পাহাড় থেকে আবার দুঃসংবাদ এলো। খাগড়াছড়িতে গত ১ অক্টোবর আরো একটি প্রাণ ঝরে গেল। ছড়িয়ে পড়লো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ।
১৯৭১ সাল থেকে পাহাড়ের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তিন জেলার মধ্যে খাগড়াছড়িই সবচেয়ে সংঘাতময় এলাকা। আবার অধিকাংশ শান্তি সংলাপ, শান্তি আলোচনা খাগড়াছড়িতেই সংঘঠিত হয়েছে। খাগড়াছড়ির তরুনদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। খাগড়াছড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আশা করি, আগামী দিনে তরুন প্রজন্ম খাগড়াছড়ি থেকেই শান্তির নতুন পদযাত্রা শুরু করবে। এই নিবন্ধে খাগড়াছড়ি অঞ্চলে শান্তি, সংঘাত ও তরুন প্রজন্মের কিছু ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো। বিরোধের বারুদে ঠাসা সবুজ পাহাড় গত ১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ দুপুরে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল
এন্ড কলেজের একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ছাত্রী বা পাহাড়ি ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহম্মদ সোহেল রানাকে পিটিয়ে হত্যা করে পাহাড়ি শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা। এ ঘটনার জেরে বিকাল থেকে শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। দিনভর দফায় দফায় উভয় পক্ষের সংঘর্ষে বেশ কয়েকটি মোটর সাইকেলে আগুন, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও আগুন দেয়া হয়। এ সময় টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের বিভিন্ন কক্ষ ও আসবাব পত্র ভাংচুর করা হয়ে। এ সময় কল্যানপুর এলাকায় পাহাড়িদের মধ্যে থেকে সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের দিকে গুলি ছুড়লে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে সেনা বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এক পর্যায়ে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। উভয় পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা প্রশাসন ৪
সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গত ৯ অক্টোবর, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন- ‘‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’’। উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে গণপিটুনীতে একজন বাঙালি যুবকের মৃত্যু কেন্দ্র করে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও সহিংসতামূলক ঘটনা ঘটে। এতে ৪ জন পাহাড়ি তরুন নিহত হয়। তখন মনে হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় যেন পাহাড়ি-বাঙালির বিরোধ ও অবিশ্বাসের বারুদে ঠাসা। পাহাড়ের চলমান সার্বিক পরিস্থিতিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আসন্ন কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ। অন্যদিকে, ৮ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটকদের ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সংঘাতময় খাগড়াছড়ি- একটি পর্যালোচনা।
১৯৭১ সাল থেকে পাহাড়ের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তিন জেলার মধ্যে খাগড়াছড়িই সবচেয়ে সংঘাতময় এলাকা। আবার অধিকাংশ শান্তি সংলাপ, শান্তি আলোচনা খাগড়াছড়িতেই সংঘঠিত হয়েছে। খাগড়াছড়ির তরুনদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। খাগড়াছড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আশা করি, আগামী দিনে তরুন প্রজন্ম খাগড়াছড়ি থেকেই শান্তির নতুন পদযাত্রা শুরু করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫৪ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, খাগড়াছড়ি জেলা অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে সংঘাতময় অঞ্চল। এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বেশী হয়েছে। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে খাগড়াছড়ির (মাটিরাঙ্গা থানা) তাইন্দং বিওপির নিকটবর্তী আসালং মৌজায় প্রচন্ড সীমান্ত-যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেই সময় ভারতীয় বাহিনী ফেনী নদী/আসালং খাল অতিক্রম করে আসালং মৌজার কিছু অংশ দখল করলে তৎকালীন ইপিআর ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর (৬ এফএফ) একটি শক্তিশালী দল সেখান থেকে তাদের উৎখাতের জন্য আক্রমণ পরিচালনা করে। সেনাবাহিনী থেকে আসা কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর সি আর দত্ত (পরে মেজর জেনারেল, বীর উত্তম, প্রয়াত)। মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ীদের একটি অংশ পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৭১ এর ৫ ডিসেম্বর
মুক্তিবাহিনীর কিছু সদস্য খাগড়াছড়ির পানছড়ি অঞ্চলে পাহাড়িদের উপর নৃশংস ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর পর থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যস্থানেও পাহাড়ি- বাঙালিদের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হয়। গণ মুক্তি ফৌজ থেকে শান্তিবাহিনী ৭ জানুয়ারি ১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র শাখা ‘গণ মুক্তিফৌজ’ গঠিত হয়েছিল । তবে পরবর্তীতে এটি ‘শান্তিবাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭৪ সালে
দীঘিনালা, আলীকদম ও রুমায় সেনাবাহিনীর গ্যারিসন স্থাপিত হয়। আভিযানিক বিবেচনায়, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত খাগড়াছড়ি অঞ্চলে শান্তিবাহিনী সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। এর অন্যতম কারণ হলোঃ খাগড়াছড়ি অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি, ভারতীয় সীমান্তের (ত্রিপুরা) নিকটবর্তিতা, ভূমির বৈশিষ্ট্য (ছোট পাহাড় ও সমতল ভূমি), বাঙালি বসতির আধিক্য ইত্যাদি। একসময়, খাগড়াছড়ির উত্তরাঞ্চল ছিল শান্তিবাহিনীর ‘‘অলিখিত রাজধানী’’। শান্তিবাহিনীর (ইনসারজেন্সীর) ‘বসন্তদিনে’, খাগড়াছড়ি অঞ্চলে সম্ভবত এমন কোন দিন ছিলনা- যেদিন নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর গুলি বিনিময় হয়নি। শান্তিবাহিনীর অ্যামবুশের জন্য বহুল আলোচিত একটি রাস্তাকে তখন ‘দি স্ট্রিট উইথআউট জয়’ বা ‘আনন্দহীন সড়ক’ বলা হতো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তাবাহিনী যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল- তার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনও হয়নি।
শান্তিবাহিনী এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি আন্তর্জাতিককরণের মনোযোগ দেয়। সেই উদ্দেশ্যে কৌশল হিসেবে, ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল শান্তিবাহিনী পুনবার্সিত বাঙালি গ্রামগুলিতে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় কোন কোন স্থানে বাঙালিরাও পাহাড়ি গ্রামে আক্রমণ করে। ফলশ্রুতিতে শুরু হয় ভয়াবহ সংঘাত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিশেষত খাগড়াছড়ি জেলা থেকেই ৫০ হাজারের বেশি আতংকিত পাহাড়ি শরনার্থী ভারতের
ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে। অন্যদিকে নিরপত্তার জন্য বাঙালিদের ৫৬ টি গুচ্ছগ্রামে পুনবার্সিত করা হয়। এসবের জন্য পরে ভূমির জটিলতা বৃদ্ধি পায়। মুজিব নগরের বিকল্প রামগড়-ফিরে দেখা ইতিহাস ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিরোধের এক পর্যায়ে, খাগড়াছড়ির রামগড় (এক সময়ের মহকুমা সদরদপ্তর) সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক ও প্রশাসনিক সদর দপ্তরে পরিনত হয়েছিল। তৎকালীন ৮ ইষ্ট বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার (অধিনায়ক) ও চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘আঞ্চলিক কমান্ডার’ মেজর জিয়াউর রহমান (পরে লেঃ জেনারেল, সেনাপ্রধান, প্রেসিডেন্ট, বীর উত্তম) এর নেতৃত্বে নিবেদিত-প্রাণ মুক্তিযোদ্ধাগণ ২ মে ১৯৭১ পর্যন্ত এই অঞ্চলকে স্বাধীন রেখেছিল। এই সময় ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর এর সেক্টর-এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে মেজর, সেক্টর কমান্ডার, মন্ত্রী, লেখক, বীর উত্তম) অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। রামগড়ে ঘুমিয়ে আছেন মহালছড়ি যুদ্ধের (মিজোবাহিনী- মুক্তিবাহিনী) অন্যতম বীর শহীদ ক্যাপ্টেন এম আফতাবুল কাদের, বীরউত্তম। রামগড়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে অনেক পাহাড়ি তরুন অংশগ্রহণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৭৭৫ সালের ২৯ জুন এই রামগড়ে গঠিত হয় ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ নামে একটি আধাসামরিক বাহিনী। এই বাহিনীই বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি নামে পরিচিত।
