
দেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর একটি ঘটনাবহুল মাস। ৩ তারিখে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে নিজ বাসায় আটকে রাখার পর রাতে ঘটে জেলহত্যার ঘটনা। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন সেনাপ্রধান হন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। রংপুর ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দারকে। অন্যদিকে জেলহত্যার খবর প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর বাইরে জানাজানি হলে সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ৭ নভেম্বর দেশ সাক্ষী হয় আরেকটি অভ্যুত্থানের। ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বইয়ে সে সময়ের ঘটনাগুলো নিয়ে লিখেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীরবিক্রম)। চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে আমি তাড়াতাড়ি আর্মি হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। সেখানে এসে আমি আমার অধীনস্থ অফিসারদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। বস্তুতপক্ষে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না বললেই চলে। আর্মিতেও দৈনন্দিন কোনো কাজকর্ম চলছিল না। আর্মি হেডকোয়ার্টারে অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। পুরো সেনানিবাসের পরিবেশ ছিল অস্বাভাবিক ও থমথমে। কেউ কোনো কাজকর্ম করছিল না। সবাই এখানে-সেখানে জটলা পাকিয়ে আলাপ-আলোচনা করেই সময় কাটায়। আলোচনা-শেষে অফিস থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সহকারী সুবেদার আলিমুদ্দিন আমাকে একটা বাংলা প্রচারপত্র দেখান। ওই প্রচারপত্র সেনানিবাসে প্রচুর পরিমাণে বিলি করা হয়েছে বলেও আমাকে জানান। প্রচারপত্রটি ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নামে ছাপানো হয় এবং উত্তেজক ভাষায় বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়। উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে ছিল, সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার থাকবে না। কেননা অফিসাররা সৈনিকদের তাদের নিজ ক্ষমতা লাভের প্রয়াসে ব্যবহার করে। এ ছাড়া অফিসারদের জন্য ‘ব্যাটমেন’ প্রথা বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি। এ প্রচারপত্রটি অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা বিলি করছে বলে আমাকে জানানো হয়।
জিয়ার মুক্তি
বিকেলে আমি বাসায় ফিরে আসি। শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তিবশত আমি আর বাড়ি থেকে বের হইনি। হঠাৎ মধ্যরাতের পর চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। গোলাগুলি প্রথমে শুরু হয় বর্তমান এয়ারপোর্ট রোডের পাশে অবস্থিত অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে, এরপর গ্যারিসন মসজিদের পাশে অবস্থিত সিগনাল ইউনিট থেকে। আমি উঠে ইউনিফর্ম পরি এবং বাইরে যেতে চাইলে আমার গার্ডরা আমাকে রাতের অন্ধকারে গোলাগুলির মধ্যে বাইরে যেতে নিষেধ করে এবং বাসাতেই থাকতে অনুরোধ করে। এর মধ্যে হঠাৎ করে আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে যা গত কয়েকদিন যাবৎ বিচ্ছিন্ন ছিল।
সিগনাল সেন্টার থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হয় যে, খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান আরম্ভ হয়েছে। এরপর আমি বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম কিছু কালো পোশাক, কিছু খাকি এবং বেসামরিক পোশাকে সজ্জিত শ’খানেকের মতো লোক ওপরের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে জেনারেল জিয়ার বাড়িতে ঢুকছে। জিয়াকে তাঁর বাড়ির বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে পাশেই দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে নিয়ে যেতেও দেখলাম। জিয়া তখন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত ছিলেন।
