দিলে ফুয়েল ছড়িয়ে গিয়ে আগুন আরও বাড়বে।
পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে জ্বালানির উপরে ভেসে থাকা আগুন আরও ছড়িয়ে পড়বে, বিশেষ করে রানওয়ে বা খোলা জায়গায়।

জেট ফুয়েল অগ্নিকাণ্ডে করণীয়
দ্রুত ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলা ও ফুয়েলের বিস্তার রোধ করতে হবে।
ফুয়েল পাইপলাইন বা ট্যাঙ্ক থেকে ফুয়েল প্রবাহ বন্ধ করে দিতে হবে।
ফোম সাপ্লাইসহ বিশেষ ফায়ার টেন্ডারের ব্যবস্থা রাখা।

জেট ফুয়েলের উৎপাদন
এই জ্বালানি উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং শুরু হয় ক্রুড অয়েল দিয়ে, যা সাধারণত সমুদ্রের তলদেশ বা ভূগর্ভ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ক্রুড অয়েলকে পাতন কলামে গরম করা হয়, যেখানে এটি বিভিন্ন উপাদানে বিভক্ত হয়। কেরোসিন, যা জেট ফুয়েলের প্রধান উপাদান, মাঝারি তাপমাত্রায় (১৫০-২৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পৃথক হয়। এরপরে কেরোসিনকে আরও পরিশোধন করে সালফার ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় উপাদান অপসারণ করা হয়।
সবশেষে পরিশোধিত কেরোসিনে বিভিন্ন সংযোজন মেশানো হয় যাতে এটি জেট ফুয়েলের আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে। এই সংযোজনগুলো জ্বালানির স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বাড়ায়। উৎপাদিত জেট ফুয়েল কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায় এবং তারপর পাইপলাইন, ট্যাঙ্কার বা অন্যান্য মাধ্যমে বিমানবন্দরে সরবরাহ করা হয়।

বিশ্বের প্রধান জেট ফুয়েল রপ্তানিকারক দেশ:
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারত (রিলায়েন্স রিফাইনারি)
বাংলাদেশের বেসরকারি ও সরকারি বিমানের জন্য ব্যবহৃত জেট ফুয়েল প্রধানত আমদানি করা হয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এর মাধ্যমে সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হয়।

সূত্র: অ্যাভিয়েশন টেক রিভিউ ও অনলাাইনে প্রাপ্ত উৎসগুলো