নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলোর সাউথ এশিয়া স্টাডির অধ্যাপক আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুড। তাঁর গবেষণার বিষয় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতন্ত্র নিয়ে জনধারণা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও চর্চা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিবিদ্যা নিয়ে তাঁর একাধিক গবেষণা আছে।
সম্প্রতি এই অধ্যাপকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের একটি শীর্ষ দৈনিকে। (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪) আমার বর্তমান লেখাটি মূলত আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুডের সাক্ষাৎকারে উঠে আসা বক্তব্যের ভিত্তিতেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বরাবরই জটিল, বহুমাত্রিক এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলানো। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও গণতন্ত্রের পথে এক নিরন্তর সংগ্রামে রত। রুডের পর্যবেক্ষণ আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা ও জনগণের চাহিদার মাঝে বিদ্যমান ব্যবধানের দিকে আলোকপাত করেছে।
আজকের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধতা এবং সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে এই জনতার শক্তিকেই কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে একমত হয়ে কাজ করার উদার মানসিকতার বিকাশ না ঘটলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার হওয়ার ক্ষেত্র কীভাবে তৈরি হবে, দেখার বিষয় সেটাই।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের অতীত ইতিহাসে ফিরে তাকানো জরুরি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ১৯৯১ সালের বহুদলীয় নির্বাচনের পুনঃপ্রবর্তন এবং পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলন গণতন্ত্রের প্রতি দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রমাণ করে। তবুও কেন এই আকাঙ্ক্ষার পথ প্রতিবার নতুন বাধার সম্মুখীন হয়? কেন স্বৈরাচারী শাসনের প্রবণতা এবং দমনপীড়ন এত সহজে প্রাধান্য পায়?
রুডের ভাষায়, ‘স্বৈরাচারীরা শক্তিশালী বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ভঙ্গুর।’ এই বক্তব্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থার চিত্র। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের চমক থাকলেও অন্যদিকে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়ের প্রশ্নে এক ধরনের অন্ধকার যুগ চলেছে। বিশেষত, ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রযন্ত্র যে কঠোর দমনপীড়নের আশ্রয় নিয়েছে, তা স্বৈরাচারী শাসনের ভঙ্গুরতাকে প্রকাশ করে।
স্বৈরাচারী শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি জনসাধারণের স্বাধীন মতামতকে ভয় পায়। এর শক্তি কেবল শীর্ষ নেতার চারপাশে গড়ে ওঠা একটি ক্ষুদ্র নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে। তবে যখন এই কাঠামোটি চাপের মুখে পড়ে, তখন এর ভিত্তি খুব সহজেই ভেঙে যেতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই চাপ প্রধানত আসছে শিক্ষার্থীদের, নাগরিক সমাজের এবং এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে।
স্বৈরাচারী শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি জনসাধারণের স্বাধীন মতামতকে ভয় পায়। এর শক্তি কেবল শীর্ষ নেতার চারপাশে গড়ে ওঠা একটি ক্ষুদ্র নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে। তবে যখন এই কাঠামোটি চাপের মুখে পড়ে, তখন এর ভিত্তি খুব সহজেই ভেঙে যেতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই চাপ প্রধানত আসছে শিক্ষার্থীদের, নাগরিক সমাজের এবং এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণের প্রভাব শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, বরং স্থানীয় পর্যায়েও গভীরভাবে বিদ্যমান। রুডের গবেষণা গ্রামীণ পর্যায়ে ‘নেটওয়ার্কভিত্তিক রাজনীতি’-র দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে একজন ব্যক্তি স্থানীয় নেতার মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করতে বাধ্য হন। এই নির্ভরশীলতা স্থানীয় নেতৃত্বকে এক ধরনের ক্ষমতার কেন্দ্র বানিয়ে তোলে, যা প্রায়ই সহিংসতায় রূপ নেয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় নির্বাচনের সময় সহিংসতা এবং দলীয় প্রভাব এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে।
তবে স্থানীয় রাজনীতির এই দুর্নীতি এবং সহিংসতা কেবল স্থানীয় পর্যায়ের নয়। এটি একটি কেন্দ্রীয় সমস্যার প্রতিফলন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যখন নিজে জবাবদিহি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে, তখন স্থানীয় পর্যায়েও একই আচরণ দেখা যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই এক ধরনের দায়মুক্তির সুবিধা নিয়ে কাজ করে এসেছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নেতৃত্বের অনিয়ন্ত্রিত আচরণ একটি সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে। এঙ্গেলসন রুডের মতে, ‘এই দায়মুক্তি এমন একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার জন্ম দেয়, যেখানে কিছু ব্যক্তি সম্পদ এবং ক্ষমতার একচেটিয়া মালিক হয়ে ওঠেন।’