ঐ সময় ‘মুজিবনগর’ এর বিকল্প হিসেবে রামগড়েই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দপ্তর প্রতিষ্ঠা করার চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। ২৯ এপ্রিল রামগড় পরিদর্শনে এসেছিলেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ বা প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এমএজি ওসমানী (পরে জেনারেল)। তিনি যেকোন উপায়ে রামগড় নিরাপদ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে অবশেষে ২ মে রামগড়ের পতন হয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ ফেনী নদী পেরিয়ে ত্রিপুরার সাবরুমে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চর্চায় রামগড় একটি অবহেলিত অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধে মং রাজা ও পাহাড়ি নারীদের সেবা-সহায়তা মং সার্কেল চীফ ও রাজা মং প্রু সাইন রামগড় এলাকার প্রতিরোধ যুদ্ধে নিজস্ব অস্ত্র, গাড়ি ও রসদ দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেন। ১৯৭১ মার্চ-এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ হাটহাজারি-নাজিরহাট-মানিকছড়ি-রামগড় হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যেতে শুরু করে। নর-নারী শিশুসহ আবাল বৃদ্ধ-বনিতার ঐ জনস্রোত মানিকছড়ি এসে জমায়েত হয়। ক্রমেই রাজা মং প্রু সাইনের মানিকছড়ি রাজবাড়িটি অসহায় (বাঙালি) জনতার আশ্রয় কেন্দ্রে পরিনত হয়। বাঙালিদের জন্য রাজা তার রাজ ভান্ডার খুলে দিয়েছিলেন। রানী নিহার দেবী নিজেই ধাত্রী হিসেবে লেগে যান অসুস্থ্য গর্ভবতী মা- বোনদের চিকিৎসা সেবায়। রানীকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে পাহাড়ি মা-বোনেরা। সে ছিল অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেক পরে, মানিকছড়ি- লক্ষীছড়ি অঞ্চলে চাকুরী করার সময়ে বাঙালিদের প্রতি পাহাড়ি জনগণের এই সেবা ও সহায়তার ঘটনা বিশদভাবে শুনবো মং রাজার জামাতা
‘রাজীব রায়’ এর থেকে। উল্লেখ্য, রামগড় পতনের পর মং রাজা ত্রিপুরা চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন (মং রাজার মুক্তিযুদ্ধ, লেঃ কর্ণেল এস আই এম নুরুন্নবী খান, বীর বিক্রম)। পাহাড়ে নতুন শিল্পের সমাহার! ১৯৯৭ সালে ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তিচুক্তি নামে অধিক পরিচিত) স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালেই খাগড়াছড়িতে শাক্তিচুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক দল ‘ইউপিডিএফ’ গড়ে ওঠে। শুরু হয় পাহাড়ি-পাহাড়ি ভ্রাতৃঘাতি রক্তাক্ত যুদ্ধ। এটি এখনও চলছে। বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ৪টি আঞ্চলিক দল (সশস্ত্র শাখাসহ) রয়েছে। এখন পাহাড়ে বড় ধরনের কোন শিল্প (ইন্ডাষ্ট্রি) নাই বললেই চলে। তবে ‘চাঁদাবাজি’ প্রায় শিল্পের (আর্ট) পর্যায়ে চলে গেছে। দুধর্ষ ‘চাঁদাবাজদের’ অত্যাচারে পাহাড়ের মানুষ অতিষ্ঠ। বিশেষত পাহাড়ি জনগণ। আঞ্চলিক দলগুলোর আদর্শিক দ্বন্দ তেমন কিছু নেই। মূল বিষয়টি হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজি। দারিদ্য, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, বেকারত্ম, নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও সাম্প্রদায়িক রেষারেষি পাহাড়ি তরুনদের মধ্যে হতাশা তৈরী করেছে। শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে জেলা পরিষদের অধীনে বেশ কিছু চাকুরী সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ দিন পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরীকালীন সময়ে ঘুষ- দুর্নীতির কথা তেমন শুনিনি। কিন্তু এখন শোনা যায়, একদল
