পথ হারিয়ে পথ খুঁজছে বাংলাদেশের রাজনীতি!

সালেক উদ্দিন
  ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪০


বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যেন এক ঘূর্ণিপাকে আটকে পড়েছে। আওয়ামী লীগের পতনে মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও এক নতুন অনিশ্চয়তা তাদের গ্রাস করেছে। প্রশ্ন এখন একটাই- এবার কে নেতৃত্ব দেবে দেশকে? দীর্ঘ সময় পর জনগণ আবার রাজনীতির দরজায় কড়া নাড়ছে, কিন্তু প্রশ্নটা আগের চেয়ে কঠিন– এই রাজনীতি কি আবারও পুরোনো পথে হাঁটবে, নাকি নতুন কোনও দিগন্তের সন্ধান দেবে?
বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সেই প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে। দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনে তারা ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন মানুষ জানতে চায়, বিএনপি কি সত্যিই বিকল্প হতে পারবে, নাকি কেবল ক্ষমতার পালাবদল ঘটাবে? জনগণ কেবল সরকারের পরিবর্তন চায় না, চায় রাষ্ট্রচিন্তার পরিবর্তন। তারা চায় না বাংলাদেশ আর কোনও শক্তিধর প্রতিবেশীর ইশারায় চলুক।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের প্রভাব গভীরভাবে দৃশ্যমান ছিল। সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ঘাটতি, পানিবণ্টন, কিংবা রাজনৈতিক সমর্থন—সব ক্ষেত্রেই ভারতের প্রভাব স্পষ্ট ছিল। এই প্রভাব বিএনপি বা জাতীয় পার্টির আমলেও পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল না, যদিও তা ততটা প্রকাশ্যও ছিল না। একবার যদি কোনও দেশ পররাষ্ট্রনীতি আত্মসমর্পণের অভ্যাসে পড়ে, জনগণের জাতীয় আত্মবিশ্বাসও ক্ষয় হতে শুরু করে। আজকের রাজনীতির বড় চ্যালেঞ্জ—এই মানসিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি পাওয়া।
ব্যতিক্রম ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি ভারতীয় প্রভাবমুক্ত, সমতাভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির সূচনা করেছিলেন। ইসলামি চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংমিশ্রণে তিনি গড়েছিলেন “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ”—যা তৎকালীন ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির জনপ্রিয়তা তাই ছিল আকাশচুম্বী। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বিএনপি সেই নীতি ও দর্শনের প্রতি কতটা অনুগত?
অবশ্যই, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা অপরাধ নয়। পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভিত্তিতে সহযোগিতা অপরিহার্য। কিন্তু কূটনীতি যদি আত্মসমর্পণে পরিণত হয়, সেটাই বিপজ্জনক।
সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসেছে, ভারতীয় বিশ্লেষকদের ধারণা জামায়াতের নতুন নেতৃত্ব ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে বিএনপির জন্য এটি ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ভারতপন্থি মনোভাবের অভিযোগ উল্টো বিএনপির দিকেই ফিরে এসেছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী যারা একসময় ভারতবিরোধী অবস্থানে দৃঢ় ছিল, তাদের মধ্যেও এখন কৌশলগত নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছিলেন, “ভারতকে শত্রু নয়, প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে হবে।” নতুন প্রজন্মের দল এনসিপিও জনমত গঠন ও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সক্রিয়, তবে বড় রাজনৈতিক প্রশ্নে তাদের অবস্থান এখনও অস্পষ্ট।
বিএনপি সম্প্রতি আন্দোলন ও কর্মসূচিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২২-২৩ সালে ঘোষিত ১০ দফা কর্মসূচি মাঠে কার্যকর হয়নি। পুলিশের গুলিতে কয়েকজন কর্মী নিহত হলেও দলটি রাজপথে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। দমন-পীড়ন ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে তাদের জনসংযোগও ক্ষয়প্রাপ্ত। ফলে আন্দোলন হারিয়েছে ধার, নেতৃত্ব হারিয়েছে দিকনির্দেশনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি যদি সত্যিকারের বিকল্প হতে চায়, তাদের চারটি বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে-
১. ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে সমতার ভিত্তিতে, তাঁবেদারির নয়।
২. ইসলামী ও জাতীয় মূল্যবোধের সংহত প্রতিফলন ঘটাতে হবে রাজনৈতিক চর্চায়।
৩. নবীন প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনতে হবে, যাতে দলটি ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠাননির্ভর হয়।
৪. বিএনপির কিছু নেতার বিরুদ্ধে যে ‘র’-এর সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ আছে, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে।
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির সামনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক সুযোগ। দেশ এখন শূন্যতায়। জনগণ খুঁজছে নতুন নেতৃত্ব। যদি বিএনপি ভারতের প্রভাবমুক্ত, জিয়াউর রহমানের নীতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ ঘটাতে পারে, তবে তারা শুধু সরকার নয়, ইতিহাসও পুনর্লিখন করতে পারবে। কিন্তু যদি দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, পুরোনো ভারত-সন্তুষ্টি নীতিতে অটল থাকে, তবে জনগণ আর দ্বিতীয়বার ভুল করবে না। মানুষ এখন ভয়কে পেছনে ফেলে আত্মসম্মানে জেগে উঠেছে।
শুধু বিএনপি বা জামায়াত নয়, গণআন্দোলনের পর উদ্ভূত এনসিপি-যাদের অনেকে তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেখছেন তারাও আজ পথ হারিয়ে পথ খুঁজছে। কোন দল সেই পথ ফিরে পাবে, তা এখনো অজানা। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- যে পথে জনগণের বিশ্বাস ফিরে আসবে, সেই পথই ইতিহাসের দিক নির্দেশ করবে।
বাংলাদেশের মানুষ আজ এমন নেতৃত্ব চায়, যারা বিদেশি ছায়ায় নয়, নিজস্ব আত্মবিশ্বাসে রাষ্ট্রকে দাঁড় করাতে পারে। যেখানে সীমান্তে লাশ পড়বে না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে না, আর “চেতনা” ও “দেশপ্রেম” ভয়ের নয়, মর্যাদার প্রতীক হবে। সেই নেতৃত্বের অপেক্ষাতেই আছে বাংলাদেশ।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন