আগামীর বাংলাদেশ হোক শরতের নদীর মতো

মোহাম্মদ বায়েজিদ সরোয়ার
ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৯


হেমন্ত এসে পড়লেও আমার মনে এখনো আশ্চর্যরকম শরৎ-মুগ্ধতা। আমরা রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটা সময় পার করছি। এ ধরনের সমাজে যেমন থাকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অস্থিরতা, স্থবিরতা, সৃষ্টির বেদনা; আবার ভবিষ্যতে সুন্দর দিনের প্রবল প্রত্যাশাও থাকে। আরববসন্তকালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে সেকেন্ডমেন্টে দায়িত্ব পালন করায় কাছ থেকেই এসব দেখা। গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে পটুয়াখালীর ‘সাগরকন্যা’ কুয়াকাটায় দেখলাম শরতের অনুপম বসন্তকাল। ভাবছিলাম, আগামী দিনের বাংলাদেশ হোক শরতের নদীর মতো বিস্তীর্ণ-উদার, শান্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, পরিপূর্ণ ও সুন্দর।
ঢাকা থেকে সপরিবারে সড়কপথে কুয়াকাটাযাত্রা। বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, পদ্মা নদী পেরিয়ে ফরায়েজি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও কৃষকদরদি হাজী শরীয়তউল্লাহর স্মৃতিবিজড়িত মাদারীপুরের ওপর দিয়ে বরিশালের দিকে এগিয়ে যাই। শহরে প্রবেশপথে এ অঞ্চলের কয়েকজন স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিদের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ‘শেরেবাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন-‘ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান।’ ব্যতিক্রমধর্মী শহর বরিশাল ছিল কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় শহর। এ শহরের বিখ্যাত বিএম কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল বরিশাল শহর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।
কবি শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিবিজড়িত সন্ধ্যা নদী, কীর্তনখোলা (জীবনানন্দ দাশের ভাষায় ‘জলসিঁড়ি’) পায়রা ও আন্ধারমানিক নদী পেরিয়ে কুয়াকাটায় এলাম দুপুরে। শরতে কুয়াকাটার সৌন্দর্য যেন উপচে পড়েছে। আকাশে ভাসছে সাদা মেঘের ভেলা। রিসোর্টের কিছু দক্ষিণেই সমুদ্র। একদল সাদা সি গাল বঙ্গোপসাগরের সৈকতে আমাদের স্বাগত জানায়। কী যে সুন্দর এ শান্ত সমুদ্র।
কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমদিকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ‘লেমবুর বন’। খুব সুন্দর এ স্থানটি সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিখ্যাত। আরও পশ্চিমে মোটরসাইকেলে চড়ে সৈকত ধরে গেলে ‘তিন নদীর মোহনা’। ওপারে ফাতরার বন। বৈকালিক এ অ্যাডভেঞ্চারে মন ভরে যায়। এর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে বরগুনা জেলার তালতলীর মনোমুগ্ধকর নিদ্রার চরের ‘শুভ সন্ধ্যা সৈকত’।
পরদিন ভোরে কুয়াকাটার পূর্বাঞ্চল দেখি। এটি আরেক বিস্ময়। গঙ্গামতীর চর সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিখ্যাত। এখান থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে অ্যাডভেঞ্চারের মহাসুযোগ। সৈকতে বালুর ওপর দিয়ে চলছে মোটরসাইকেল। লাল কাঁকড়ার চর। ডানে সমুদ্র, বামে সুন্দর ঝাউবন। সাগরলতার ঝাড়।
প্রায় ৮ কিলোমিটার পর কাউয়ার চর। আশ্চর্যরকম সুন্দর এ স্থানটিকে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়। সমুদ্র, সবুজ বন, ডাঙার দূর্বাঘাস যেন সবুজ কার্পেট। চোখ জুড়িয়ে যায়। আমরা বিস্ময়াভিভূত। এখানে এসে আমার দেখা সুইজারল্যান্ডের কথা মনে পড়ল। পূর্বদিকে চোখে পড়বে ‘রামনাবাদ’ চ্যানেল। এর পর রাঙ্গাবালী দ্বীপ।
১৭৮৪ সালে বার্মার (মিয়ানমার) রাজ্য রাখাইন সম্প্রদায়ের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে বহু রাখাইন আরাকান ত্যাগ করে নৌকায় অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। তারা বঙ্গোপসাগরের তীরের রাঙ্গাবালী দ্বীপে এসে অবতরণ করে ও বসতি গড়ে। রাঙ্গাবালীর পূর্বে আগুনমুখা নদী। এরপর দক্ষিণের দ্বীপ ও নতুন চরাঞ্চল: চরফ্যাশন, কুকড়ি-মুকড়ি, চরমন্তাজ, চরকাজল, ঢালচর ও মনপুরা...। রাতে এখানে আকাশজোড়া তারার মেলা। এ মায়াময় শরতে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় দক্ষিণের এসব দ্বীপে বেড়ানো অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে।
বৃহত্তর বরিশাল বিশেষত পটুয়াখালীর সমুদ্র তীরব্রর্তী লড়াকু সংগ্রামী মানুষের কথা ভাবি। সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা ভয়ংকর হামলা চালাত। প্রলয়ংকরী ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে পটুয়াখালীবাসী টিকে আছে। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়, ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলার আঘাতে আঘাতে তারা বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু আবার তারা উঠে দাঁড়ায়। এখানকার মানুষ পরাজয় মানে না।
‘আগুনমুখা’ সাত নদীর মোহনা। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর পূর্বদিকে বহমান আগুনমুখা নদীর ভয়াল মূর্তি ছিল কিংবদন্তির মতো। নূরজাহান বোস ‘আগুনমুখার মেয়ে’ বইতে আগুনমুখা-রাঙ্গাবালী অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। এ অঞ্চলের সমুদ্র তেজি, সাহসী ও লড়াকু মানুষ যেন বাংলাদেশের সংগ্রামমুখর মানুষেরই উজ্জ্বল প্রতিনিধি। এসব লড়াকু মানুষের সালাম।
এ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে; সেনানিবাস, নৌঘাঁটি, কোস্ট গার্ড ঘাঁটিসহ বেশকিছু প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাজ চলছে। তবে এ অঞ্চলের কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিবেশগত ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণের আগে এসব ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিতে হবে। এ অঞ্চলের মানুষ এখন জলবায়ু পরিবর্তনে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তরুণদের কর্মসংস্থান তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বিকাশে সচেষ্ট থাকতে হবে। পটুয়াখালীতে রয়েছে অপার পর্যটন সম্ভাবনা। এর জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত ও সমন্বিত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ।
ফেরার পথে লেবুখালীতে পায়রা নদীতে একটা বোটে ভেসে বেড়াই। বর্ষায় এ নদী রুদ্র রূপ নিলেও শরতে নদীটি বর্ষার মতোই চওড়া-বিস্তৃত। অনেক শান্ত, বিনম্র ও সুন্দর। বোটে ভেসে আমাদের জাতীয় জীবনের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা (বর্ষা বনাম শরৎ) চিন্তা করি।
১৯৪৭ সালে আংশিকভাবে এবং ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশে জনসাধারণের সামনে কোটি কোটি সুযোগের অবিশ্বাস্য দরজা হঠাৎ খুলে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াতব্যবস্থা থেকে শুরু করে এ সুযোগের বিশাল প্রসার দেশের প্রায় প্রতিটি আঙিনাকে স্পর্শ করেছে। গত ৫৪ বছরে আমাদের দেশের যে বিপুল উন্নতি হয়েছে, তা তার আগের এক হাজার বছরের বৈষয়িক সমৃদ্ধিকে অতিক্রম করেছে...। এমন ধারণা প্রথম পাই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘বিস্রস্ত জর্নাল’ পড়ে।
