জিতল ট্রাম্প কিন্তু হারল কে

মযহারুল ইসলাম বাবলা
  ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:৪৯

ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ধনকুবের ব্যবসায়ী এবং অপেশাদার রাজনীতিক। যিনি রিপাবলিকান দলের ওপর চরম কর্তৃত্বে দ্বিতীয় দফায় নিজের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন। নির্বাচনী মাঠে এবার সংযত কথাবার্তা বলেছেন। অতীতের মতো হঠকারী বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। ইতিপূর্বে তাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল রেপিস্ট, রেসিস্ট, সেক্সিস্ট বলে। তিনি নারীদের সম্পর্কে চরম অবমাননাকর উক্তি করেছিলেন। বর্ণবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে গর্হিত বক্তব্যে তার চরম সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। আমেরিকায় বসবাসরত মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিতাড়ন করার পাশাপাশি ঘৃণিত মন্তব্য ও বক্তব্য দিতেও অতীতে দ্বিধা করেননি। অথচ তিনি বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া বক্তব্যগুলো যদি নিতান্ত ভোটের রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তবে বলা যায় সে কৌশল প্রয়োগে তিনি সফল হয়েছেন।
আমেরিকার সাদা চামড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠদের চিনতে না পারার কারণেই ট্রাম্পের দ্বিতীয় বিজয়ে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। কিন্তু আমেরিকার যেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না কেন তাতে দেশটির নীতির হেরফের হয় না। আমেরিকার জনগণ অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের দেশকে বিশ্বের একক আধিপত্যবাদী আসনে দেখতে চায়। দেখতে চায় আধিপত্যবাদী আমেরিকাকে। বিশ্ব আমেরিকার হুকুমে উঠবস করবে, করজোড়ে হুকুম পালন করবে। আমেরিকার স্বার্থে নিজেদের বিকিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। আধিপত্যবাদী আমেরিকার জন্য শক্ত-দৃঢ় আধিপত্যবাদী শাসকরূপে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সে কারণেই বেছে নিয়েছে। অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরেছিলেন ওই আধিপত্য বিস্তারে অক্ষম প্রমাণে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর তেহরানে মার্কিন দূতাবাসের প্রায় অর্ধশত মার্কিন নাগরিককে ইরানি ছাত্ররা জিম্মি করেছিল। জিম্মি উদ্ধারে অপারেশন ঈগল ক্ল চাপে বাধ্য হয়ে জিমি কার্টার অনুমোদনও দিয়েছিলেন। কিন্তু জিম্মি উদ্ধারের সেই মিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। ইরানকে বশে আনতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল আমেরিকা। আর সে দায়ে জিমি কার্টার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কিছু ব্যতিক্রম বাদে মার্কিনি জনগণ অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের প্রভাব-ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী বিস্তারে অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী। তাদের বিবেচনায় সিনিয়র ও জুনিয়র বুশের পর তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই অধিকতর যোগ্যরূপে বিবেচনা করেছে। সেই শ্বেতাঙ্গ মার্কিনি জনগণের আধিপত্যবাদী আকাক্সক্ষা পূরণে সক্ষম হবেন বলেই ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছে। বিশ্বজুড়ে আমেরিকার আধিপত্য, হত্যাযজ্ঞ, শোষণ, লুণ্ঠন থেকে সব অনাচার-অপকীর্তিকে সীমাহীন আত্মগর্বে শ্বেতাঙ্গ মার্কিনি জনগণ নিজেদের অর্জন বলেই মনে করে। শত বিতর্কিত, রেসিস্ট, রেপিস্ট, সেক্সিস্ট ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হারলেও, তৃতীয় দফা নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছেন।
বারাক ওবামা বর্ণবাদী আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সেটা অবশ্যই নিজ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায়। বর্ণবাদী সাবেক ইউরোপীয় আমেরিকান শ্বেতাঙ্গরা শত শত বছরের বর্ণবাদী পরিচয়কে ঢাকতেই এবং তারা যে বর্ণবাদী নয় সেটা প্রমাণেও কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে হজম করেছিল। তাই বলে কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার ও সমতার সুযোগ নিশ্চিত হয়েছিল, সেটা বলার উপায় নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র যথানিয়মে কার্যকর ছিল ও আছে। রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির ন্যূনতম পরিবর্তনও ঘটেনি। ওবামার সাফল্যমূলক স্বাস্থ্যবীমা আইনটি প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার আগেই ট্রাম্প বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল। বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে আমেরিকার অবস্থানের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে ট্রাম্প আমেরিকার বর্তমান অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ানোরও ঘোষণা দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সব হঠকারী-বিতর্কিত বক্তব্যকে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানরা নিশ্চয় পছন্দ করেছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ছড়ি হাতে বিশ্ব শাসনের যোগ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবেই বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক, আধিপত্যবাদী শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা নির্বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে।
