এখনকার ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে আমার মনে পড়ছে বাহাত্তর-তিয়াত্তরের কোনো এক সময় ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয়র শিরোনাম। সেটি ছিল, ‘ধিক এই নতজানু কূটনীতি’। পত্রিকাটির মনে হয়েছিল, ভারতের, বিশেষত বাংলাদেশে অবস্থানকালে ভারতীয় সেনাদের, কিছু কিছু ভূমিকা নিয়ে এখানে যেসব সমালোচনা হচ্ছিল, তার জবাব না দিয়ে বা বাংলাদেশ সরকারের কাছে তার জবাবদিহি না চেয়ে ভারত সদ্য স্বাধীন দেশটিতে একপ্রকার নতজানু কূটনীতি চালাচ্ছে।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ি। ছুটিতে চট্টগ্রামে এক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ঘিরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আনন্দবাজার এ সম্পাদক সমীপে এক চিঠিতে পাল্টা লিখেছিলাম। তাতে লিখেছিলাম, তাদের অনেক কূটনীতিক বরং উদ্ধত আচরণ করে থাকে, যা বন্ধুসুলভ নয়। আনন্দবাজার অবশ্য সে চিঠির ওপর ছোট্ট সম্পাদকীয় লিখে আমাদের বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুধর্মীয় একজন নেতার বিরুদ্ধে জনৈক বিএনপি কর্মীর দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ও তাঁকে গ্রেপ্তারের ঘটনা, তার জেরে সংঘর্ষ ও একজন আইনজীবীর মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের কিছু মন্দির ও ঘরে হামলার ঘটনা ঘটা থেকে ভারতে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা ছিল যুগপৎ অতিরঞ্জিত ও উসকানিমূলক।
বাংলাদেশেও এর পাল্টা বেশ উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। মূলধারার বাইরে কিছু দায়িত্বহীন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই পক্ষেরই উত্তেজক কথাবার্তার চাপান-উতোর দেখা যাচ্ছে। দুই দেশেই ক্ষোভ ও রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পরস্পরের পতাকার অবমাননা করা হয়েছে। এর মধ্যে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনা ছিল ন্যক্কারজনক। রাজপথে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী কর্মসূচিতেও কোনো দেশই পিছিয়ে নেই। পরিস্থিতি এখনো শান্ত হয়নি।
এ ধরনের পরিস্থিতিতেও দুধরনের ঘটনা ঘটতে দেখি আমরা। অনেকেই দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হয়ে প্রতিবাদ জানানোর দায়িত্ব পালন করেন। আবার অনেকেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে দলীয় স্বার্থ (ক্ষুদ্র, কেননা জাতীয় নয়) হাসিলে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। তবে আশার কথা, দুই পক্ষেই ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির পক্ষে কথাবার্তা হচ্ছে। এবারের ঘটনায় আশাব্যঞ্জক দিক হলো—অন্তত আমাদের দেশে দেখতে পাচ্ছি—সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই এই উত্তেজনার ঘোরে গা না ভাসিয়ে বাস্তবতার দিকেই চোখ রেখেছেন।
তরুণেরা যখন দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্বশীল ভূমিকা থেকে কথা বলেন, তখন এর চেয়ে সুন্দর ও স্বস্তিকর বিষয় আর কী হতে পারে। এ দেশের হিন্দু তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ভুক্তভোগীর অভিমানে পৃথক করে বা আড়ালে সরিয়ে না ফেলে মূলধারায় সম্পৃক্ত থেকে প্রকাশ্যে কথা বলছেন; এটাও অত্যন্ত স্বস্তিকর বিষয়।
আমরা চাই আইন তার নিজস্ব নিয়মে সুবিচারের পথে চলুক, পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখে এর নাজুক ও স্পর্শকাতর অনুষঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে তা দ্রুত সম্পন্ন হওয়াই কাম্য। আর মুসলিম এবং হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টধর্মনির্বিশেষে বড়-ছোট সব নাগরিকের কাছে প্রত্যাশা হবে দেশের স্বার্থ ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা এবং দেশ ও জাতির উন্নত ভবিষ্যৎ তৈরির দায়িত্বকেই অগ্রাধিকার দেওয়া।
অবশ্যই নানা বিষয় নিয়ে তাঁদের এবং সম্প্রদায়ের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে অনেক উদ্বেগ ও ক্ষোভ থাকতে পারে। বাস্তবতা বলছে, থাকাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বলার বিষয় হলো, মূলধারায় সংশ্লিষ্ট-সম্পৃক্ত থাকলে নিজেদের উদ্বেগ ও ক্ষোভের কারণগুলো ক্রমেই মূলধারার আলোচনায় ও বিবেচনায় আনা যাবে।
ক্ষমতার কেন্দ্রে দেনদরবারের চেয়ে জনগণের অর্থাৎ সামাজিক পর্যায়ে আলাপ-সংলাপের পরিসর তৈরি করাই জরুরি এবং তাতেই সব পক্ষেরই উপকার হবে বেশি। এ কথার ধারাবাহিকতায় বলা দরকার, ধর্মীয় ভিন্নতার ভিত্তিতেই পৃথক ধর্মীয় সংগঠন থাকতে পারে, কিন্তু সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণ, বিশেষত তরুণ সমাজ, যেন এগুলোয় আটকে না থাকে।
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভালোমন্দ বিবেচনায় নেওয়া এবং তাদের স্বস্তিতে ও আশ্বস্ত রাখার মূল দায়িত্ব কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর। কথাটা আমার নয়, মহাত্মা গান্ধী উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিশেষ ও বাড়তি দায়িত্বের কথা এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ, তাই এখানে মুসলমানদের দায়িত্ব বেশি।
প্রসঙ্গত, উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমের দীর্ঘ জটিল সম্পর্কের বিষয়টাও মনে রাখতে হবে। এটাও বলে নেওয়া ভালো যে পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দুসমাজ রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিক হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের তুল্য সমমর্যাদা পায়নি। আবার হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের যে দীর্ঘ জটিল ইতিহাসের কথা বলছি, তার মধ্যে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে মুসলিম মানসে বর্ণহিন্দুর কাছ থেকে প্রাপ্ত অবমাননা, বৈষম্য ইত্যাদির যে ক্ষত রয়েছে, তাকেও উপেক্ষা করা যাবে না।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, আওয়ামী লীগ আমলে হিন্দুরা ভালো থাকে; ঐতিহাসিকভাবে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, তারা এ দলের ভোটব্যাংক হিসেবেই ভূমিকা নিয়ে এসেছে। সত্যি যে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বয়ান নেই, তাদের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদেও এদের সংখ্যা বেড়েছিল, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু গভীরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এই অনুকূল আচ্ছাদনের আড়ালে হিন্দুদের বাড়ি, জমি বা মন্দির-মঠের জায়গা দখলে আওয়ামী লীগের নেতারাই বেশি অগ্রণী ছিলেন।
আজ তলিয়ে দেখলে এটাও বলতে হবে, আওয়ামী লীগ আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে সোনালি অধ্যায়ের কথা বলা হয়, তা আদতে ছিল দুই সরকার এবং উভয় দিকের সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দুই দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে আলাপ-সংলাপ, ভাববিনিময়ের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল না। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে এ রকম উদ্যোগই গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশকে এটাও বিবেচনায় রাখতে হয়, যেন দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো রকম অবিচার বা হামলা না হয়। কেননা, দুই দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিন্যাস ধর্মের ভিত্তিতে বিপরীত হওয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা চাপের মধ্যে পড়ে যায়।
ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং সমাজে উগ্র হিন্দুত্বের চর্চা বাংলাদেশকে স্বভাবতই উদ্বেগে রাখে। কারণ, ধর্মীয় উগ্রবাদের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে, যার প্রতিক্রিয়া হবে প্রতিবেশী দেশে। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা বা নতুন করে অন্যান্য মসজিদ নিয়ে বিতর্ক ওঠায় এখানে মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা আর হিন্দুদের মধ্যে ভয় ও শঙ্কা তৈরি হয়।
আবার বাংলাদেশে হিন্দুধর্মীয় নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায় ও তাঁর জামিন না হওয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে ভারতবর্ষে। দুদেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজনার পারদ বেড়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে, আর এ ক্ষেত্রে উভয় দিকেই তাতে যুক্ত হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাপিয়ে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা।
সব সমাজেই বিবেকবান মানুষ আছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস, যাঁরা উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতার ফলাফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে পারেন। আশার কথা, আমরা আমাদের দেশে তেমন কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি এবং তা আসছে অনেক তরুণের কাছ থেকে, ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু তরুণদের কাছ থেকেও। উগ্রতা নয়, অসহিষ্ণুতা নয়, নয় সাম্প্রদায়িকতা এবং কোনো রকম উসকানি ও উসকানিমূলক কাজ নয়।
আমরা চাই আইন তার নিজস্ব নিয়মে সুবিচারের পথে চলুক, পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখে এর নাজুক ও স্পর্শকাতর অনুষঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে তা দ্রুত সম্পন্ন হওয়াই কাম্য। আর মুসলিম এবং হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টধর্মনির্বিশেষে বড়-ছোট সব নাগরিকের কাছে প্রত্যাশা হবে দেশের স্বার্থ ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা এবং দেশ ও জাতির উন্নত ভবিষ্যৎ তৈরির দায়িত্বকেই অগ্রাধিকার দেওয়া।
আপাতত কাজ হবে উত্তেজনার পারদ নামানো এবং সমঝোতার পথ তৈরি করা। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠক সেদিক থেকে প্রথম বড় পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে। কেননা, প্রতিবেশী পরিবর্তনের সুযোগ সংশ্লিষ্ট কোনো দেশেরই নেই।
● আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
সূত্র : প্রথম আলো