এ অধ্যাপক আরও লিখেন-‘এ ধরনের প্রস্তুতিহীন, আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত ও সর্বগ্রাসী বিকাশের মুখে যে কোনো সুশীল মূল্যবোধের পতন ঘটে যাওয়ার কথা এবং সত্যি সত্যি ঘটেছেও। এখন নীতিবোধ পদদলিত, সুবচন নির্বাসনে, শুভ্র সুন্দর কল্যাণ, আনন্দ পলাতক এবং ব্যক্তি আর ব্যক্তি স্বার্থের বর্বর আগ্রাসনের নিচে সারাটা জাতি লুণ্ঠিত এবং বিস্রস্ত।’
গত প্রায় ৫৪ বছরে বাংলাদেশের একটা শ্রেণি-বিশেষত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারি চাকরিজীবীদের একাংশ ক্ষমতা দখল, জরবদস্তি, হত্যা, দুর্নীতি, লুণ্ঠন, অর্থ লুট, ব্যাংক ডাকাতি, বিদেশে টাকা পাচার করে চমৎকারভাবে নিজেদের জীবন পালটে ফেলেছে। এ যেন বর্ষার নদী। দুকূল ভেঙে-চুরে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। বিশেষত গত ১৬ বছরে একদল দুর্ধর্ষ অলিগার্কদের ধনরত্নের সমৃদ্ধির গল্প বিশ্ব মিডিয়ায়ও আলোড়ন তুলেছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন-‘অবস্থাটা তুলনা করা যেতে পারে নদীর প্রথম বর্ষার হিংস্র উচ্ছ্রিত জলস্রোতের সঙ্গে। ...প্রথম বর্ষার পানির ঢল দস্যুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এটাই নদীর চিরকালীন রূপ নয়। এক সহজ পরিণতির ভেতর থেকেই আমরা ভাদ্রের পরিপূর্ণ নিটোল নদীটাকে প্রাকৃতিক নিয়মেই একসময় পেয়ে যাই।’
আমরা এখন পায়রা নদীতে। বর্ষার পর আসে শরৎ। লক্ষ করি, পায়রা নদীতে ছোট ছোট জাহাজ, ট্রলার, ইঞ্জিন বোট, ডিঙি নৌকা চলছে। কত বিচিত্র জলযান একই নদীতে। নদীর পাশে লেবুখালীর বিশাল কাশবন। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কী শান্ত-সুন্দর এক নদী।
আগামী দিনে বাংলাদেশ লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, হত্যা, ব্যক্তিস্বার্থ, অতিক্রম করে শুদ্ধ হয়ে যেন শরতের নদীর মতো হয়। সব পথ, মত, জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও সব ধর্মের চলমান স্রোত...। বাংলাদেশের মানুষ হবে শরতের সাদা মেঘের মতো সাদা মনের মানুষ। উদার বিশাল বিনম্র, ভদ্র। কাশফুলের মতো শুভ্র হৃদয়বান।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রার্থিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এছাড়াও আমাদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, রোহিঙ্গা সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা, নিরাপত্তা ঝুঁকি...। আছে নাশকতার ঝুঁকি, নৈরাজ্য, অস্থিরতা, মব জাস্টিস, কিছু উগ্রপন্থির চোখ রাঙানি, ফ্যাসিবাদের ছায়া, প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যমূলক কর্মকাণ্ড-হুমকি ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র...। এ যেন অশান্ত আগুনমুখা নদীতে নৌকার মাঝিদের কঠিন চ্যালেঞ্জ।
জনগণ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। খুব ঠান্ডামাথায় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সংঘাত বন্ধ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন : জাতীয় ঐক্য, প্রতিহিংসার পরিবর্তে উদারতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন, মাল্টিকালচারালিজম, ধর্মের প্রতি সম্মান, আইনের শাসন, নৈতিক সমাজ, গণতান্ত্রিক চর্চা, রিকনসিলিয়েশন ও প্রজ্ঞাপূর্ণ গতিশীল নেতৃত্ব...। আগামী দিনের বাংলাদেশ হোক শরতের নদীর মতো বিশাল; কিন্তু শান্ত, পরিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুন্দর।


মোহাম্মদ বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক
bayezidsarwar792@gmail.com