বিজয়ের ৫১ বছর পার করল বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বিজয় দিবস মানেই আনন্দ, উৎসব।
ডিসেম্বরজুড়ে দেশ থাকে উৎসবমুখর। কিন্তু এবার বাঙালির বিজয়ের মাস ছিল অন্যরকম। রাজনৈতিক উত্তেজনা আমাদের বিজয় উৎসবকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে। এর মধ্যে নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে বিএনপি ঢাকায় মহাসমাবেশ করেছে। বিএনপির সাত সংসদ সদস্যের মধ্যে ছয়জন ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। শূন্য আসনগুলোতে উপনির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের সমাবেশ থেকে বিএনপি ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দলটি যুগপৎ আন্দোলন করার ঘোষণাও দিয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর ১০ দফা দাবিতে একটা বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করে। ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। ওই দিন বিএনপি গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিল। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির দিন বিএনপি কীভাবে এই কর্মসূচি দিল পরে অবশ্য বিএনপি তাদের গণমিছিলের তারিখ পরিবর্তন করে। কিন্তু এ ঘটনায় বিএনপির গোপন অভিপ্রায়টা বেরিয়ে এসেছে।
একটা সহিংস বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। প্রশ্ন হলো- ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কেন সংঘর্ষ করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াও করতে হবে। লাশ ফেলতে হবে। তার মানে কি বিএনপির আন্দোলন নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয় অন্য কাউকে ক্ষমতায় আনার জন্য বিএনপি কি তাহলে একটি ভাড়াটে রাজনৈতিক দলে পরিণত হলো। যে রাজনৈতিক দল অন্যের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে। শুধু ২৪ ডিসেম্বরের গণমিছিলের তারিখ ঘোষণা নয়।
দেশের অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দলটি কিছু দিন ধরেই অসহিষ্ণু আচরণ করছে। এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিএনপি নেতাদের মধ্যে। ঢাকায় মহাসমাবেশের কথাই ধরা যাক। বিএনপি বলল নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিলেন। ঢাকা শহরে সমাবেশ করার সবচেয়ে ভালো জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আওয়ামী লীগ এখানে বহু সমাবেশ করছে। বিএনপিও করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও করে। কিন্তু হঠাৎ বিএনপি কেন গোঁ ধরল তা বোঝা গেল না। ১০ ডিসেম্বর বিএনপি গোলাপবাগে যা করেছে, তা তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করা যেত। তাহলে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে এত উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা কেন ৭ ডিসেম্বর থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কেন জড়ো হতে শুরু করলেন। ১৬০ বস্তা চাল, বিপুল পানি দিয়ে বিএনপি কী করতে চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত তো নয়াপল্টনে বিএনপি সমাবেশ করতে পারল না। ৭ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকারের কথোপকথনটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ধৈর্যহারা করার সব চেষ্টাই বিএনপি মহাসচিব করেছেন। কিন্তু বিপ্লব প্রচণ্ড ধৈর্য, সহনশীলতা এবং বিনয়ের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। ৭ ডিসেম্বরের ঘটনার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। এর ফলে বিএনপি পিছু হটল। বিকল্প স্থানে শেষ পর্যন্ত সমাবেশও করল। প্রমাণিত হলো, সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিএনপির সমাবেশে বাধা দিতে চায়নি। সমাবেশের নামে কোনো জনবিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা যেন সৃষ্টি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। নয়াপল্টনে সমাবেশ করে বিএনপি কী অর্জন করতে চেয়েছিল
এই সমাবেশে সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপির সাত সংসদ সদস্যের পদত্যাগের ঘোষণা। ১১ ডিসেম্বর ছয় সংসদ সদস্য স্পিকারের কাছে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ আছে মাত্র এক বছর। এ সময়ের মধ্যে মাত্র সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করে আসলে কী বার্তা দিলেন ২০১৮-এর নির্বাচনের পর বিএনপি প্রথমে বলেছিল, তারা এই সংসদ মানে না। সংসদ সদস্য হিসেবে তারা শপথ নেবেন না। এরপর চুপিসারে গোপন অভিসারে যাওয়ার মতো বিএনপির সংসদ সদস্যরা একে একে শপথ নেন। (শুধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া)।
নারী কোটায় রুমিন ফারহানাকেও মনোনয়ন দেয় বিএনপি। সংসদে কিছু ঝড়ো বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া বিএনপির সংসদ সদস্যদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। মাঠের রাজনীতি আর সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। সুধাংশু শেখ হালদার, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শাহ আজিজ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তোফায়েল আহমেদ জাতীয় সংসদে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন। তারা কার্যপ্রণালি বিধি জানতেন, আইন জানতেন, সংসদীয় রীতিনীতি সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা করতেন। রুমিন ফারহানা কিংবা হারুন অর রশীদের মতো চিৎকার করে গালি দিলেই সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন হয় না। গভীরতা লাগে, প্রয়োজন পাণ্ডিত্য। আমার বিবেচনায় বিএনপির সংসদ সদস্যদের খিস্তির চেয়ে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, পীর মিসবাহ অনেক পরিণত এবং সংসদীয় রীতি অনুযায়ী দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন। তাই রুমিন ফারহানাদের সংসদ থেকে পদত্যাগে সংসদে কোনো অপূর্ণতা সৃষ্টি হবে বলে আমি মনে করি না। এতে সংসদের কোনো ক্ষতি হবে না।
সংসদ থেকে বিরোধী দল বা অন্য কোনো সংসদ সদস্যের পদত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরপর জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে বিএনপি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮৮ আসনে জয়ী হয়েছিল। মাগুরা এবং মিরপুর উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সব সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৪ সালের ৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা লিখিত পদত্যাগপত্র বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার কাছে জমা দেন। ২৪ ডিসেম্বর পদত্যাগপত্রগুলো স্পিকারের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু স্পিকার এই পদত্যাগপত্র গ্রহণে গড়িমসি করেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সার্বভৌম। কিন্তু বিএনপি সংসদের বিষয় নিয়ে যায় হাই কোর্টে। বিএনপির অনুগত ক্যাডারদের কয়েকজনকে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
বিএনপি যতবার ক্ষমতায় গেছে ততবার দলীয় ক্যাডারদের বিচারপতি করে গেছে) এদেরই একজন ছিলেন বিচারপতি মনোয়ার উদ্দিন। ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি মনোয়ার এক নজিরবিহীন রায় দেন। ওই রায়ে সংসদ বর্জনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। বিরোধী সদস্যদের সংসদে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের ওপর এটি ছিল সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ। বিরোধী দলের পদত্যাগ ঠেকাতে তৎকালীন বিএনপি সরকার এই কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল। কারণ জাতীয় সংসদ থেকে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য পদত্যাগ করলে সংসদ অর্থহীন হয়ে যায়। এতগুলো আসনে নির্বাচন অবাস্তব। এবার অবশ্য সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে বিরোধী ছয় সদস্যের পদত্যাগের বিষয়টি ফয়সালা করেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দ্রুততার সঙ্গে। ফলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি ’৯৪ সালে বিরোধী সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ ঠেকাতে নানা কূটকৌশল করেছে। আদালতকে পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্মোহভাবে আইন অনুসরণ করেছে। প্রশ্ন হলো- সংসদে গুরুত্বহীনভাবে থাকা, আলো ছড়াতে না পারা, শুল্কবিহীন গাড়িসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়া এই ছয়জন পদত্যাগ করে বিএনপির আন্দোলনের কী লাভ হলো এটিও বিএনপি অন্যের জন্য করেছে। বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ তাদের আন্দোলনকে বেগবান করবে না। কিন্তু এই পদত্যাগ বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় কিছুটা শক্তি দেবে। আমাদের সুশীলরা বলতে পারবে, সংসদে বিএনপির মতো শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। তাদের পরামর্শে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বলবেন, জাতীয় সংসদ অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়।
অর্থাৎ আরেকটি এক-এগারো সৃষ্টির পটভূমি তৈরির জন্যই কি অসময়ে এই পদত্যাগ নাটক বিএনপির আন্দোলন যে অন্য কারও ইশারায় তা বোঝা যায় ১০ ডিসেম্বর ঘোষিত বিএনপির ১০ দফা থেকে। বিএনপির প্রধান দাবি হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন। ১০ দফার মধ্যে প্রথম তিনটি দাবি শুধু নির্বাচন-সংক্রান্ত। এর মধ্যে প্রথম দাবির সঙ্গে আবার চার থেকে ১০ দফা দাবি সাংঘর্ষিক। প্রথম দফায় বলা হয়েছে, ‘বর্তমান অনির্বাচিত অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ভোটবিহীন, গণতন্ত্র হরণকারী, লুটেরা ফ্যাসিস্ট সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ’
এই দাবি নিয়ে আমার দুটি বিভ্রাট। প্রথমত, সংসদ যদি ‘অনির্বাচিত’ এবং ‘অবৈধ’ হবে তাহলে চার বছর ধরে বিএনপির সংসদ সদস্যরা সেখানে থাকলেন কীভাবে। শুধু থাকলেন না, বেতন-ভাতা নিলেন। রুটি মাখন খেলেন। নানা সুযোগ-সুবিধা খেলেন চেটেপুটে। ‘অনির্বাচিত’ এবং ‘অবৈধ’ সংসদে বিএনপি কীভাবে এত দিন বসবাস করল দ্বিতীয়ত, আপনি যখন সরকারকে অবৈধ বলবেন, তখন তার কাছে আবার দাবি-দাওয়া পেশ করেন কোন লজ্জায়। ‘অবৈধ সরকারের’ কাছে তো কেউ কিছু চাইতে পারে না। নৈতিকভাবেও এটা চাওয়া উচিত নয়। আইনগতভাবেও এটা সম্ভব নয়। কিন্তু বিএনপি তাদের ভাষায় ‘অবৈধ সরকারের’ কাছে আবদারের এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছে। যে সরকারকে তারা মানে না, সেই সরকারের কাছেই বেগম জিয়ার মুক্তি চেয়েছে। বিরোধী নেতা-কর্মী, পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী সব মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল চেয়েছে। অবৈধ সরকারকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে বলা হয়েছে ১০ দফায়। বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বলা হয়েছে।
‘অবৈধ সরকারকে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার’ কথাও আছে বিএনপির দাবিনামায়। বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করার জন্য সরকারকে কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে ১০ দফায়। গুম হয়ে যাওয়া মানুষ উদ্ধার, প্রশাসন বিচার বিভাগে পেশাদারিত্বের প্রতিষ্ঠার কথাও আছে তালিকায়। বিএনপির যে দাবিনামা তা বাস্তবায়ন করতে যে কোনো অতি দক্ষ এবং তৎপর একটি সরকারেরও তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে।
বর্তমান সরকারের এ মেয়াদে সময় আছে মাত্র এক বছর। তাহলে বিএনপি কী চায়, বর্তমান সরকার আরও এক মেয়াদে অর্থাৎ টানা চতুর্থ মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকুক। আরেকবার সরকার গঠন করে, আওয়ামী লীগ বেগম জিয়াসহ বিভিন্ন কারণে আটকদের মুক্তি দেবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন ইত্যাদি বাতিল করবে।
বিএনপির ১০ দফা দাবির সাত দফা বাস্তবায়ন করবে। তারপর নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচন দেবে। এটাই কি বিএনপির দাবিনামার মর্মার্থ বিএনপির বিবেচনায় অবৈধ সরকারই যদি সবকিছু করে দেয় তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে কী করবে বিষয়টি এত সহজ-সরল নয়। আমি মনে করি, ১০ দফার আড়ালে আছে এক-এগারোর প্রেতাত্মা। এই ১০ দফা প্রণীত হয়েছে সুশীলদের ড্রয়িং রুম থেকে। বিএনপি যদি শুধু নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইত তাহলে তো তাদের দাবিনামা অন্যরকম হতো। তারা বলতে পারত, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। ওই সরকার ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন করবে ব্যস। ১০ দফায় চার থেকে ১০ পর্যন্ত যা দাবি-দাওয়া করা হয়েছে, তা একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য প্রযোজ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য নয়। বিএনপি আসলে কী চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার। তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এ পথটি বের করেছিলেন। শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা। সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা গ্রহণের ধারাবাহিক অগণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ করে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনাই ছিল নব্বই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান চেতনা। এর সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এ সরকার সর্বোচ্চ ৯০ দিন মেয়াদের। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনাই এ সরকারের একমাত্র কাজ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম শর্ত ছিল নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। রুটিন কাজের মধ্যেই দায়িত্ব সীমিত রাখতে হবে।
কিন্তু ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সীমা লঙ্ঘন শুরু করে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে। এ সময়ই ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থার আসলে মৃত্যু হয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ এবং অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তা কোনোক্রমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। ওই সরকার সংবিধানের মূল চেতনায় আঘাত করেছিল। এটি ছিল মূলত কিছু পশ্চিমার সহায়তায় সুশীলদের ক্যু।
যেখানে সুশীলরা অনন্তকাল জবাবদিহিহীন অসীম ক্ষমতার মালিক হয়েছিল। সংস্কারের নামে প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনীতি নিঃশেষ করে দেওয়া। রাজনৈতিক সংস্কারের নামে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হয়। রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে সুশীল সরকার। গ্রেফতারের পর ওই সব অসত্য অভিযোগ আবার গণমাধ্যমে প্রচার করে বিচারের আগেই রাজনীতিবিদদের অপরাধী বানিয়ে দেওয়ার মিশনে নিপুণ বাস্তবায়ন চলে। এক-এগারো সরকারের দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু ছিল ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা। তাদের ওপর চড়াও হয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মিশনে নামে সুশীল সমাজ।
ব্যবসায়ীদের হয়রানি, বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধ চাঁদাবাজি শুরু হয়। শুরু হয় ব্যবসায়ীদের চরিত্র হনন। অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের সম্মান রক্ষায় ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে বিদেশে চলে যান। দেশে অনেকে চরম লাঞ্ছিত-অপমানিত হন। দুই বছরে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকা আদায় করে। এক-এগারো সরকার বিদায়ের পর এই অর্থ আদায়কে অবৈধ ঘোষণা করেন হাই কোর্ট। এই টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি আজ অবধি। এক-এগারো সরকার বেসরকারি খাত ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে। এর ফলে কার্যত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডই ভেঙে পড়ে। শিক্ষাঙ্গন ধ্বংসের মিশনে নেমেছিল মইন ইউ আহমেদ এবং ড. ফখরুদ্দীন সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাওয়ার বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে এ দেশের মানুষ। কৃষি, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প সব ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা হয় বাধা।
নৈরাজ্যের এক শাসন ছিল এক-এগারো। সেখানে গুটিকয় সুশীল এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা ছাড়া কেউই ভালো ছিলেন না। কয়েকটি পশ্চিমা দেশ এবং সুশীল সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ সংস্কারের নামে দেশটাকেই ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল। বিএনপি কি দেশে আবার সে রকম একটি শাসন চায় বিএনপির ১০ দফা থেকে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। ১০ দফা আসলে এক-এগারোর সংস্কার প্রস্তাব। ওই সময় সংস্কারপন্থি রাজনীতিবিদ এবং সুশীলদের যেসব কথা বলতেন তারই পরিবর্তিত রূপ এই ১০ দফা। নতুন বোতলে পুরনো মদ। এই ১০ দফা আবার এক-এগারোর শক্তিকে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। ধরা যাক বিএনপির দাবি অনুযায়ী দেশে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হলো। এই অনির্বাচিত সরকার এসে বলবে এই যে দেখুন রাজনীতিবিদরা এসব দাবি দিয়েছে। কাজেই আগে জঞ্জাল সরাতে হবে। সময় লাগবে। সুশীলরা বলবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল কর। গুমের তদন্ত কর। অর্থ পাচারকারীদের তালিকা কর ইত্যাদি। আবার শুরু হবে সেই সংস্কার সংস্কার খেলা। নির্বাচনবিহীন একটি অযোগ্য সরকার দেশ চালাবে বছরের পর বছর। রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন চলবে নির্বিচারে। ব্যবসায়ীদের করা হয় ব্ল্যাকমেলিং, হয়রানি। রাষ্ট্রীয় চাঁদাবাজি ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির করে দেবে। এরকম একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য কি তাহলে বিএনপির এত আয়োজন। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, দেশের সুশীল সমাজের কেউ কেউ এখন বিএনপির চেয়ে বড় বিএনপি। দেশের প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যম এখন বিএনপিকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দিচ্ছে। পশ্চিমা কয়েকটি দেশের আগ্রহ ঠিক ২০০৭ সালের মতোই।
সেই শক্তিগুলো একত্রিত হয়েছে আবার। বিএনপিকে মাঠে নামিয়ে তারা আরেকটি অনির্বাচিত অধ্যায়ের পটভূমি তৈরি করতে চায়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৃত্যু হয়েছে। সুশীলরা ২০০৭ সালে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। এখন ক্ষমতা পেলে তারা কি ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করবে রুটিন কাজে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের কাছে সরকারপ্রধান হওয়ার কেউ নেই।
এ জন্য কি সুশীল আর পশ্চিমাদের ফাঁদে পা দিয়েছে দলটি। কারণ, এখন বিএনপি যেভাবে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে তারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, তারা একটি এক-এগারো আনতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ এখন আর সেই অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করবে না। কিছুতেই না।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন