গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও উৎসব-উদ্দীপনায় ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ পালিত হয়। ১৯৭১-এর এই দিনে আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বীর সেনানীরা জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ সূচনা করেছিল। যা ত্বরান্বিত করে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়কে। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হলো এ দিবস উপলক্ষে ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনানিবাস, নৌ-ঘাঁটি ও বিমান-ঘাঁটিতে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আলোচিত হলো অপরাহ্নে ঢাকা সেনানিবাসস্থ সেনাকুঞ্জে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। প্রতি বছরের মতো এবারও ২১ নভেম্বর বিকাল ৪টায় পাতাঝরা হেমন্তের সোনালি বিকালে সেনাকুঞ্জের সবুজ চত্বরটি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও দেশি-বিদেশি অতিথিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল।
সেনাকুঞ্জের সাতকাহন : বহুল আলোচিত সেনাকুঞ্জটি ঢাকা সেনানিবাসের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত। অত্যন্ত উন্নতমানের এ ‘বহুমুখী মিলনায়তন ও সিভিল কমপ্লেক্সটি’ নির্মিত হয়েছিল (১৯৮৯) সালে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল এম আতিকুর রহমানের অসাধারণ উদ্যোগে। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৯ সালের ২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন।
সেনাকুঞ্জের চমৎকার অবস্থানটা চোখে পড়ার মতো। এর দক্ষিণে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, যেন ঢাকায় একখণ্ড নয়নাভিরাম ‘সুইজারল্যান্ড’। উত্তরদিকে সবুজ বৃক্ষরাজি ও অপরূপ সরোবর। এর ঠিক পূর্বদিকে ২০১৫ সালে নির্মিত হয়েছে ‘সেনামালঞ্চ’ নামের আরেকটি আলোচিত ও নজরকাড়া কনভেনশন হল ও সম্মেলন কেন্দ্র। উল্লেখ্য, ‘সেনামালঞ্চ’ তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়ার উদ্যোগে নির্মিত হয়। অপরূপ স্থাপত্যময় সেনাকুঞ্জের পশ্চিমদিকে বিশাল খোলা চত্বর। মূলত এ বিরল খোলা চত্বরের সম্মুখে ঘাসের সবুজ গালিচায় আয়োজন করা হয়েছে ২১ নভেম্বরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
বিপ্লবী কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৯৮ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। সেনাকুঞ্জের নজরকাড়া নির্মাণশৈলী, মূল ভবনের সামনে দেয়ালে আঁকা ম্যুরাল চিত্র তাকে মুগ্ধ করেছিল। এ অভিজ্ঞতার ওপর নির্মলেন্দু গুণ ‘সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ’ নামে চমৎকার একটি বই লেখেন।
প্রবেশমুখে বেশ ভিড় সামলে, স্থাপত্য নিবিড়, চমৎকার ল্যান্ডস্কেপিং- শোভিত সেনাকুঞ্জে সস্ত্রীক পৌঁছালাম বিকাল প্রায় আড়াইটায়। ততক্ষণে সামরিক কর্মকর্তা ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমনে সংবর্ধনাস্থল অনেকটাপূর্ণ হয়ে গেছে।
সেনাকুঞ্জের সামনের প্রায় মাঝখানে নির্মিত হয়েছে অস্থায়ী অনুষ্ঠান-মঞ্চ। সেনাকুঞ্জের একেবারে শীর্ষে বড় করে লেখা হয়েছেÑ ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২৪’, যা বহুদূর থেকে দেখা যায়। হেমন্ত বিকালের কমলা আলোয় সেনাকুঞ্জকে অসাধারণ দৃশ্যময় এক ইমারত বলে মনে হয়। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সামরিক ব্যান্ডে চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের গানের সুর। একপর্যায়ে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রমের ওপর প্রামাণ্যচিত্রও দেখানো হয়।
অপরূপ অপরাহ্ণের সম্মিলনী: পড়ন্ত বিকালের কনে দেখা আলোয় মোহময়ী হয়ে উঠেছে সেনাকুঞ্জ। আজকের এ বিশেষ দিনে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা পরিধান করেছেন নিজ নিজ বাহিনীর ঐতিহ্যবাহী আনুষ্ঠানিক পোশাক বা সার্ভিস ড্রেস। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসেছেন বহু বর্ণিল শাড়ি-শোভিত তাদের জীবনসঙ্গিণীগণ।
অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ-সদস্যগণ, মুক্তিযোদ্ধা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের ব্যক্তিবর্গ, ছাত্রনেতা ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট নাগরিক, কূটনীতিক ও তিন বাহিনীর চাকরিরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ। ততক্ষণে সেনাকুঞ্জের খোলা চত্বরের সামনে সবুজাভ ঘাসের গালিচায় আমন্ত্রিত নাগরিকবৃন্দ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। তাদের মধ্যে ঐক্য, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের চমৎকার আবহ তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অনুষ্ঠান আমাদের জনগণ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। যেমনটা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ: বিকাল প্রায় ৪টার দিকে ফ্যানফেয়ারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার আগমনীবার্তা ঘোষিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঞ্চে এসে পৌঁছালে সামরিক ব্যান্ডে বেজে ওঠে আমাদের জাতীয় সংগীত। এরপর প্রধান উপদেষ্টা বক্তৃতা শুরু করেন।
ততক্ষণে হেমন্তের কমলা রোদে উদ্ভাসিত সেনাকুঞ্জ চত্বর। বক্তৃতা দিচ্ছেন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের একমাত্র গ্লোবাল ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূস। এমন সামরিক পরিসরে এটাই সম্ভবত তার প্রথম বক্তৃতা। বক্তৃতার প্রথমদিকে সামরিক কর্মকর্তাদের তিনি ‘নক্ষত্র’ উল্লেখ করে সম্মান জানালেন। এতে অদ্ভুত এক আবেগ বয়ে গেল আমাদের মাঝে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বললেনÑ সশস্ত্র বাহিনী দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এবং তৎপরবর্তী সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সশস্ত্র বাহিনী বরাবরের মতো মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের ছাত্র-জনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে...।
সেনাকুঞ্জ চত্বর পরিভ্রমণ : বক্তৃতার পর প্রধান উপদেষ্টা মঞ্চ থেকে নেমে আসেন। এবার অনুষ্ঠান চত্বর পরিভ্রমণের পালা। পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস চেনা-অচেনা অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তার সঙ্গে থাকেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান।
এরপর প্রধান উপদেষ্টা উত্তরদিকে নির্মিত তাঁবুতে অতিথিদের সঙ্গে চা-চক্রে মিলিত হন। কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য সেনাকুঞ্জের এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান একটি ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা। আজকের এ বিকালে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের মাঝে মিথস্ক্রিয়ার চমৎকার সুযোগ ঘটেছে। এখানে আমন্ত্রিত নাগরিকবৃন্দ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধনও তৈরি হয়েছে। অনেকে সেনাকুঞ্জকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে বেশ উৎসাহ নিয়ে ছবি তোলেন।
এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে বেগম খালেদা জিয়া: সেনাকুঞ্জে অভূতপূর্ব ঐক্যের মিলনমেলায় বিএনপির চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত হয়ে এই অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করেন। প্রায় ১২ বছর পর সেনাকুঞ্জে এসে তিনি হয়ে ওঠেন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি বাণী মনে পড়ল : ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন’ (সুরা : আল-ইমরান)।
সামরিক-অসামরিক পরিসরের অনেক পরিচিতজনের দেখা মিলল। এ ধরনের মিলনমেলায় তিন বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিচয় ও ইন্টারঅ্যাকশনেরও চমৎকার সুযোগ ঘটে। মনে করিয়ে দেয়, তিন বাহিনীর যৌথতা, সমন্বয়, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একাত্মতার কথা। এবারের অনুষ্ঠানটি অতীতের অনেক মিলনমেলার চেয়ে অনেক বড়, লোকে লোকারণ্য, মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলো। এতে রয়েছে প্রাণের অবাধ স্পন্দনে সজীবতা ও উৎফুল্লতা। উৎসবের গন্ধের সঙ্গে আছে প্রাণময়তার চমৎকার মেলবন্ধন। তবে আশাবাদের সঙ্গে কিছুটা শঙ্কাও জন্মে। আমরা এভাবে এক হয়ে চলতে পারব তো?
এবারের অনুষ্ঠানটির ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। বেশকিছু সামরিক কর্মকর্তা অনেক বছর পর সেনাকুঞ্জে আমন্ত্রিত হয়েছেন। তাদের অভিব্যক্তিতে দৃশ্যমান হয় দীর্ঘদিন পর নিজ ঘরে ফেরার আনন্দ-বেদনা। উল্লেখ্য, এবার সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণের ব্যাপারে (কার্ড দিয়ে) বিশেষ আন্তরিকতা ও সৌজন্য দেখিয়েছে।
মিলনমেলায় কিছু ভাবনা: ২১ নভেম্বরের পড়ন্ত বিকালে, সেনাকুঞ্জের মিলনমেলায় সামরিক বাহিনী নিয়ে ভাবতে থাকি... সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে, কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করে সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে একে বিকশিত করা। সশস্ত্র বাহিনীকে ডেটারেন্স অর্জন করতেই হবে।
সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী ফের সব দল-মত-পথের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে জাতির সামনে স্বমহিমায় হাজির হয়েছে...। আশা করি সশস্ত্র বাহিনী এই মান বজায় রাখবে...। মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। তবে সামনের পথ বেশ কঠিন। জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক, মানবিক, সমৃদ্ধশালী ও ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গঠনে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।
মিলনমেলা ভাঙল: তখন বিকাল প্রায় ৫টা। ততক্ষণে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। প্রধান উপদেষ্টার সংক্ষিপ্ত সমাপ্তি-ভাষণ ও জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে ২০২৪-এর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হলো। উৎসবমুখর এক সম্মিলনী শেষ হলো। কয়েক হাজার মানুষের চলে যেতে অনেক সময় লাগল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে রাত।
নির্মলেন্দু গুণ ‘সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ’ বইটিতে- বিদায়ের ক্ষণটি বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘রাতে ফ্লাড লাইটের আলোয় সেনাকুঞ্জকে একটি ছোটখাটো তাজমহল বলে মনে হলো...। এবার ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরে আসি। তবে সেনাকুঞ্জের এ অসাধারণ সম্মিলনীর ঐক্য, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের স্পিরিট হৃদয়ে থেকে যায়।
মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক
সূত্র : আমাদের সময়