‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ থেকে আজকের আমেরিকা

তাপস কুমার দত্ত
ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৫

বাংলায় প্রবাদ আছে-- বেল পাকলে কাকের কী? বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল। এরপর থেকেই ভোটের ফলাফল জানার জন্য অনেকেই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু কেন এত আগ্রহ? ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন ডিসির রৈখিক দূরত্ব প্রায় তেরো হাজার কিলোমিটার৷ বাংলাদেশে যখন দিন আমেরিকায় তখন রাত। অর্থাৎ আমাদের উলটোদিকে আমেরিকা। তো এই উলটো জগৎ নিয়ে আমরা কেন নির্ঘুম রাত্রিযাপন করি? গতকাল রিকশায় অফিসে আসার সময় উত্তরবঙ্গের এক রিকশাওয়ালাও জানতে চাইল--কে জিততে পারে-ট্রাম্প নাকি কমলা? দেখা যাচ্ছে, সর্বসাধারণের মধ্যেও আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে কৌতূহল তীর। 
অর্থাৎ বেল পাকলেও কাকের অনেক কিছু আসে যায়। কেউ কেউ ট্রাম্পকার্ড আর ওরেঞ্জ (কমলা) পাশাপাশি রেখে কৌতুক করছে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা দেবী হ্যারিস, যার মা শ্যামলা গোপালানের জন্ম দক্ষিণ ভারতে, অশ্বেতাঙ্গ। যদিও এর আগে বারাক ওবামা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের পর এখন পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি ৷ সুতরাং কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে 'তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প দাবি করেছেন, তার আগের জামানায় বিশ্বে বড় কোনো যুদ্ধ হয়নি। তিনি নিজেকে ক্যারিশম্যাটিক নেতা বলে মনে করেন। আমেরিকা-অভিমুখী থাকতে চান তিনি৷ 
যারা একটুখানি চোখ-কান খোলা রাখেন, জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ইউরোপ, বাংলাদেশ, ভারতসহ সারা বিশ্বের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেন গুরুত্বপূর্ণ, এসব নিয়ে অনেক ধরনের বিশ্লেষণ গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত। সুতরাং যেসব বিষয়ে না গিয়ে আমরা বরং যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝার চেষ্টা করি। নিজেকে জানলে যেমন জগতকে জানা যায়, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকে জানতে বিশ্বের সমস্যা-সংকট-আশঙ্কা-সম্ভাবনা ও সমাধান নিয়ে জানা যায়। সুতরাং আসুন, যুক্তরাষ্ট্রকে খুব অল্প-কথায় বোঝার চেষ্টা করি।
সেই যোড়শ ও সপ্তদশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রকে 'নিউ ওয়ার্ল্ড' বলা হতো। কারণ, ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা তখন সদ্য আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে। তাদের কাছে এটি ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন মহাদেশ, যেখানে নতুন জীবনধারা ও সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছিল। তারপর ব্রিটিশরাজের বলয় থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিবদমান অঙ্গরাজ্যগুলো এক হয়ে কী করে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠল এবং তাদের 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' কী করে মানবজাতির মুক্তির দলিল-তুল্য হয়ে উঠল- এসব ইতিহাস সারা বিশ্বের সচেতন মানুষকে রোমাঞ্চিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের 'স্বাধীনতার ঘোষণা'কে বলা হয় পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা ও 'সমতা সম্পর্কে একটি যুগান্তকারী ও সর্বজনীন নৈতিক আদর্শের বার্তা। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার-জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের অনুসন্ধান--এই তিনটি বিষয়কে মানুষের' প্রাকৃতিক অধিকার' হিসেবে চিহ্নিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের অন্যতম থমাস জেফারসন দেশটির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলেন, 'আমরা এই সত্যগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে বিবেচনা করি যে, সকল মানুষ সমানভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং স্রষ্টা কর্তৃক মানুষের জন্য কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার প্রদান করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অনুসন্ধানের অধিকার৷ এই অধিকারগুলো সুরক্ষিত রাখার জন্য সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শাসিত জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে ন্যায়-সংগত ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। যখনই কোনো সরকার এই উদ্দেশ্যগুলোর পরিপন্থী হয়ে ওঠে, তখন জনগণের অধিকার থাকে সেই সরকারকে পরিবর্তন বা বিলুপ্ত করে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করার, যা এমন নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এমন রূপে ক্ষমতাগুলোকে সংগঠিত করবে, যা তাদের নিরাপত্তা এবং সুখ নিশ্চিতকরণে পারে।