আজকের বাস্তবতায় এই প্রবণতা আরও প্রকট হয়েছে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার বাংলাদেশকে একটি গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
গণতন্ত্র কেবল একটি নির্বাচন নয়; এটি একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণের মতামত, অংশগ্রহণ এবং অধিকার সমুন্নত থাকে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি গণতন্ত্রের এই মূল চেতনাকে বারবার চ্যালেঞ্জ করছে।
রুডের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে, জনগণ এখনও শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখে। কারণ, এটি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর নেতৃত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতিæতি দেয়। কিন্তু শক্তিশালী নেতৃত্বের সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণের ঝুঁকি অবিচ্ছেদ্য। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন এবং জবাবদিহিমূলক হতে হবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সামাজিক প্রতিবাদ প্রমাণ করে যে, জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের চেতনাটি এখনো গভীরভাবে বেঁচে আছে। যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার করা যায় এবং নেতৃত্বে জবাবদিহিতা আনা যায়, তবে বাংলাদেশ একটি নতুন পথে এগিয়ে যেতে পারে। তবে এই পথ সহজ নয়। এটি সময়সাপেক্ষ এবং ধৈর্যের পরীক্ষা। বাংলাদেশের জনগণ অতীতে বারবার প্রমাণ করেছে যে, তারা অধিকার আদায়ে একত্রিত হতে জানে।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দৃশ্যমান হয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধ বহু রূপে প্রকাশ পেয়েছে। কখনো ফেসবুকের সমালোচনা, কখনো দেয়াললিখন, কখনোবা বৃহৎ আন্দোলনের রূপে। এই প্রতিরোধ কেবল একটি নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি ব্যবস্থা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও। তবে স্বৈরাচারী কাঠামোর স্বাভাবিক প্রবণতা হলো সব ধরনের মতপ্রকাশের জায়গা সংকুচিত করা।
আগেই বলেছি, রুডের মতে, স্বৈরাচারীরা শক্তিশালী বলে মনে হলেও আসলে তারা ভঙ্গুর। তারা একটি কৃত্রিম কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যা অনেক ব্যয়ে এবং ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলের উদাহরণে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্নয়ন প্রকল্পের দৃশ্যমান সাফল্য এবং প্রশাসনিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে এক ধরনের নড়বড়ে বৈধতা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওপর দমনপীড়নের মতো ঘটনা এই বৈধতাকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুদিন ধরেই মেরুকৃত। নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী দল সবকিছু ছিনিয়ে নেয় এবং পরাজিত দলকে প্রায়ই রাজনীতির মাঠের বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও এক ধরনের শোষণমূলক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রুড তুলে ধরেছেন গ্রামীণ পর্যায়ের নেটওয়ার্কভিত্তিক রাজনীতি, যেখানে একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে স্থানীয় নেতার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। এই নির্ভরশীলতাই নেতৃত্বের দুর্নীতি এবং সহিংসতাকে টিকিয়ে রাখে।
তবে এ সমস্যার সমাধান কোনো একক কাঠামোগত পরিবর্তনে সম্ভব নয়। বরং দুর্নীতি ও সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি যুক্তিসংগত অবস্থান তৈরি করতে হবে। গণতন্ত্র নিখুঁত সমাজ গঠন করে না; এটি সমাজের দ্বন্দ্বগুলোকে সভ্যতার কাঠামোয় পরিচালনা করার একটি প্রক্রিয়া।
গণতন্ত্রও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যেখানে সময় এবং ধৈর্যের প্রয়োজন। চীনের মতো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন দ্রুত উন্নয়ন নিশ্চিত করলেও, তা জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমিয়ে দেয়। বিপরীতে, গণতান্ত্রিক সমাজে মতবিরোধ এবং বিরোধিতার মধ্য দিয়েই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের জনগণ বারবার নিজেদের অধিকার এবং নেতৃত্বের বিষয়ে সচেতনতার প্রমাণ দিয়েছে। রুড ঠিকই বলেছেন, এটি সহজ পথ নয়। তবে যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা যায়, তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও পরিণত হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নেতৃত্বের জবাবদিহিতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
আজকের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধতা এবং সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে এই জনতার শক্তিকেই কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে একমত হয়ে কাজ করার উদার মানসিকতার বিকাশ না ঘটলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার হওয়ার ক্ষেত্র কীভাবে তৈরি হবে, দেখার বিষয় সেটাই। জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি সামনে এসেছে। কে, কার সঙ্গে, কীসের ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তুলবে- তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। ভুল করা দোষের কিছু নয়। তবে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনাগ্রহ রাজনীতিতে অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।
সূত্র : জাগো নিউজ