গণতন্ত্রহীনতা দেশকে এক অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে। যা থেকে উদ্ধারে দ্রুত গণতন্ত্রের পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। জুলাই গণ অভ্যুত্থান আমাদের সমূহ সর্বনাশের পথ থেকে উদ্ধার করেছে। জাতি ইতিহাসের এক নিকৃষ্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। অর্জিত হয়েছে ১৮ কোটি মানুষের বিজয়। বলা হয়ে থাকে, বিজয় অর্জন করা যত সহজ, তা টিকিয়ে রাখা ততটাই কঠিন। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বিজয়কে ধরে রাখতেই আমাদের দ্রুত গণতন্ত্রের পথে ফিরে যেতে হবে।
প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশে গণতন্ত্র নেই। সুশাসন নির্বাসনে। অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্ষমতা হাতে নিয়েছে, তখন চারদিকে শুধু নেই আর নেই। এ সরকারকে তাই প্রতিটি সমস্যার সমাধানে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়াকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। পণ্যমূল্য সহনশীল করতে আমদানিনির্ভর বেশ কিছু নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধে নেওয়া হয়েছে জিরো টলারেন্স। কিন্তু বাজার তদারকির কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় তার সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তা। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি বাজার মনিটর করছে। এর পরও একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেট। আমদানির পরও ফের দেশের বাজারে পিঁয়াজের দাম বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ১০ থেকে দেশি পিঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ এবং আমদানি করা পিঁয়াজ মানভেদে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও দেশি পিঁয়াজের দাম ছিল ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা। পিঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক-কর ছাড় দেওয়ার পর ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। তার পরও দেশের বাজারে পিঁয়াজের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসছে না। তদারকি না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পিঁয়াজের বাজার অস্থির করছে। পিঁয়াজ শুধু নয়- চাল, ডাল, চিনি, ডিম, মুরগি প্রতিটি পণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দাম ক্রেতাদের জন্য অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। এ কথা ঠিক অসময়ে বন্যা ও অতিবৃষ্টির ফলে সবজির চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। পরিণতিতে সবজির দাম সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দেশে নির্বাচিত সরকার থাকলে বাজার তদারকিতে তারা ব্যবস্থা নিতে পারত। এ ব্যাপারে দলীয় নেতা-কর্মীরাও সক্রিয় হতো। নির্দলীয় সরকারের সে সুযোগ নেই। দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে চলছে ভয়াবহ মন্দা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে শিল্প উৎপাদন থমকে যাচ্ছে। এই কার্তিক মাসের শেষ ভাগে যখন গৃহস্থালিকাজে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক কম, তখনো লোডশেডিংয়ে ভুগছে দেশের মানুষ। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা মোটেও ভালো নয়। অর্থনীতি ভঙ্গুর দশার শিকার। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বিদ্যমান সংকট ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলায় জাতীয় সরকার গঠনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের পর ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। আশার কথা এ বিষয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য রয়েছে।
স্বীকার করতেই হবে, দেড় দশকের বেশি সময়ের দুঃশাসন দেশের সব সংবিধান প্রতিষ্ঠানগুলোকে তছনছ করে দিয়েছে। এসবের সংস্কার ছাড়া জাতি সোজাভাবে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। গণতন্ত্রের পথে ফিরে যেতে প্রথমেই নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আশার কথা অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। তারা নির্বাচন কমিশন গঠনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তাদের এ সিদ্ধান্তে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা আশা করব দেশের মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো সক্ষম একটি নির্বাচন কমিশন উপহার হিসেবে পাবে। নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের যে অনাস্থা গড়ে উঠেছে, তা থেকে ফিরে আসার পথ দেখাবে সেই নির্বাচন কমিশন। দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হলে জনমনে আস্থা ফিরে আসবে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিরে আসবে প্রাণশক্তি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জনপ্রতিনিধিরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
অনেকে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে বাঁকা চোখে দেখছেন। তারা মনে করেন দ্রুত নির্বাচন হলে ফ্যাসিবাদীরা সুবিধা পাবে। এ যুক্তির মধ্যে কোনো সত্যতা নেই। যারা এমন কথা বলেন, তারা সাধারণ মানুষের প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগছেন। এমন অসংলগ্ন ধারণার মোক্ষম জবাব দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি দিবস উদযাপন উপলক্ষে গত শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে গণমিছিলপূর্ব বিশাল জনসমাবেশে দেওয়া ভার্চুয়াল বক্তৃতায় তারেক রহমান বলেছেন, কখনো যেন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ আর ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।
‘স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের’ উদ্দেশে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, প্রশাসনে, এখনো সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তবে নিজেদের সফল করতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটিই আজ জনগণের চাওয়া। দেশের সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে, দ্রুত গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হলে এ দেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কবর রচনা নিশ্চিত করা যাবে।
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট যে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে, সেটি হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল। হাজারো ছাত্র-জনতার জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বর্তমান নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের পেছনে ১৮ কোটি মানুষের সমর্থন রয়েছে। সে সমর্থন যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। স্বৈরাচারের শাসনামলে দেশে ব্যাংক লুট, বিদেশে অর্থ পাচার, খুন, গুম, ধর্ষণসহ যত অপকর্ম হয়েছে তার ইতি ঘটাতে দেশের জনগণ বিশেষত, ছাত্রসমাজ জেগে উঠেছিল। মানুষ আশা করে এই সরকার বিগত পৌনে ১৬ বছরে দেশে যে অন্যায়-অবিচার হয়েছে সেগুলোকে সংস্কার করে, অপকর্মগুলোকে বাতিল করে আগামী দিনের জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথ সুগম করবে।
এ আশাতেই দেশের মানুষ এই সরকারের ব্যাপারে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। এই শর্ত দিয়েছে, যাতে সরকার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে দেশ চালাতে পারে। তারা যে সংস্কার করবে গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলের নেতা-কর্মীরা সহযোগিতা করবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে সংসদে পাঠানোর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। সেই সংসদ একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। এই সরকার কিছু কিছু সংস্কারের পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংস্কারের গতি আরও জোরদার করতে হবে। দেশবাসী যে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন হবে বলে আশা করেছিল সরকার তত দ্রুত সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এখন জনগণের প্রত্যাশা, অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। যার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হবে। জাতি ফিরে পাবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক