
বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ কালো অধ্যায় যুক্ত হলো। বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে গণমাধ্যম অঙ্গন। সংবাদ মাধ্যমে হামলার ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে।
নজিরবিহীন হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এই দুই সংবাদমাধ্যমের ওপর যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, গতকাল শুক্রবার সরেজমিন তার ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভবনজুড়ে। পুড়ে যাওয়া অনেক নথিপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল তখনও।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে শুক্রবার বেলা ১১টায়ও প্রথম আলোর ভবন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক টিমের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছিলেন। আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আশপাশ এলাকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরা।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে এক দল লোক শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে এসে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। এর এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর তারা ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে হামলা চালায় ও আগুন দেয়। এই ঘটনায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার তাদের প্রকাশনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। শুক্রবার পাঠকের কাছে পত্রিকা সরবরাহ করতে পারেনি তারা। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অনলাইন কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। পরে সংবাদমাধ্যম দুটির অনলাইন চালু হয়।
গতকাল রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুটি গণমাধ্যমে হামলার ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তেজগাঁও থানার ওসি ক্যশৈন্যু মারমা সমকালকে বলেন, হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
তবে আমরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। বিভিন্ন ভিডিও ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
চারপাশে ক্ষতচিহ্ন
গতকাল সকালে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম আলোর পাঁচতলা নিজস্ব ভবনের নিচতলার শাটার অর্ধেক নামানো। সামনে সিআইডির ফরেনসিক ইউনিটের সদস্যরা ক্রাইম সিনের ফিতা দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। ভবনটির বাইরের দিকের কাচের দেয়াল ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ায় নিচ থেকে বিভিন্ন তলার কিছু অংশ দেখা যায়। পোড়া ভবনের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছাই, পোড়া কাগজপত্র ও ভাঙাচোরা আসবাব। কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ভস্মীভূত। মেঝেতে পড়ে থাকা পোড়া ফাইল, আধপোড়া সংবাদপত্রের কপি আর ছাই হয়ে যাওয়া নথিপত্র যেন হামলার ভয়াবহতার নীরব সাক্ষী। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বাইরের অংশের কাচ নেই, দরজাগুলো উপড়ে ফেলা, লোহার গেট বেঁকে গেছে আগুনের তাপে। নিচতলার শাটার ভাঙাচোরা। আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়ায় কালো হয়ে আছে দেয়াল। ভবনের সামনে পোড়া কাগজপত্র ও ছাই পড়ে আছে। প্রথম আলোর কর্মীরা ভবনটির ভেতর থেকে পোড়া কাগজপত্র এবং প্রথমা প্রকাশনীর বই বের করে আনছিলেন। অনেক বই আগুন নেভানোর জন্য দেওয়া পানিতে ভিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী ও উৎসুক লোকের ভিড় ছিল সেখানে।
জানা যায়, পাঁচতলা ভবনটির নিচতলায় কন্ট্রোল রুম, প্রথমা প্রকাশনী, প্রথমা ডটকম, বিজ্ঞাপন বুথ ও ফ্রন্ট ডেস্ক ছিল। দ্বিতীয় তলায় বিজ্ঞাপন/মার্কেটিং বিভাগ, বন্ধুসভা, সাপ্লাই চেইন ও সার্কুলেশন বিভাগ। তৃতীয় তলায় অ্যাকাউন্টস ও কালেকশন বিভাগ। চতুর্থ তলায় চরকি ও স্টুডিও বিভাগ। পঞ্চম তলার একাংশে ক্যান্টিন এবং বাকি অংশ খোলা ছাদ।
গতকাল ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ফসিহ উদ্দিন সরদার সমকালকে বলেন, ভবনটির নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত সব পুড়ে গেছে। চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নেভানো হয়।
ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার রাত ১টা ১১ মিনিটে তারা আগুন লাগার খবর পান। একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নির্বাপণে কাজ শুরু করে। রাত ৩টা ৪৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তর থেকে জানানো হয়, প্রথম আলো অফিসে আগুন নির্বাপণের সময় মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মো. আলমগীর ও মো. শফিউল আলম বিদ্যুৎস্পর্শে আহত হন। তাৎক্ষণিক তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা এখন আশঙ্কামুক্ত।
জীবন শঙ্কায় ছিলেন ডেইলি স্টারকর্মীরা
প্রথম আলোর অদূরে ফার্মগেটে ডেইলি স্টার ভবনে গিয়ে দেখা যায় ৯ তলা ভবনের তিনতলা পর্যন্ত আগুনের ক্ষতচিহ্ন। সপ্তম তলা পর্যন্ত ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় জুলাইযোদ্ধাদের ছবির গ্যালারি। তৃতীয় তলায় স্টোর। চতুর্থ তলায় একাধিক সেমিনার কক্ষ ও লাইব্রেরি। পঞ্চম তলায় ক্যান্টিন, ব্যায়ামাগার, স্টুডিও। ষষ্ঠ তলায় ফটো, বিজ্ঞাপন, অ্যাকাউন্ট ও সার্কুলেশন বিভাগ। সপ্তম তলায় বার্তা বিভাগ। ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরাসহ নানা সরঞ্জাম লুটপাট করা হয়। ক্যান্টিন থেকে খাবারসামগ্রী লুট করে হামলাকারীরা।
গতকাল ডেইলি স্টারের অনেক কর্মী তাদের চেনা কার্যালয়ের অচেনা দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রতিষ্ঠানটির ফটোসাংবাদিক প্রবীর দাশ সমকালকে বলেন, ‘একটি ক্যামেরা ও অন্তত পাঁচটা লেন্স লুট করে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। অনেক দিনের তোলা ছবিও এখন নেই।’
সরেজমিন দেখা যায়, ৯ তলা ভবনটির নিচতলায় পুলিশ অবস্থান করছে। ডেইলি স্টারের কর্মী ছাড়া অন্যদের ভেতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়। ভবনের সামনের অংশে আগুনে বাঁকা হয়ে যাওয়া স্টিলের পাতের স্তূপ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কাচ, পোড়া কাগজপত্রসহ ধ্বংসাবশেষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর এক দল লোক ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ভবনে সংবাদকর্মীরা আটকা পড়েন। তারা ফেসবুকে ভেতরের অবস্থা জানিয়ে উদ্ধারের জন্য আকুতি জানান। ভবনের ছাদে গিয়ে অবস্থান নেন অনেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদে চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ে কাটাতে হয় তাদের। ভোর ৪টার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তাদের উদ্ধার করে।
ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৩৯ মিনিটে তারা ডেইলি স্টারে আগুন লাগার খবর পান। এর পরই ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট গিয়ে অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে। রাত ৩টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে এবং এর ৪০ মিনিট পর আগুন নির্বাপণ করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছানোর আগেই আক্রান্ত
হামলার ঘটনায় গতকাল বিকেলে প্রথম আলো তাদের অনলাইন পোর্টালে একটি বক্তব্য তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর অফিস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত আক্রমণের শিকার হয়েছে। আক্রমণকালে কর্মরত সাংবাদিকরা অনলাইন সংবাদ পোর্টাল চালানোর পাশাপাশি শুক্রবার কাগজ প্রকাশের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথম আলোর কর্মীরা এই সন্ত্রাসী হামলার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন এবং জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা অফিসের ভবন ব্যাপকভাবে ভাঙচুরের পর তাতে অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবন পুড়ে যায় এবং তাতে সংরক্ষিত সম্পদ ও মূল্যবান নথিপত্র ভস্মীভূত হয়।
প্রথম আলো ঘটনা নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলে– অফিস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাওয়ায় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীসহ নানা মহলের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই অফিস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কর্মরত উদ্বিগ্ন সাংবাদিক ও কর্মীরা জীবন বাঁচাতে কার্যালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও দমকল বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রথম আলো বলছে, এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারের ওপর সরাসরি আক্রমণের একটি সুস্পষ্ট নজির। তারা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পাশাপাশি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানায়।
হামলাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি
ডেইলি স্টার বলেছে, স্বাধীন সাংবাদিকতার ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্য এক কালো দিন ছিল বৃহস্পতিবার। এই হামলা ছিল ভয়াবহ। অনলাইনে প্রকাশিত একটি লেখায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের সহকর্মীরা যখন ছাদে আটকা পড়ে নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কায়, তখন নিচে এক দল জনতা একের পর এক ফ্লোরে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধোঁয়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় কেউ হতাহত হননি এবং সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।’
আক্রান্ত হওয়ার আগে শাহবাগের ঘটনা এবং কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের অভিমুখে এক দল লোক আসার খবর পেয়ে ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে যোগাযোগ করেছিল। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঘটনাস্থলে সহায়তা করেন। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ছাদে আটকে পড়া আমাদের সহকর্মীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ে কাটাতে হতো না।
পত্রিকাটি বলেছে, একটি বিশেষ মহল বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে থাকা দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির আরেকটি অপচেষ্টা বলে আমরা একে মনে করছি।
পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে হামলাকারী ও তাদের ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে ডেইলি স্টার বলেছে, গণমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের শিথিল মনোভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অতীতেও দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো বিভিন্ন মহলের হুমকির মুখে পড়েছে; কিন্তু সেসব ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়নি। চরম ঝুঁকির মধ্যেও যারা আমাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন, এমনকি শারীরিক হামলার শিকার হয়েও পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আরও তিন জেলায় প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কুষ্টিয়া, খুলনা ও সিলেটে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও বগুড়া কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা হয়েছে। ওই সময় প্রথম আলোর কোনো কর্মী কার্যালয়ে ছিলেন না।
সমকালের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এক দল লোক শহরের মজমপুর এলাকায় প্রথম আলো অফিসে ভাঙচুর চালায়। তারা কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করে এবং আগুন দেয়।
খুলনা ব্যুরো জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে এক দল লোক শহরের মৌলভীপাড়ায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা করে। তারা কার্যালয় থেকে একটি সাইনবোর্ড ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ফেস্টুন খুলে নিয়ে তাতে আগুন দেয়।
সিলেট ব্যুরো জানিয়েছে, প্রথম আলোর সিলেট কার্যালয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে এক দল লোক। এতে কার্যালয়ের জানালার কাচ ভেঙে যায় এবং ভেতরে থাকা কিছু জিনিস নষ্ট হয়।
চট্টগ্রামে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১২টার দিকে এক দল লোক মিছিল নিয়ে হিলভিউ আবাসিক এলাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়। তারা স্লোগান দিয়ে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। প্রথম আলোর বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফা হামলার চেষ্টা চালানো হয়েছে।
সংবাদপত্রের ইতিহাসে কালো রাত
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা, হয়রানির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু এবার দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার কার্যালয়ে যেভাবে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে, এমনটি স্বাধীনতার পর ঘটেনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও একাধিক গণমাধ্যমে হামলার ঘটনা ঘটে। সে সময় হামলার শিকার হয় ৭১ টিভি, সময় টিভি, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, গানবাংলা, এশিয়ান টিভি, বিজয় টিভি ও মাই টিভি। এসব হামলায় ছয়টি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে চ্যানেলগুলো সম্প্রচারে ফেরে। একই সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানের মালিকানাধীন তিনটি পত্রিকা অফিসেও হামলার ঘটনা ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক আমাদের নতুন সময়, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও ডেইলি আওয়ার টাইমের প্রকাশনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হামলার শিকার হয় বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন গণমাধ্যমও।
ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে সাংবাদিকদের কারাবরণ করতে হয়েছে; বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পত্রিকা। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় সংবাদপত্রের ওপর নেমে আসে কঠোর দমন-পীড়ন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয় ইত্তেফাক, সংবাদসহ কয়েক পত্রিকার কার্যালয়।
স্বাধীনতার পরও সংবাদপত্র মুক্ত পরিবেশ পায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সব পত্রিকা বন্ধ, সামরিক শাসনামলের সেন্সরশিপ, পরবর্তী সময়ে দমনমূলক আইন– সব মিলিয়ে গণমাধ্যম বারবার আক্রান্ত হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই সাংবাদিক নির্যাতন, মামলা ও অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর মগবাজারে দৈনিক সংগ্রাম কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে সম্পাদক আবুল আসাদকে ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক সংগঠনের কিছু লোক। পরে তাঁকে পুলিশে দেওয়া হয। তবে একসঙ্গে দুটি বড় পত্রিকার কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন।
সূত্র: প্রথম আলো