একটু পর আবার আমার টেলিফোন বেজে ওঠে। এবার চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও লে. কর্নেল আমিনুল হক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার) আমাকে জানান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। ৩ নভেম্বরের ক্যুর পর আমিনুল হককে চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে অ্যাটাচ করা হয়। এদিকে অভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম না। কোথায় কী ঘটছে তাও জানা সম্ভব না। ভোরবেলায় বাড়িতে তিন-চারজন লোক প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। প্রহরীরা তাদের গেটে বাধা দেয়। তাঁরা বলেন, জিয়ার বাড়িসংলগ্ন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে আমাকে যাওয়ার জন্য জেনারেল জিয়া খবর পাঠিয়েছেন। এরপর বেসামরিক পোশাকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মুনীর (মরহুম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের জামাতা, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল) আমার বাসায় আসেন। তিনি আমাকে বিস্তারিত তথ্য জানান এবং বলেন, জিয়া সত্বর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে যাওয়ার জন্য বলেছেন। তিনি আরো জানান, ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীকে নিয়ে আসার জন্য আর্মি ভিআইপি রুমেও লোক পাঠানো হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার শওকত যশোর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সম্প্রতি যে সভা আহ্বান করেছিলেন তাতে অংশ নেওয়ার জন্য। পরে শুনেছি মীর শওকত যে ভিআইপি রুমে ছিলেন সেখানেও সৈনিকরা গুলি চালায়। তিনি সেখান থেকে বের হয়ে পাশেই তৎকালীন মেজর জেনারেল এরশাদের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মেজর মহিউদ্দীন (মুজিবহত্যায় দণ্ডপ্রাপ্ত) তাঁকে নিয়ে আসে।
রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য তাহেরের অনুরোধ
আমি ইউনিফর্ম পরে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে পৌঁছি। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ছিল আমার ও জিয়ার বাসা থেকে শ’দুয়েক গজ দূরে, বর্তমান শহীদ সরণির পাশে। সেখানে গিয়ে দেখি হুলস্থূল অবস্থা। অফিসের ছোট একটি কামরায় জিয়া বসে ছিলেন। কর্নেল আমিনুল হক ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের সুবেদার মেজর আনিস ও কয়েকজন অফিসার সেখানে ছিলেন। একটু পরে একটি বেসামরিক জিপে করে দুই-তিনজন লোকসহ অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তাহের সেখানে উপস্থিত হন। লে. কর্নেল তাহের মঞ্জুর ও জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার অধীনে যোগদান করেন। পরে তিনি সেক্টর কমান্ডার হন এবং একপর্যায়ে যুদ্ধে আহত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন আর্মিতে ছিলেন এবং অবসর নেওয়ার পর ওই সময় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ সংস্থায় চাকরি করতেন। এসেই তিনি জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আমরা জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যেতে বারণ করি। এ সময় লে. কর্নেল আমিনুল হক ও তাহেরের সঙ্গে ঝগড়া বেধে যায়। একপর্যায়ে আমিনুল হক তাহেরকে বলে বসেন, ‘আপনারা (জাসদ) তো ভারতের বি-টিম’। ফলে তাহের রাগান্বিত হয়ে সেখান থেকে চলে যান।
পরে রেডিওতে প্রচারের জন্য জিয়ার ছোট একটা বক্তৃতা টেপ করে পাঠানো হয়। তখনও সেখানে ইউনিফর্ম ছাড়া বেসামরিক পোশাকে কিছু অফিসার উপস্থিত ছিলেন। তাদের অনেককেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকজন বাড়ি থেকে ধরে এখানে নিয়ে আসে। আমি মনে করি এরকম পরিস্থিতিতে আর্মি অফিসারদের ইউনিফর্ম ছাড়া বেসামরিক পোশাকে থাকা ঠিক নয়। কেননা বাস্তবে দেখা গেছে সামরিক অভ্যুত্থান বা বিশৃঙ্খলার সময়ে হতাহত অফিসারদের অধিকাংশই বেসামরিক পোশাক পরিহিত ছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ মুজিবের সামরিক সচিব ড্রেসিং গাউন পরা অবস্থায় নিহত হন। (পৃষ্ঠা ৭৩, লেগ্যাসি অব ব্লাড) তখন ওই পোশাকেই তিনি গাড়ি চালিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া ৭ তারিখের সিপাহি অভ্যুত্থানে হতাহত আর্মি অফিসারদের অধিকাংশই বেসামরিক পোশাকে ছিলেন। সংকটকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বেসামরিক পোশাকে থাকার প্রবণতা দেখা যেত যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
খালেদ মোশাররফ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা
সকালেই খবর আসে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা এবং লে. কর্নেল হায়দারকে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয়েছে। লে. কর্নেল হায়দার (১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন) স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধ করেন। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দার এবং কর্নেল হুদা প্রমুখ ৭ নভেম্বর বঙ্গভবনে ছিলেন এবং পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে শুনে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। পথিমধ্যে তাঁরা কোথাও ইউনিফর্ম বদল করে বেসামরিক পোশাকে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন।
এই রেজিমেন্ট কর্নেল হুদার অধীনে রংপুরে ছিল এবং ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পরপর খালেদ মোশাররফ এই ইউনিটটিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন পর্যন্ত ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের খবর পাওয়া যায়নি। পরে অবশ্য খবর আসে, কর্নেল জামিল বঙ্গভবনের দেয়াল টপকানোর সময় পায়ে ব্যথা পান এবং আহত অবস্থায় ঢাকার অদূরে আত্মগোপন করে আছেন। এ খবরের পর আমি তাঁর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করে নিরাপত্তার ব্যবস্থাদি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে ঢাকায় এনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করি। এর মধ্যে খবর আসে যে, শহরে আরো কয়েকজন আর্মি অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।
অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ
দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে বেরিয়ে জেনারেল জিয়া, আমি এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাই। আর্মি হেডকোয়ার্টারে আলাপ-আলোচনায় ঠিক করা হয়, অভ্যুত্থানকারীদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখবেন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখার আগে অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ পর্যায়ে সেনাপ্রধান এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আমাকে বললেন, যেহেতু আমি অনেকদিন থেকে ঢাকায় আছি এবং ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলাম এবং বর্তমানে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল সেহেতু এ দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হচ্ছে তাদের সংগঠিত করার কাজে। তাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে আমার মধ্যে অনেক সংশয় ও অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ তারা হয়তো অনেক দাবি উত্থাপন করবে এবং তাদের বুঝিয়ে শান্ত করা কষ্টকর হবে।
যাহোক, আমি দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি, আর্মি এমপি ইউনিট ও আর্মি হেডকোয়ার্টারের সুবেদার মেজরদের খবর দিলাম যে, অপরাহ্ণে সেনা মিলনায়তনে (বর্তমান গ্যারিসন সিনেমা হল) আমি সৈনিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে বক্তব্য রাখবো। সে অনুযায়ী বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও এবং এনসিওসহ তাদের প্রতিনিধিদের সেনা মিলনায়তনে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা করতে বলি। তবে তখন বেশিরভাগ অফিসার সিপাহিদের অভ্যুত্থানের কারণে আর্মি হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলেন না। পরে মিলিটারি পুলিশ ইউনিটের ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক (বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত) যিনি একজন উদ্যোগী ও কর্তব্য পরায়ণ অফিসার, তাঁকে নিয়ে আমি সেনা মিলনায়তনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু সৈন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মিলনায়তনে উপস্থিত হয়েছে। আমি তাদের অস্ত্র বাইরে রেখে আসতে নির্দেশ দিই। এই নির্দেশের মাধ্যমে আমি মূলত তাদের পরীক্ষা করছিলাম যে, তারা আমার কথা আদৌ শুনবে কি না। জিয়া আমাকে সেখানে পাঠিয়েছেন তাদের মানসিক অবস্থা যাচাই ও শান্ত করার জন্য, যাতে পরে তিনি এসে বক্তৃতা দিতে পারেন। যাহোক, তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে রেখে আসার পর আমি আমার বক্তব্য শুরু করি।
বিপ্লবীরা তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে। আমি তাদের জানাই, আর্মি শৃঙ্খলা, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি তড়িঘড়ি করে বদলানো সম্ভব নয়। আমি আরো বলি, উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য দেশ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যাহোক, আলোচনা শেষে আমি তাদের জানাই, কিছুক্ষণ পর সেনাপ্রধান জিয়া এসে তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, ৭ নভেম্বর সৈনিকদের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কিছু সরকারি কর্মচারীও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তারাও বেসামরিক প্রশাসনে তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিল। ফলে কিছু কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক তাদের সঙ্গে সেনানিবাসের বাইরে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু সেনানিবাসের পরিস্থিতি আয়ত্তে আসায় পরে বাইরে তারা আর তেমন কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা করার সাহস পায়নি।
আজও ভাবলে গা শিউরে ওঠে যে, ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের যদি সেদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যেত তাহলে সারা দেশে সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে একটা ‘নেতৃত্বহীন ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণী-সংগ্রাম’ শুরু হয়ে যেত। সৈনিকদের সেদিনের স্লোগানই ছিল ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। সিপাহি জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’।
যাহোক, আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমি খবর পাঠানোর পর জেনারেল জিয়া এসে উপস্থিত হন। তখনও পরিস্থিতি কিছুটা অশান্ত ছিল। জিয়া তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে তাঁর কোমরের আর্মি বেল্ট খুলে মাটিতে ছুড়ে দেন এবং বলেন, এতো দাবি দাওয়া ওঠালে আমি আর এ আর্মি চিফ থাকতে চাই না। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। বক্তৃতা শেষে আমরা সবাই আর্মির হেডকোয়ার্টারে ফেরত যাই। এরপর ঠিক করা হয়, ঢাকার বাইরে থেকে কিছু পদাতিক সৈন্য এনে ঢাকা সেনানিবাসে উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের আয়ত্তে আনা ও সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী যশোর থেকে কিছু পদাতিক সৈন্য এনে বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তার কাজে মোতায়েন করা হয়।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে আর্টিলারি, ল্যান্সার, আর্মার, সিগনাল, অর্ডন্যান্স ও সাপ্লাই কোরের বেশিরভাগ সৈনিক জড়িত ছিল। ঢাকায় অবস্থিত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা এ অভ্যুত্থানে তেমন সাড়া দেয়নি। আবার প্রতিরোধও করেনি। এর কারণ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল জামিল ঢাকা ব্রিগেডের পদাতিক বাহিনীকে ব্যবহার করেন। কিন্তু সে অভ্যুত্থানে সৈনিকদের তেমন সমর্থন ছিল না। শুধু আদেশের কারণে বাধ্য হয়ে হয়তো তারা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল যা আমি আগেও বর্ণনা করেছি। এখানে আরেকটি কথা বলতে হয়, অভ্যুত্থানের পরপরই রেডিওতে জিয়ার একটি রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়। এ ছাড়া তিনি কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে সাহসের সঙ্গে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
মীর শওকত ডিভিশন কমান্ডার
ঢাকা ও অন্যান্য সেনানিবাসে ৭ তারিখের সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব খুব ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকে। কিন্তু তখনও সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা অত্যন্ত নাজুক এবং অধিকাংশ অফিসার দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন পদবির সৈন্যরা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। এদিকে এ বিদ্রোহের সময় সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা, বিশেষ করে অফিসার হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী ব্যক্তিদের বিচার করার জন্য আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে সেনাপ্রধানকে বলি। কিন্তু তিনি এতে উৎসাহী ছিলেন না। অপরদিকে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী যশোর সেনানিবাসে ফেরত না গিয়ে ঢাকায় একটা ডিভিশন গঠন করে তাঁকে ডিভিশন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগের জন্য সেনাপ্রধান জিয়াকে অনুরোধ করেন এবং চাপ দিতে থাকেন। আমি এর ঘোর বিরোধিতা করি এবং বলি যে, একটি করে ডিভিশন গঠন করা ঠিক হবে না। করলে সব স্থানেই একসঙ্গে ডিভিশন করা উচিত।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঢাকায় নবম ডিভিশন নাম দিয়ে একটা ডিভিশন করা হলো এবং ব্রিগেডিয়ার শওকতকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ডিভিশন কমান্ডার করা হলো। তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর ১৯৭৩ সাল থেকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁকে বদলি করে ঢাকায় এনে আর্মি হেডকোয়ার্টারে সিজিএস করা হলো। খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর পর থেকে মঞ্জুর আসার আগ পর্যন্ত মীর শওকত অস্থায়ীভাবে সিজিএস-এর কাজ করেন।
সূত্র: এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক। লেখক: মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রম
সূত্র: সমকাল