পার্বত্যবাসী ঘুষ-দুর্নীতিতে, সমতলের ‘দুর্নীতিবাজদের’ সঙ্গে প্রায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে! একসময় সরকারি উদ্যোগে আনা পুনর্বাসিত
বাঙালিদের অনেকে ‘গুচ্ছগ্রামে’ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। ঢাকার মিডিয়ার উজ্জল রশ্মি বাঙালিদের গুচ্ছ গ্রামে পড়তে দেখা যায় না। এই জেলায় পাহাড়ি-বাঙালিদের ভূমি সমস্যাটিও সবচেয়ে জটিল। অপতথ্য ও ঘৃণা ছড়ানোর নতুন যুদ্ধ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতার সময় হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি ছড়িয়েছে ভুয়া ও অপতথ্যও। ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর ওই দুই জেলায় মোট পাঁচজন নিহত হন (বাঙালি যুবকসহ)। যদিও অপতথ্য ছড়ানো কিছু ফেসবুক পেজ, এক্স হ্যান্ডল (টুইটার) এবং ইউটিউব চ্যানেলে নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি বলে দাবি করা হয়। কোথাও কোথাও বলা হয়, নিহত হয়েছেন ১০০ জনেরও বেশি। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সাম্প্রতিক সহিংসতা নিয়ে তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ‘৪ থেকে ১০০: পাহাড়ে সহিংসতায় অপতথ্যের রাজনীতি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তারা বলছে, অপতথ্য ছড়ানোর সঙ্গে বাংলাদেশি দাবি করা ব্যক্তিরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিল ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কিছু অনলাইন পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি (প্রোফাইল)। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন বলছে, দীঘিনালায় ১৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হলে এর আড়াই ঘণ্টার মধ্যে (রাত ১২টা ৫৪ মিনিট) জুম্ম নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে দাবি করা হয়, খাগড়াছড়িতে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৩২ জন। ডিসমিসল্যাব বলছে, জুম্ম নামের ফেসবুক পেজটি তৈরি করা হয়েছে ঘটনার এক দিন আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর। এই পেজের আইডিতে ব্যবহার করা ছবিটি আসলে ভারতের ত্রিপুরার অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য জুম্ম টাইমসের লোগো। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে রূপম নামের আরেকজন ভারতীয় পরিচয়দানকারী ইনফ্লুয়েন্সারের কথা বলা হয়েছে। ‘রূপম দ্য
এক্সপ্লোরার’ নামে পেজে একটি ভিডিওতে শিরোনাম দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশি মুসলিমদের হাতে নৃশংসভাবে শতাধিক ব্যক্তি নিহত; আফগানিস্তানের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।’ ভিডিওটিতে মন্তব্য এসেছে সাড়ে তিন শর বেশি মানুষের। সেটি শেয়ার হয়েছে ৩০ হাজারের বেশিবার। ডিসমিসল্যাব বলছে, হিল ব্লাড, বাবা বেনারস, ভয়েস অব বাংলাদেশি হিন্দুজসহ বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডল থেকে মৃত্যুর ভুয়া সংখ্যা প্রচার করা হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের সময়ও বাংলাদেশে পাহাড়ের সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যুর ভুয়া সংখ্যা বলা হয়েছে। দেশটির বিভিন্ন সুপরিচিত গণমাধ্যম সেটা ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রাণহানির ভুল সংখ্যা ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আঞ্চলিক নেতারা কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের রাজনৈতিক প্রচারণায়ও তা ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের পাহাড়ে সহিংসতা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে পৃথকভাবে স্মারকলিপি দেয় বিজেপি মিজোরাম সিএডিসি কমিটি এবং ত্রিপুরা স্টেট লেভেল চাকমা ইয়ুথ অর্গানাইজেশন।
