সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম আমাদের আইন উপদেষ্টা বলেছেন– ‘দেশে ঢালাও মামলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে’ এবং এটি নিয়ে নাকি তিনি খুবই বিব্রত। তিনি এতটাই বিব্রত যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছেও পরামর্শ চেয়েছেন। এখন পর্যন্ত সবই মোটামুটি ঠিক ছিল। কিন্তু যে জায়গায় এসে আমি একটু থমকে গেছি তা হলো তার নিচের উদ্ধৃতি:
‘বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। সরকারের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলা দিতো। আর এখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনও মামলা দিচ্ছি না। (সূত্র: প্রথম আলো, ১২ই নভেম্বর)’।
আসলেই কি তাই? গত ৫ সেপ্টেম্বর মাননীয় আইন উপদেষ্টার মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর অনু বিভাগের একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য একজন চিফ প্রসিকিউটর ও চার জন প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এই নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, কিন্তু সেই আলোচনা আরেক দিন হোক। ছয় সপ্তাহ পরে আইন উপদেষ্টার এই “সুযোগ্য” কৌঁসুলি দল মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন এবং তারপর ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এই ৪৬ জনের কোনও পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমি পাইনি। তবে বিগত সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের থাকার কারণটি অনুমেয়। নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী মানুষজন সরাসরি হত্যাযজ্ঞে অংশ না নিলেও যেহেতু সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন, তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারকে সবচেয়ে খারাপ মানুষ ধরা হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি যে নামটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তা হলো অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
সরাসরি ছাত্র হওয়ার কারণে এই মানুষটিকে আমি চিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। এটি সত্যি যে ডিপার্টমেন্টের আইন-কানুন মানার ব্যাপারে তার কড়াকড়ির কারণে ছাত্রজীবনে তার সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর। কিন্তু পাস করার পর যখন মাথায় বুদ্ধি হয়েছে তখন বুঝতে পেরেছি তিনি আসলে মানুষটি কেমন।
মাননীয় আইন উপদেষ্টার নিয়োগকৃত প্রধান কৌঁসুলি ১৭ অক্টোবর গণমাধ্যমকে অবশ্য এর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তার মতে– ‘জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় উসকানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত তিনি। এই আন্দোলন দমানো এবং হত্যা-গণহত্যা সংঘটনে তার উসকানি তৎকালীন সরকারকে মদত দিয়েছে। তাই তিনি এই গণহত্যার দায় থেকে দূরে থাকতে পারেন না।’
পত্রিকায় পড়লাম– স্যারের লেখা নিচের কিছু লাইনের মাধ্যমে নাকি তিনি গণহত্যায় উসকানি দিয়েছেন:
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমি মনে হয়, আর কোনোদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইব না। ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে, এরাই হয়তো সেই ‘রাজাকার’। আর যে কয়দিন বেঁচে আছি, আমি কোনও রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। একটাই তো জীবন, সেই জীবনে আবার কেন নতুন করে রাজাকারদের দেখতে হবে?”
আমি ধরে নিচ্ছি আইন মন্ত্রণালয়ে ইন্টারনেট আছে (পলক সাহেব যেহেতু এখন জেলে) এবং তারা চাইলেই মামলাটি করার আগে মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখালিখির ওয়েবসাইট সাধাসিধে কথা থেকে কোটা সংক্রান্ত লেখাটি ডাউনলোড করে পড়তে পারতো। লেখাটি একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ ও এর দৈর্ঘ্য দুই পাতার। তিনি লেখাটি শুরু করেছেন আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের সমানভাবে অংশগ্রহণ যে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার সেটি দিয়ে। এরপর তিনি পুলিশ দিয়ে যে ছেলেমেয়েদের পেটানো হয়েছে সেটি লিখেছেন। তারপর তিনি কোটা ব্যবস্থার খারাপ আর ভালো দুই দিক নিয়েই কিছু কথা বলেছেন। এরপর শাবিপ্রবির পোষ্য কোটা কীভাবে শিক্ষকরা অপব্যবহার করেছেন সেটি সেখানে থাকার সময় যে তিনি দেখেছেন সেটি বলেছেন।
লেখাটি এরপর আর এগোয়নি। ধরে নিচ্ছি এর মধ্যে কোনও এক মাধ্যমে তিনি জেনেছেন আন্দোলনকারীরা ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছে। এতে তিনি ভীষণ কষ্ট পান আর লেখাটি থামিয়ে দেন। তিনি এরপর অভিমান ভরে জানান যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই স্লোগান এসেছে সেখানে তিনি আর যাবেন না।
প্রধান কৌঁসুলি ও তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের আইন উপদেষ্টার কাছে আমার প্রশ্ন হলো– এই লেখাটি কীভাবে গণহত্যার বয়ান তৈরি করে?
আইনি অভিমতকে আমি শিক্ষার্থীদের আবেগের প্রকাশ থেকে আলাদা রাখতে চাই। যখন আমি নিজে এই স্লোগানটি শুনি তখন একটি লেখায় আমি বলেছিলাম– শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভাষা আর ব্যাকরণ কী হবে সে ব্যাপারে আমাদের বুড়োদের মাতবরি করার কোনও দরকার নেই। তারা যদি একটি সৎ অবস্থান থেকে আন্দোলন করে থাকে তাহলে এসব ভুলত্রুটি তারাই শুধরে নিবে।
এখন আস্তে আস্তে ভেতরের অনেক খবর বের হয়ে আসছে। সমন্বয়কদের মধ্যে যে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠনের নেতাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল সেটি আমরা এখন জানি। কাজেই কোন স্লোগান কোথা থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি কিছুটা অনুমান করা যায়। পাশাপাশি এটিও আমরা বুঝি যা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের আবেগ ও উষ্মার ভাষায় কখনও ভাঙচুর হয় না। ভাঙচুর, হত্যাকাণ্ড এ ব্যাপারগুলো করার জন্য আলাদা ধরনের মানুষ লাগে। তাদের যন্ত্রপাতি লাগে। তাদের টাকাপয়সা লাগে। তাদের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা লাগে। ইদানীং দেখছি তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত না হওয়া ও মামলা না হওয়ার নিশ্চয়তাও লাগে।
মোদ্দা কথা হলো জুলাই আন্দোলনে অনেক ধারার মিশেল ছিল এবং সবাই ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না। যারা ময়লা তুলসীপাতা ছিল তারা সরল বিশ্বাস, সৎ আবেগ ও যৌক্তিক দাবিতে আসা আন্দোলনকারীদের মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে এই হুজুগ তুলে দেয় যে তিনি তাদের বিপক্ষে। অথচ মূল লেখার পুরোটি পড়লে সবাই দেখতো যে তিনি আন্দোলনকারীদের প্রশংসা করেছেন ও কোটা ব্যবস্থার অপব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ দিয়েছেন।
এখন আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে কেউ যদি সত্য, অর্ধসত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে না পারে তাহলে তাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মামলা দায়ের করার আগে নিশ্চয় সরকারের আইনজীবীরা আলামত হিসেবে পুরো লেখাটি পড়েছেন। তাদের কি এটি বোঝার ক্ষমতা নেই কোনটি গণহত্যার উসকানি আর কোনটি হতাশার বহিঃপ্রকাশ?
যদি না বুঝে থাকেন তাহলে আমি একটু সাহায্য করতে পারি। এই মামলাটি যারা করেছেন তাদের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম একসময় একই আদালতে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম ও দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আইনজীবী ছিলেন।
গোলাম আজমের মামলার রায়ের ৬৩ পৃষ্ঠায় তার অপকর্মের খতিয়ানের একটি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৯শে জুন রাওয়ালপিন্ডিতে দেওয়া তার বক্তব্য। এই বক্তব্যে প্রধান কৌঁসুলির প্রাক্তন মক্কেল যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম বলেছে মুক্তিবাহিনীকে ঠেকানোর জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেন তার লোকজনের হাতে অস্ত্র দিয়ে দেয়। যদি আইন উপদেষ্টা আর কৌঁসুলি দলের এখনও কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে থাকে তাহলে এখনই পরিষ্কার করে দেই। এখানে গোলাম আজম যা বলেছে সেটিই হলো গণহত্যার উসকানি দেওয়ার ভাষা। গোলাম আজম অভিমান করে বলে নাই বাংলাদেশের মানুষ কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলো, আমি আর বাংলাদেশে যাবো না। সে বলেছে আমরা গণহত্যায় অংশ নিতে চাই, আমাদের অস্ত্র দেওয়া হোক।
এবার প্রধান কৌঁসুলির আরেকজন প্রাক্তন মক্কেল দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর রায়টিতে যাই। সাঈদী অবশ্য গোলাম আজমের মতো গণহত্যার উসকানি দেওয়ার ধার ধারে নাই। সে সরাসরি গণহত্যায় অংশই নিয়েছে। তার মামলার রায়ের চল্লিশ থেকে সাতচল্লিশ পৃষ্ঠায় এসব অপকর্মের তালিকা দেওয়া আছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে নিজের পেশাদারি ইতিহাসের কারণেই প্রধান কৌঁসুলির বোঝা উচিত ছিল গণহত্যা কী ও এর উসকানি দেওয়া বলতে কি বোঝায়।
আইন উপদেষ্টা সমীপে আমার একটাই প্রশ্ন– আপনি অত্যুৎসাহী লোকজনের ঢালাও মামলার কারণে খুবই বিব্রত। কিন্তু আপনার নিয়োগ দেওয়া প্রধান কৌঁসুলি এ দেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নামে যে গণহত্যার মামলা দিলেন, এতে কি আপনি খুবই গর্বিত?
লেখক: তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, আইবিএম থমাস জে. ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র : বাংলা ট্রি্বিউন