একের পর এক খুনের ঘটনায় চট্টগ্রামের রাউজান এখন আতঙ্কের জনপদ। শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নন; সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। কখন, কার ওপর হামলা হয়– এই ভয়ে এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন বিএনপির বিভক্ত অনেক নেতাকর্মী। অনেক এলাকায় রাত নামলেই শোনা যায় গোলাগুলির শব্দ। সন্ধ্যা হলেই বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের পাশাপাশি বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি নিয়েও ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। এখানে গত ১৪ মাসে ১৬ জন খুন হয়েছেন।
রাউজান উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে নোয়াপাড়া ইউনিয়নে। এই এলাকায় রয়েছে সন্ত্রাসী গ্রুপ ফজল হক বাহিনী, জসিম বাহিনী, কামাল বাহিনী, জানে আলম বাহিনীর শক্ত অবস্থান। এসব বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে আশপাশের উরকিরচর, বাগোয়ান ও পাহাড়তলী।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পাশেই রাউজানের নোয়াপাড়া চৌমুহনী বাজার। সম্প্রতি নোয়াপাড়া চৌমুহনী বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী; সবার মধ্যে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক ব্যবসায়ী বলেন, এক সময় রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখা হতো। বিএনপির বিভক্ত দুটি গ্রুপের মধ্যে একের পর এক সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ফলে এখন রাত ৮টার আগেই বেশির ভাগ দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
জুয়েলারি ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। নিরাপদে বাড়ি ফিরতে আমি নিজেও সন্ধ্যা ৭টায় দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে যাই।
জানা গেছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এখানে খুন হন মুহাম্মদ হাসান নামে এক যুবলীগ কর্মী। এর আগে ২৪ জানুয়ারি নোয়াপাড়ায় দিন-দুপুরে স্থানীয় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম।
উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার নোয়াপাড়া ছাড়াও বাগোয়ান, পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন, কদলপুর ও রাউজান সদর ইউনিয়ন অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে এসব ইউনিয়নে খুন হয়েছেন ১১ জন। সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৬৫টি। দলীয় প্রতিপক্ষের ভয়ে এসব এলাকার বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মী এলাকাছাড়া।
রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিসান বিন মাজেদ বলেন, রাউজানে সন্ত্রাসীদের অবস্থান ও অপরাধপ্রবণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার গুগল ম্যাপ তৈরি করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠিয়েছি। সন্ত্রাসীদের তালিকা জমা দিয়েছি। আশা করছি, দ্রুত সরকার ব্যবস্থা নেবে।
রাউজান সদর ইউনিয়নের এক প্রবীণ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এখানে বহু বছর ধরে শুধু ব্যক্তির শাসন চলে। ব্যক্তি বদলায়; কিন্তু সন্ত্রাস কমে না।
এদিকে হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাটে রাউজানের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর স্ত্রী তাসফিয়া আলম অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় এ মামলা করেন। হাটহাজারী থানার ওসি মনজুর কাদির ভূঁইয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে তিনজনকে আটক করেছিল, তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের মদুনাঘাট পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের মাত্র ২০০ মিটার দূরে মোটরসাইকেলে করে এসে একদল অস্ত্রধারী গুলি করে আবদুল হাকিমকে হত্যা করে। এ সময় তিনি রাউজানের খামার থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে চট্টগ্রাম শহরে ফিরছিলেন। এ ঘটনায় তাঁর সঙ্গে থাকা চালক ইসমাইলও গুলিবিদ্ধ হন। হাকিমের শরীরে ১২টি গুলির আঘাতের চিহ্ন পেয়েছে পুলিশ। তাঁর ব্যবহৃত গাড়িতে রয়েছে ২২টি গুলির চিহ্ন। আবদুল হাকিমের ভাই পারভেজ আলম জানিয়েছেন, তাঁর ভাই রাউজানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
রাউজানে বিএনপি দুই গ্রুপে বিভক্ত। এক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের পদ স্থগিত থাকা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী; আরেক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার। গিয়াস কাদের এসব হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক দাবি করলেও গোলাম আকবর বলছেন, বালুমহাল ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে এসব হত্যাকাণ্ড।