ফেসবুকের রণক্ষেত্র অসংখ্য জাতি-বিদ্বেষপূর্ণ লেখা কনটেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে অনলাইনে। স্বভাবতই এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে পাহাড়ে। বাড়ছে ঘৃণার চাষবাস। কেউ জোর করেই ‘জুম্মল্যান্ড’ চাপিয়ে দিচ্ছেন আন্দোলনরত পাহাড়িদের কাঁধে। অন্যদিকে, সত্যি সত্যিই এ ধরনের ষড়যন্ত্র (জুম্মল্যান্ড) হচ্ছে কিনা, তা যাচাই অনুসন্ধানের কার্যকরী উদ্যোগ নেই-এমন সমালোচনাও আছে। ফেসবুক নানা বিদ্বেষী কনটেন্ট দিয়ে উত্তেজিত করে তুলছে। পাহাড়িদের বিভিন্নভাবে অপমান করার বিষয়টি বহুল আলোচিত। অন্যদিকে কিছু উগ্র পাহাড়ি, বাঙালিদের ‘সেটেলার’ বলে অপমান করছে। ‘আদিবাসী’ ইস্যু নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করার মানষিকতা কি আমাদের দিন দিন কমে যাচ্ছে? অন্যদের সাফল্যের গল্প থেকে শেখা পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর দীর্ঘ দিনের (১৯৭৬-১৯৯৭) সশস্ত্র বিদ্রোহের (ইনসারজেন্সি) পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু পাহাড়ে এখনও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই চুক্তি অঞ্চলটির সমস্যা সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘কাঠামো’ হিসেবে কাজ করছে। চুক্তিটি কিছুটা হলেও স্থিতিশীলতা এনেছে। সরকার ও পাহাড়ি জনগণের মধ্যে আলোচনার একটি প্লাটফর্ম’ প্রদান করেছে।
এই ধরনের ইনসারজেন্সি উত্তর পূর্ব ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সংঘঠিত হয়েছে। অনেক দেশে সরকার ও বিদ্রোহিদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর, সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করায় শান্তি ফিরেছে। কিন্তু অনেক অঞ্চলে চুক্তির পরেও শান্তি আসেনি। এক্ষেত্রে সফল কিছু উদাহরণ যেমন- ফিলিপাইনের মিন্দানাও, উত্তর আয়ারল্যান্ড,
শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে জেলা পরিষদের অধীনে বেশ কিছু চাকুরী সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ দিন পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরীকালীন সময়ে ঘুষ- দুর্নীতির কথা তেমন শুনিনি। কিন্তু এখন শোনা যায়, একদলপার্বত্যবাসী ঘুষ-দুর্নীতিতে, সমতলের ‘দুর্নীতিবাজদের’ সঙ্গে প্রায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে!
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ, পাপুয়া নিউ গিনির বুগাইনভিল এর পোষ্ট- একোর্ড রেজুলেশন এফোর্টস বা চুক্তি পরবর্তী সমাধান উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এই ধরণের কেস স্ট্যাডিগুলো পর্যালোচনা করে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে উপযোগী উদ্যোগ কাজে লাগাতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মেধাবী (তরুন) স্কলার, আইনজীবি, শিক্ষক, গবেষক ও রাজনীতিবিদগণ এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছিল শান্তির সংলাপ খাগড়াছড়িতে শুধু সংঘাত অশান্তি নয়। এখানেই শান্তিবাহিনীর মূল নেতৃত্বের সঙ্গে শুরু হয়েছিল প্রত্যাশিত শান্তির সংলাপ। তবে এর আগে ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে, শান্তিবাহিনীর ‘প্রীতি গ্রুপের’ সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি আলোচনা হয়। যা ফলপ্রসু হয়েছিল। খাগড়াছড়ির উত্তরে পানছড়ি উপজেলা অবস্থিত। পানছড়ির সীমান্তবর্তী পুজগং চেঙ্গি কমিউনিটি সেন্টারে ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর তারিখে প্রথমবারের মতো (বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে) সেনাবাহিনী ও জেএসএস (মূল নেতৃত্ব) এর সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষে এর নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় ব্রিগেড কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি এম মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম (পরে মেজর জেনারেল)। এই দুঃসাহসিক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতির প্রয়োজনে শুধুমাত্র দুই সেনাকর্মকর্তাসহ বেসামরিক পোষাকে অস্ত্রহীন অবস্থায় জীবনের হুমকি থাকা সত্ত্বেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ঐদিন শান্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শান্তিবাহিনীর বিশিষ্ট নেতা রুপায়ন দেওয়ান (মেজর রিপ)। অনেক পরে দুজনের কাছ থেকেই সে রোমাঞ্চকর ঘটনা শোনার সুযোগ
হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন ধাপে শান্তিবাহিনী ও পাহাড়ের সামাজিক নের্তৃবৃন্দের সঙ্গে শান্তির সংলাপ, আলোচনা হয়েছে। যার অধিকাংশ হয়েছে এই খাগড়াছড়ি অঞ্চলে। পরবর্তীকালে (১৯৮৭-১৯৮৯), খাগড়াছড়ি অঞ্চলের তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার, কর্ণেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক (পরে মেজর জেনারেল, কল্যান পার্টির চেয়ারম্যান, এমপি, লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক) শান্তি আলোচনায় অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই জেনারেল ছিলেন আলোচনার অন্যতম অংশীদার এবং প্রক্রিয়ার অনুঘটক। এইসব ঘটনা তিনি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ- পরিস্থিতির মূল্যায়ন’’ নামক তাঁর গ্রন্থে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর এটি একটি অন্যতম অবশ্য-পাঠ্য গ্রন্থ বলে অনেকে মনে করেন। রাইফেলের পরিবর্তে সাদা গোলাপ শান্তিচুক্তি শর্তানুসারে, এই খাগড়াছড়ি ষ্টেডিয়ামে ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন জেএসএস পার্টি প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সনতু লারমা)। রাইফেল নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাকে দিয়েছিলেন একজোড়া সাদা গোলাপ। সেদিন ছিল পাহাড়ি-বাঙালির স্মরণকালের বিশাল মিলন মেলা। আম ও পেঁপের নতুন রাজধানী খাগড়াছড়িতে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। একবার সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নেওয়া খাগড়াছড়ির লিচু কুয়েত সেনাবাহিনীতে হৈ চৈ তুলেছিল। শান্তিবাহিনীর অলিখিত রাজধানীর পরিবর্তে খাগড়াছড়ি এখন যেন আম (আম্রপলি) ও পেঁপের রাজধানী। খাগড়াছড়ির কৃষক ও কৃষি- উদ্যোক্তাদের সালাম। শোনা যায়, চাঁদাবাজদের চাপে খাগড়াছড়ির আম নাকি একবার আলু টিলা পাহাড় অতিক্রম করে সমতলে আসতে পারেনি! পাহাড়ের তরুনদের চাকুরী ও কর্মস্থান সৃষ্টিতে সরকারের গুরুত্ব দিতে হবে। দূরদর্শী লেখক আহমেদ ছফা, পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে পাহাড়ি উদ্যমী তরুনদের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর কথা বলেছিলেন। এই অঞ্চলে কৃষি, পর্যটন ও শিল্প এর উপর ভিত্তি করে সরকারের উচিত ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। পাহাড়ে ভালো সংবাদের সন্ধানে পাহাড়ে কিছু ভালো সংবাদের কথা ভাবি। পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন প্রায় শান্ত হয়ে এসেছে। এখন সবুজ পাহাড়ে জুমের ফসল ঘরে তোলায় ব্যস্ত পাহাড়ি জুমিয়ারা। সবার হয়তো ভালো ফসল হয়নি! তবুও তাদের মুখে কি অনাবিল হাসি। ‘সংচাং ম্রো’ নামে ম্রো নৃ-গোষ্ঠির একজন তরুনী সম্প্রতি ডাক্তারি পাশ করেছে। সে ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথম নারী
ডাক্তার। মনে পড়ছে আমার অকাল প্রয়াত বন্ধু, ডাক্তার মং স্টিফেন চৌধুরীর (ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ) কথা। কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনার (প্রথম জেলা সদর) মানুষ এখনও তাঁকে স্মরণ করে। খাগড়াছড়ি থেকে বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নারী সামরিক বাহিনী ও পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। বেশ কয়েকজন বাঙালি তরুন বিসিএস কর্মকর্তা হয়েছেন। কয়েকজন বাঙালি তরুন মিডিয়ায় আলো ছড়াচ্ছেন। সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ-২০২২ এ বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছিল। এই দলে ৫ জন নারী ফুটবলার ও সহকারী কোচ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। এর মধ্যে ৩ জন ফুটবলার ও কোচ ছিল খাগড়াছড়ি থেকে। গত আগষ্টের বন্যায় খাগড়াছড়ি প্লাবিত হয়ে বিপর্যয়ে পড়ে
লক্ষ্যাধিক মানুষ। বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করেছিল খাগড়াছড়ি অঞ্চলের সেনাবাহিনী। সমতল থেকেও অনেকে সাহায্য করেছিল। তখন কে পাহাড়ি কে বাঙালি সেসব বিবেচনা ছিল না। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিষন্ন সময়কালে (সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ির মানুষ এই সম্প্রীতিপূর্ণ ঘটনারকথা ভাবছিলেন। গত ৫ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন লেখা, গবেষণা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণ নিয়ে একটি সংকলিত বই (হিল ট্রাক্টস অফ বাংলাদেশ) প্রকাশিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ও খাগড়াছড়ির কৃতি সন্তান- নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা এই বইটির সম্পাদক।
খাগড়াছড়ির তরুনদের প্রতি সতর্কবানী আমাদের জনগণ এখন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, পাহাড়ে ঘটলো উল্টো ঘটনা। সেখানে ‘রিকনসিলিয়েশন ও ইনক্লুসিভনেস’ এর পরিবর্তে আমরা কিছু উগ্র কন্ঠস্বর ও বিভক্তির আওয়াজ পেলাম। দাঙ্গার সময় পাহাড়ি বাঙালি উভয় পক্ষে উগ্রবাদী কর্মকান্ড চোখে পড়েছে। খাগড়াছড়ি সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রচারণামূলক কর্মকান্ড আবার আলোচনায় এলো। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। পাহাড়ি তরুনদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। তাদের উগ্রবাদ বা বিপথে নেওয়ার জন্য দেশে বিদেশে দুষ্টু মানুষ ও সংগঠনের অভাব নেই।কোন উস্কানিতে তাদের পা দেওয়া উচিত না। বান্দরবানের বম নৃ-গোষ্ঠির উগ্রপন্থী তরুনরা (কেএনএফ) এখন তাদের ভূল বুঝতে পারছে। অথচ তাদের হঠকারিতার কারণে কতো মানুষের জীবন তছনছ হয়ে গেলে। বাঙালি তরুনদেরও খুব সতর্ক থাকতে হবে। স্যোশাল মিডিয়ায় অনেকে ভূল তথ্য ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন জাতি কোথা থেকে কবে এসেছে-এ নিয়ে বাংলাদেশের নব্য হিরোডোটাসদের (ইতিহাসবিদ) চোখে ঘুম নেই। তাদের মনগড়া বয়ানে ফেসবুক উতপ্ত। ফেসবুক ইতিহাসবিদদের থেকে উভয় পক্ষকে খুব সাবধান হতে হবে। রোহিঙ্গারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয়
নিচ্ছে- এমন আলোচনা পাহাড়ে চলছে। সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা। এটা কোনভাবেই অনুমোদন করা উচিত না। খাগড়াছড়ি রুখিয়া দাঁড়াও বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকার, সেনাবাহিনী ও পাহাড়ি নেতৃত্ব অনেক ভুল করেছে। এর থেকে উত্তরনে নতুন প্রজন্মকে ভাবতে হবে। পাহাড়ি-বাঙালি নতুন প্রজন্মকে একই সঙ্গে পাহাড়ে থাকতে হব। পূর্ব প্রজন্মের ভূলগুলো, দুর্বলতাগুলো সংশোধন করে নুতন পথে হাটতে হবে। এক পরিবার হয়ে থাকতে হবে। ভবিষ্যতে শান্তি স্থাপনের
ক্ষেত্রে তরুন প্রজন্মের ভূমিকার উপর বিস্তারিতভাবে লেখার ইচ্ছা রইল। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষ। তখন একটি প্রচার পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ‘‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’’। গঠিত হয়েছিল দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি। আশা করি, সন্ত্রাস, নির্যাতন, অশান্তি, ষড়যন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে- আগামী দিনে খাগড়াছড়ির তরুনদের প্রচার পত্র হবেঃ ‘‘খাগড়াছড়ি রুখিয়া দাঁড়াও”, “পার্বত্য চট্টগ্রাম রুখিয়া দাঁড়াও”। “বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’’। খাগড়াছড়িসহ পাহাড়ের তরুন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, এনজিও- কর্মী, লেখক, সাস্কৃতিক-কর্মী, আইনজীবি, শিক্ষক, একাডেমিয়া, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, চিকিৎসক, উদ্যোক্তা ও এক্টিভিস্টদের অনেক দায়িত্ব। শান্তিচুক্তি ও ভূমি সমস্যার এই অচলায়তন তরুনদের ভাঙতে হবে। সমাধানের জন্য নতুন ধারনাও দিতে হবে। তাদের এক সঙ্গে পথ চলতে হবে। কাউকে পিছনে ফেলে রাখা উচিত না। উদার বাংলাদেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে আমাদের সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও জনজাতির সুরভিত ফুল ফুটুক। বিরোধের বাঁধ নয়, পাহাড়ে গড়ে উঠুক
সম্প্রীতির সুবর্ণ সেতু। আমি আশা করি যে, আগামী দিনে রক্তাক্ত সংঘাত থেকে শান্তির পথে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি বাঙালি তরুনরা পথ দেখাবে। ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশ গঠনের দিকে নতুন যাত্রা শুরু হোক খাগড়াছড়ি থেকেই। শান্তি নামুক আমাদের সবুজ পাহাড়ে।
লেখক: গবেষক, বিশ্লেষক
[email protected]
সূত্র : কালবেলা