আমেরিকানদের পৃথক একজাতিরূপে চিহ্নিত করা যাবে না। আমেরিকার সাদা চামড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠরা আদিতে ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতিসত্তার এবং ইউরোপ প্রত্যাগত। এ ছাড়া দাস হিসেবে আফ্রিকা থেকে জোরপূর্বক ধরে আনা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ এবং নগণ্যসংখ্যক আদি আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের সমন্বয়ে আজকের আমেরিকানরা। ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতিসত্তার শ্বেতাঙ্গরাই আমেরিকার মোট জনসমষ্টির সিংহভাগ অংশ। যারা আমেরিকায় দখল করে নিয়েছিল।
ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানরাই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে খোদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম এবং যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশ ব্রিটিশ, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেনীয়দের উপনিবেশ ছিল। এতে আমেরিকা মহাদেশের সব দেশের আদি ভাষা বহু আগে লুপ্ত হয়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের ভাষার প্রচলন ঘটে এবং সেসব ইউরোপীয় ভাষা এখনও দেশভেদে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রভাষারূপে প্রচলিত রয়েছে। স্পেনিস, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, ইংরেজি বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষাই আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। উত্তর আমেরিকা ১৩টি রাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ৩৭টি রাষ্ট্রের যুক্ততায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামে পৃথক রাষ্ট্র হয়েছে। এটি ব্রিটিশদের অধীনে ছিল বিধায় এদের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি। বর্তমান আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ মানুষরা সবাই আদি ইউরোপীয় অর্থাৎ কলম্বাসের সঙ্গী দাগি ঘৃণিত অপরাধীদের উত্তরসূরি। এরা আদি আমেরিকানদের নিষ্ঠুরভাবে শোষণ-হত্যায় নিজেদের হাত রাঙিয়ে ছিল। আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের জোরপূর্বক ধরে এনে দাসরূপে কৃষি, শিল্প উৎপাদনে শ্রমশোষণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেছিল। আজকে তাদের মজবুত অর্থনীতির মূলে যুগ-যুগান্তরের দাসভিত্তিক শ্রমশোষণ, যেটি স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের রক্তে-ঘামে তারা অর্জন করেছে। অর্জিত এবং লুণ্ঠিত অর্থনৈতিক দাপটে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য কায়েম করেছে।
আমেরিকার সাদা চামড়ার শ্বেতাঙ্গরা আদি ইউরোপীয়। এরাই আমেরিকার জনসমষ্টির সর্ববৃহৎ অংশ। অতীত আফ্রিকান দাসরা অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গরা আমেরিকার পূর্ণ নাগরিক সত্য, তবে তাদের নাগরিক মর্যাদা সাদাদের অনুরূপ আগেও ছিল না। আইনে থাকলেও বাস্তবে আজও নেই। অতীতে বাসের সর্বপেছনে কৃষ্ণাঙ্গদের বসার জায়গা নির্ধারিত ছিল। তবে শ্বেতাঙ্গরা চাইলে সে আসনও কৃষ্ণাঙ্গরা ছেড়ে দিতে আইনগত বাধ্য ছিল। কালোদের নিম্নমানের পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, পাবলিক টয়লেট, দোকান-ব্যাংকে পৃথক লাইন, সিনেমা হলে পৃথক বসার ব্যবস্থা। ভোট প্রদানের আইনগত অধিকার থাকলেও জোরপূর্বক সে অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হতো না। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রেও এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হতো। ১৯৬৫-তে সেলমায় কালোদের ভোটাধিকার আন্দোলনে সাদা পুলিশ নৃশংস হামলা চালায়। এই ঘটনা ‘রক্তাক্ত রবিবার’ নামে খ্যাত। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল সিভিল রাইট অ্যাক্টকে প্রেসিডেন্ট জনসন আইনে পরিণত করেন। এই আইনে জন্ম, বর্ণ, গোত্র, ধর্মের বিভাজনে সব ধরনের বৈষম্যকে অপরাধ হিসেবে ঘোষিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা তথৈবচ। আমেরিকার ইতিহাসে কাকতালীয়ভাবে হলেও কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা বিপুল জনপ্রিয়তায় দুই দফায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এতে কি বর্ণবাদ নির্মূল হয়েছে? না, মোটেও নয়। তার শাসনামলেই কৃষ্ণাঙ্গ মাইকেল ব্রাউন, ট্রেভন মার্টিন, টামির রাইস, ফ্রেডি গ্রে, লেকুয়ান ম্যাকডোনাল্ডদের নৃশংস হত্যার শিকার হতে হয়েছে। তারা সবাই বর্ণে কালো এবং নিরস্ত্র ছিল; তাদের সবাইকে প্রাণ দিতে হয়েছে সাদা চামড়ার পুলিশের গুলিতে। সুবিচার তো পরের কথা। বিচারে অভিযুক্ত পুলিশ বেকসুর খালাস পর্যন্ত পেয়েছে। নিজ নাগরিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে যে রাষ্ট্র লাগামহীন; ভিন্ন রাষ্ট্র প্রশ্নে তাদের অবস্থান কেমন হতে পারে সেটা অনুমান করা নিশ্চয় অসাধ্য নয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছেন। হেরেছেন কমলা হ্যারিস। খুবই সত্য কথা। কিন্তু সেটি শেষ কথা নয়। ট্রাম্পের জয়ে কি হারবে না সভ্যতা, শিষ্টাচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা এবং বিশ্বব্যবস্থাও। জয়ী ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হয়ে উঠলে বিশ্বে শান্তি-স্থিতি বিনষ্ট হবে। ইরান, ইউক্রেন, ফিলিস্তিনসহ বৃহৎ যুদ্ধের আশঙ্কাকেও নাকচ করে দেওয়া যাবে না। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের কাছে নিজের মুখরক্ষায় বেফাঁস বক্তব্যের মতো বেফাঁস সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়! সমূহ বিপদের ঝুঁকি তো রয়েছেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করে, গোটা বিশ্বের মনোযোগ এখন সেদিকেই।
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত