হাইকোর্টের অতি সাম্প্রতিক একটি রায়ের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফেরার পথ সুগম হলো বলে মনে করা হচ্ছে। ব্যবস্থাটি যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়, সেই সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে একটি রিভিউ পিটিশন আছে শুনানির অপেক্ষায়। সেটি নিষ্পত্তির ভেতর দিয়ে এ ক্ষেত্রে অচিরেই চূড়ান্ত অগ্রগতি হবে বলে আশা। তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে এলেও আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে– এটাও প্রায় নিশ্চিত। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। এর আগে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’-এর এজেন্ডাও তার রয়েছে।
সংস্কার ভাবনায় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে স্বভাবতই। এ সংক্রান্ত কমিশন অচিরেই রিপোর্ট দেবে বলে আশা। প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ ভাষণেও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমকে তুলে ধরা হয়েছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। হালে এমনও তিনি বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার আর না চাইলে তারা কেবল নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচনে চলে যাবেন। এর সম্ভাব্য সময়সীমাও ঘোষিত হয়েছে, যাতে নির্বাচনপ্রত্যাশী দলগুলো কমবেশি আশ্বস্ত। রাজনৈতিক দলগুলো একমত থাকলে সরকার অবশ্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিছু জরুরি সংস্কার করে যেতে পারে, যা সুশাসন ও গণতন্ত্রকে জোরদার করবে। তাতে ক্ষমতায়িত হবে জনগণ।
জনগণ ক্ষমতায়িত হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হলো তার ভোটাধিকার সুনিশ্চিত হওয়া। জনগণের ইচ্ছাতেই যেন সরকার গঠিত হতে পারে। এটিই যথেষ্ট নয়; তবে গণতন্ত্রে ভোটাধিকার এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। সে কারণেই বোধ হয় এটি পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেওয়া হয় বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। অথচ ব্যবস্থাটি সুফল দিচ্ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিশ্চিত হচ্ছিল দেশ-বিদেশে প্রশংসিত মানসম্মত নির্বাচন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হাতবদলও হচ্ছিল। ব্যবস্থাটি ‘চিরস্থায়ী’ করার পক্ষেও জনমত হচ্ছিল প্রবল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অপব্যবহার অবশ্য শুরু হয় খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে। সে প্রেক্ষাপটেই আসে ওয়ান ইলেভেন সরকার। তারা নির্বাচন সম্পন্ন করেন অস্বাভাবিক বিলম্বে। এতে সংবিধান সংশোধনের মতো আসনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতকে ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল তখনই। অভিযোগটি এখন প্রতিষ্ঠিত, বলা যায়। আর সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রচর্চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অপরিহার্য বলেই ধরে নিয়েছে সবাই। আমাদের নিকট অভিজ্ঞতায় রয়েছে তিন-তিনটি ভুয়া নির্বাচনের দগদগে ক্ষত। এর ভেতর দিয়ে একটা নজিরবিহীন কর্তৃত্ববাদী শাসনও চেপে বসেছিল, যেটি হালে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই উৎখাত হয়েছে। এমন শাসনের পুনরুত্থান রোধে যা যা করা প্রয়োজন, তার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে এখন। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফেরার দাবিটি সম্ভবত সবচেয়ে জোরালো। এ মুহূর্তে মাঠে থাকা সর্ববৃহৎ দল বিএনপি এক বছরেরও বেশি সময় আগে দেওয়া ৩১ দফায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনকে তার অন্যতম অঙ্গীকার হিসেবেই সামনে এনেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতা এখন আর কেউ করছে বলে মনে হয় না। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় সব দলই আসলে কখনও না কখনও, কোনো না কোনো মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরলে তারাও কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবে না। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের অনুসরণে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সদিচ্ছা কিন্তু তারা দেখাতে পারত। যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নিতে আসায় সেটি কিছুটা হলেও করে দেখানোর সুযোগ এসেছিল হাসিনা সরকারের সামনে। বাস্তবে সেবার ভোট করে ফেলা হয় আগের রাতেই। ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল গণপ্রতারণার আরেক নমুনা। এ অবস্থায় কোনো না কোনো ইস্যুতে বিক্ষুব্ধ জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন ছিল বলতে গেলে অনিবার্য।
সেটি ঘটে যাওয়ার পর সম্ভাব্য সংস্কার ও নির্বাচন ঘিরে অনেক কিছুই ঘটে চলেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পথ চলা মোটেও সহজ হচ্ছে না। ক্ষমতাচ্যুতদের পাশাপাশি একটি আঞ্চলিক শক্তির বিরূপ আচরণও সামলাতে হচ্ছে। আছে জনপ্রত্যাশার চাপ। ক্ষমতাচ্যুতদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজনীতিতে তাদের নিরপরাধ অংশের ‘অন্তর্ভুক্তির’ উপায় নিয়েও চলছে বিতর্ক। এদিকে হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া নাজুক অর্থনীতি সামাল দেওয়া সহজ নয়। এ অবস্থায় ‘অল্প কিছু’ সংস্কার একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হলেও হতে পারে; তবে নির্বাচন সুষ্ঠু করার কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক বিশ্বেও এটা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানোর মতো নির্বাচন না হলে কিন্তু অর্থনীতিতেও গতি আনা যাবে না।
ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোও যাতে সুষ্ঠু হতে পারে এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর হয় নিশ্চিত, সে ব্যবস্থা করে যেতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। হাসিনা সরকার নিয়োজিত সর্বশেষ সিইসি মত দিয়ে গেছেন– নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা প্রয়োজন। নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনাররাও ভিন্ন কিছু বলবেন বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবেই কাজ করবে।
কিন্তু এর পর কী হবে? আগামী নির্বাচনে যারা ক্ষমতাসীন হবেন, তাদের দায়িত্বও এ ক্ষেত্রে কোনো অংশে কম নয়। আদালতে নিষ্পত্তির পরও বোধ হয় এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে জাতীয় সংসদকে। অন্তত এ প্রশ্নে ঐকমত্য থাকতেই হবে রাজনৈতিক দলগুলোয়। আদর্শগত অবস্থান যা-ই হোক, সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধানে কারও বিরুদ্ধ অবস্থান কাম্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কী করে যেতে পারে, সেটাও তাদেরকেই বলতে হবে একমত হয়ে। এর মর্যাদাও রাখতে হবে তাদের।
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের যে বন্দোবস্ত সাংবিধানিকভাবেই করা হয়েছিল, তার অনুশীলন হতে থাকলে রাষ্ট্রীয় জীবনে আমাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় ভিন্ন হতো। অন্তত কোনো দানবীয় শাসনের অধীনে এসে বিপদগ্রস্ত হতে হতো না। অনিশ্চয়তায় ভরা পরিস্থিতিতেও পড়তাম না আমরা। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে অধিকতর সংকটের দিকে চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কিন্তু রয়েছে। আমরা নিশ্চিতভাবেই চাই না, এখানে তেমন কিছু ঘটুক। সে জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য অটুট রেখে সংস্কার ও নির্বাচনের দিকে যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। আদর্শ একটি নির্বাচন দিতেই হবে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে। পরবর্তী নির্বাচনগুলোর জন্যও যেন এটা হয়ে থাকে মানদণ্ড।
স্থানীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ফলপ্রসূ করার সুপারিশ দেখতেও আমরা আগ্রহভরে অপেক্ষা করব। এরশাদ শাসনামলেও (জাতীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে রেখে) স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় জনইচ্ছার এক ধরনের প্রতিফলন ঘটতে দেওয়া হতো। এদিকে হাসিনা সরকার আমলে আমরা দেখেছি পেশাজীবীদের নির্বাচনেও সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হতে। নির্বাচন ব্যবস্থার সামগ্রিক ধ্বংসযজ্ঞই দেখতে হয়েছে তখন। আর এটা খুলে দিয়েছিল সর্বনাশের সব ক’টা দরজা। এখন এ জায়গাটুকুর সংস্কারেও যদি আমরা সমর্থ হই; সেটা বিবেচিত হবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বলে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট
সূত্র: সমকাল