আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এবং নির্বাচনী রোডম্যাপের গুরুত্ব

এম. এ. হালিম
  ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৬

৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভিন্ন লেখা ও আলোচনায় এ অর্জনকে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করছেন। অথচ ব্যতিক্রম বাদে একটি দেশ একবারই স্বাধীন হয় বিদেশি দখলদারদের হটিয়ে। পাকিস্তানি দখলদারদের হটিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। অবশ্য স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় স্বাধীন মত প্রকাশ, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যমুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা, স্বাধীন ভোটাধিকার ইত্যাদি, তাহলে এ অর্জনকে ‘স্বাধীনতা’ বলে বিবেচনা করাই যায়। এটাও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে যেসব আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, সেসবের ঊর্ধ্বে ৫ আগস্টের বিজয়। এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ছাত্রদের একটি নিজস্ব দাবিকে কেন্দ্র করে, যার শিরোনামও ছিল ব্যতিক্রমী–‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। একসময় সে আন্দোলনই এক দফা তথা সরকার পরিবর্তনের দাবিতে রূপ নেয়, যার সঙ্গে যোগ দেয় আপামর জনতা। এ আন্দোলনের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল, জনরোষের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, যা ’৯০-এর গণআন্দোলনে পদত্যাগকারী রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের বেলায়ও ঘটেনি। 
১৯৯০-এর গণআন্দোলনের বিজয় এবং ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের ঘটনায় আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতারই স্বাদ পেয়েছিলাম। মনে আছে, সেদিনও সকাল থেকে সেনা-পুলিশ সদস্য ও সর্বসাধারণের একে অন্যের সঙ্গে অভিনন্দন বিনিময় ও দেশজুড়ে বিজয়ের মেলা বসেছিল। উল্লেখ্য, তখন বর্তমান সময়ের মতো ত্বরিত যোগাযোগ সুবিধা (মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি) ছিল না। আর বিটিভি বা বেতার তখনও ছিল সরকারি গুণকীর্তনের মাধ্যম। তাই ল্যান্ড ফোন এবং বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসই ছিল যোগাযোগ ও গণজাগরণের মাধ্যম। নয়তো অপেক্ষা করতে হতো পরদিন সকাল পর্যন্ত সংবাদপত্রের জন্য। হরতালসহ আন্দোলনের কর্মসূচি প্রচারের মাধ্যম ছিল সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন অথবা পোস্টার-লিফলেট। 
একই দৃশ্যপট না হলেও ’৯৬-এর আন্দোলনও ছিল আরেক অর্জন। কারণ তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অস্বীকার করে ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে; তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এক গভীর রাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে মাত্র ১২ দিনের মাথায় ৩০ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেয় তারা। কিন্তু ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সূত্রে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী রহিতকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করলে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার জনমনে অসন্তোষ দানা বাঁধে। গণদাবি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার পরপর ৩টি (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) একদলীয় নির্বাচন করে। কিন্তু ২০২৪-এর আন্দোলনের ফলে আর শেষ রক্ষা হয়নি। 
যাহোক, ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলকে বলতে শুনতাম, এ সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়া উচিত। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি ততই জোরালো হচ্ছে। ১৬ বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে স্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত হলেও এখন যেন আর কারও তর সইছে না। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনেও চলছে হযবরল অবস্থা। তার প্রমাণ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও পদায়নে অদক্ষতা। সকালে নিয়োগ দিয়ে বিকেলে তা বাতিল করতে হচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, প্রশাসনে স্বৈরসরকারের প্রভাব এখনও বিরাজমান থাকায় পরিবর্তন বিদ্যমান জনবলের মধ্য থেকেই হচ্ছে। 
তাই অনেকেই বলছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়াই হবে এ মুহূর্তে সরকারের অগ্রাধিকার। না-হয় পতিত সরকারের দোসররা সুযোগ বুঝে মাথাচাড়া দিতে পারে। নির্বাচন বিলম্ব হলে, অবাক হবো না, যদি পতিত সরকারের দোসরদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেওয়া কোনো দলকে একাত্ম হতে দেখি। অনেকেরই মনে থাকবে, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তিন জোটের অঙ্গীকার ছিল, নির্বাচনের পর কেউই জাতীয় পার্টিকে পুনর্বাসন করবে না। কিন্তু ’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করতে পারলেও একাদশ সংশোধনীর জন্য জাতীয় পার্টির সমর্থন নিতে দ্বিধাবোধ করেনি। গত ১৬ বছরে জাতীয় পার্টিকে কখনও সরকারের অংশ করে আবার কখনও তথাকথিত বিরোধী দলের মর্যাদা দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছে শেখ হাসিনা সরকার। 
অনেকের অভিমত, ৫ আগস্টের আগে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন ছিল অনেকটা পরিকল্পনাহীন। সরকার পতনের পর কীভাবে সরকার গঠন হবে, কতদিন স্থায়ী হবে– এসব বিষয়ে কোনো রূপরেখা ছিল না। মনে আছে, ’৯০-এর আন্দোলনের আগে আন্দোলনরত জোটগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দেয়। সে অনুসারে, সংবিধানের মধ্য থেকেই তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সেই পদে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দিয়ে তাঁর কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে সাহাবুদ্দীন ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সুষ্ঠুভাবে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। 
প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অনেকের অভিমত, সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটিই আদর্শ হলেও আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত। এক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়েই আমরা দেখেছি প্রধান দুটি দলের ভাবনা সরকারে থাকলে একরকম আর সরকারের বাইরে থাকলে অন্যরকম। সুতরাং রাজনৈতিক সরকার কতটা সংস্কার করবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে তা সত্ত্বেও অবিলম্বে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর নয়, দেশের সাধারণ মানুষেরও দাবি। নির্বাচন বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একেক সদস্য একেক সময়সীমার কথা বলছেন। সরকারের মধ্যে এমন ভিন্নমত জনমনে শুধু দ্বিধাই সৃষ্টি করছে, আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জন্ম হচ্ছে অবিশ্বাস। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার অনির্দিষ্টকাল থাকলে পতিত সরকারের সুযোগসন্ধানী অথবা সুবিধাভোগীদের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও থেকে যায়। একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ এ মুহূর্তে জরুরি শুধু সবারই প্রত্যাশা বলে নয়, তা সরকারের জন্যও তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে।
এম. এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
[email protected]