এটা একটি অপূর্ব ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্র পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের বিপ্লবসহ বহু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং মানবাধিকারের জন্য আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মানবজাতির জন্য এমন একটি আদর্শ হয়ে ওঠে-- যা শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সকলের জন্য ন্যায্যতা ও অধিকার অর্জনের একটি বিশ্বজনীন দর্শন৷ আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মহত্ত্ব দেখতে পাই দেশটির সংবিধান, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং নাগরিক অধিকারের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিরা এমন একটি দেশ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও বিল অব রাইটস, বিশেষ করে প্রথম সংশোধনী, বাক-স্বাধীনতা ও মুক্ত-মতের অধিকারকে আইনি সুরক্ষা দিয়েছে. যা যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।
আমরা সবাই একবাক্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিবাসীদের তৈরি দেশ হিসেবে ভূষিত করি। যুক্তরাষ্ট্র হলো একটি 'মেন্টিং পট'৷ ব্রিটিশ নাট্যকার ইসরাইল জাংউইল-এর "দ্য মেন্টিং পট' (১৯০৮) মঞ্চনাটকে এই ধারণাটির প্রথম প্রকাশ দেখা যায়, যেখানে মূলত অভিবাসী সম্প্রদায়গুলোর একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে একটি নতুন জাতির উদ্ভবের কাহিনী বলা হয়। মেন্টিং পটে বিভিন্ন ধরনের ধাতুকে একত্রে রাখা হয় এবং তারপর উত্তপ্ত করে গলানো হয়। অতঃপর এই উত্তাপে প্রতিটি ধাতু তার নিজস্ব গঠনতন্ত্র হারিয়ে ফেলে এবং অন্য ধাতৃগুলোর সঙ্গে মিশে একক, সমন্বিত ধাতু তৈরি করে। এতে প্রতিটি ধাতুর বৈশিষ্ট্য এবং রং আলাদা থাকলেও উত্তাপের প্রভাবে সবগুলো ধাতু মিশে গিয়ে একটি একক পদার্থে পরিণত হয়, যা নতুন ও অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে তেমন ব্যাপার ঘটেছে। সেখানে বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি এবং ধর্মের মানুষ একত্রে মিশে একটি অভিন্ন সামাজিক পরিচয় তৈরি করেছে। মেন্টিং পটের মাধ্যমে একটি বহুমুখী, সহনশীল এবং সংহত সমাজ গড়ে ওঠে যেখানে সকল সংস্কৃতি মিলেমিশে একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের অংশ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে এমনিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষজন একত্রে মিলিত হয়ে একটি সত সংস্কৃতির সৃষ্ট করেছে। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দেশটাকে চিন্তার নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। সমাজে মুক্তভাবে মতামত বিনিময়ের সুযোগ থাকায় নতুন আইডিয়া এবং উদ্ভাবনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্পকলায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ অনেককে তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য একটি বাস্তবমুখী প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেছে। এর ফলে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা বহু মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। এই জন্যই যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের কাছে এখনো স্বপ্ন পূরণের দেশ হিসেবে পরিচিত৷
যুক্তরাষ্ট্রের মহত্ত্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এর আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। বিচার ব্যবস্থার এই স্বাধীনতা নাগরিকদের সুরক্ষা দেয় এবং তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সাহস জোগায়। যুক্তরাষ্ট্র শুধু একটি দেশ নয়; এটি বিশ্ব জুড়ে স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের এবং মানবাধিকারের প্রতীক। এখানকার মুক্তমত, চিন্তার স্বাধীনতা এবং সহনশীলতা দেশটিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বসবাসযোগ্য জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যদিও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কিছু চিত্র আজকাল যুক্তরাষ্ট্রেও নাকি দেখা যাচ্ছে বলে বলছেন অনেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমরা স্মরণ করতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে (১৭৮৯-১৭৯৭)। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করেননি এবং দলগত রাজনীতিকে ক্ষতিকর বলে মনে করতেন ৷ তিনি মনে করতেন, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থকে সামনে রেখে কাজ করে, যা জাতীয় ঐক্যকে ভাঙতে পারে। তার ধারণা ছিল-- রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিগত লোভ এবং কট্টর দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করে এবং এটি দেশের স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য ক্ষতিকর হবে।
যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বহুদল এবং ভিন্নমতই মূল সৌন্দর্য। সুতরাং যতই বিবাদ-বিসংবাদ থাকুক যুক্তরাষ্ট্রের চেক্স অ্যান্ড ব্যালেন্স ঠিক থাকলেই হলো।

লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা