নির্বাচনী পথনকশা ও বিবিধ রাজনৈতিক বয়ান

মাহবুব আজীজ
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:০৭

বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে বলেছেন: ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।’
এই নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম; আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। খেয়াল-খুশির এই তিন নির্বাচন শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদই দৃঢ় করে; হাস্যকর করে তোলে নির্বাচনী ব্যবস্থা। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শত শত মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে কর্তৃত্ববাদ নাকচ করে দেয়; একই সঙ্গে ভোটাধিকারের ন্যায্য অধিকারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে। নির্বাচনী পথনকশা তাই সকলের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তাই, আরও সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী পথনকশা দাবি করে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন চায়। তারা মনে করে, নির্বাচনের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন নেই। 
অন্যদিকে সংস্কার নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে বেশ। প্রথম পর্যায়ে সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, পুলিশ সংস্কার, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কার নিয়ে ৬টি কমিশন গঠন করে। চলতি মাসের শেষ বা জানুয়ারির প্রথম দিকে কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। সংস্কার প্রস্তাব জমার আগেই পুরোনো আইনে গঠন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্কার প্রস্তাব আসবার আগেই পুরোনো কায়দায় কমিশন গঠন কোন ধরনের বার্তা, এটা নিয়ে তর্ক না করলেও চলে। জনপ্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগ ও রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের আদি প্রক্রিয়াও অব্যাহত। এসব ঘটনা সংস্কারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 
ড. ইউনূস সর্বশেষ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি স্বয়ং এই কমিশনের প্রধান। জাতীয় ঐকমত্য তৈরির ক্ষেত্রে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেই প্রধানত আলোচনা করবে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বয়ান বা বারতাগুলোর দিকে দ্রুত তাকানোর চেষ্টা করি।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে বড় দল। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনাও সবচেয়ে বেশি। ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির দেশব্যাপী নেতাকর্মীর অনেকেই চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়েছেন। বিএনপি হাইকমান্ড শক্ত হাতে এগুলো দমনের চেষ্টা করছেন। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩১ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করবার পাশাপাশি একই সংখ্যক কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সংযতভাবে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতৃবৃন্দ ইতিবাচক ও প্রগতিশীল মতামত দিচ্ছেন। প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গটিও তারা আদালত ও জাতির বিবেচনায় ন্যস্ত করেছেন।
গণঅভ্যুত্থানে দেশের মানুষের বুকে গুলি ছোড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ কি রাজনীতি অব্যাহত রাখতে পারবে? নাকি দলটির অপরাধী নেতৃবৃন্দকে শাস্তির আওতায় আনার পর নতুন নেতৃত্বে রাজনীতি অব্যাহত রাখতে পারবে? সে ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের অপরাধের ক্ষমা চাইতে হবে নতুন নেতৃত্বকে– এমন মতামতও রয়েছে। আবার গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃবৃন্দের একটি অংশের জোরালো মত– আওয়ামী লীগের কেউই আর কখনোই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পুরো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে অবশ্য ছাত্রনেতৃবৃন্দের এই কঠোর অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যায় জামায়াত অপরাধী– মীমাংসিত এই সত্য নিয়ে যখন কোনো উচ্চারণ নেই, তখনই সংশয় জাগে– আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলে নির্বাচনে জয় অনেকের জন্য সহজ হবে বলেই কি নিষিদ্ধ করবার তৎপরতা? এই অঙ্ক যদি সত্যি হয়, তবে তা প্রত্যেক শহীদ– তা একাত্তর ও চব্বিশ– উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। অপরাধ অবশ্যই অপরাধ; বিচার প্রত্যেকেরই হওয়া উচিত। এবং বিচারের নামে যে কোনো মতাদর্শকে চিরতরে দমিয়ে বা বাদ দেওয়ার চেষ্টাও অপরাধ বটে; সেটি আওয়ামী লীগ বা জামায়াতে ইসলামী যে কোনো দলের ক্ষেত্রেই সংগত।


গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে জড়ো করে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ৮ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই কমিটি তারুণ্যনির্ভর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে কাজ করছে। রাজনৈতিক দল গঠন ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও দলটিতে অংশগ্রহণকারী ছাত্রনেতৃত্বের গণঅভ্যুত্থানে অবদান নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ছাত্রনেতৃত্বের বক্তব্যে প্রায়শ রাজনৈতিক বয়ান ও ইতিহাস বিশ্লেষণও পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের অন্তত দুই উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা নন। জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, আগের দেড় দশকের অপশাসন ছাড়াও ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা, সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতাসহ আরও বেশ কিছু কারণে দলটির বিরুদ্ধে নিয়মিত আপত্তি জানিয়ে আসছেন ছাত্রনেতারা। সম্প্রতি বিএনপির বিরুদ্ধেও সরব হচ্ছেন নাগরিক কমিটির নেতৃত্ব। আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘বিএনপি অবশ্যই বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি।’ তিনি আরও বলেছেন, “তরুণ প্রজন্মের অভ্যুত্থানের শক্তিকে ডাইভার্ট করে পুরোনো একই ব্যবস্থা বাংলাদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যখন চলছে, তখন তারা বলছে– ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছি, তাহলে আপনারা কারা নতুন করে কথা বলার?’” (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪)।
নতুন করে কথা বলবার চেষ্টা এই প্রথম নয়। প্রতি সন্ধিক্ষণে নতুন কথার বিজয় দিয়েই ইতিহাস রচিত হয়েছে। পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধ। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেরও সূচনা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে। সেখানে ক্ষমতার অহমিকা দেখিয়ে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রশক্তি সব আন্দোলনকারীকে ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত করবার পরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারুণ্য। মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী অহংকারে আঘাত লেগেছিল বলেই তারুণ্য ক্রুদ্ধ উচ্চারণে শেখ হাসিনার আসন টলিয়ে দিয়েছিল। প্রমাণ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের একক সম্পত্তি নয়।
আজ যখন মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামীকরণ করে বয়ান দিচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষরাই; এতে কারা শক্তিশালী হচ্ছে? যার যা প্রাপ্য তাকে দিলে অন্য কেউ ছোট হয় না। এটা শেখ হাসিনা বোঝেননি বলে সবকিছু দলীয় বা পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। তার ফল তাঁকে ভোগ করতে হচ্ছে; আগামীতে কেউ নিজের মতো ইতিহাস লিখতে চাইলে পরিণতি সেই একই হবে! ইতিহাসের সেই পুরোনো শিক্ষা– ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বয়ান তৈরির অনেক ক্ষেত্র আছে। এ জন্য ইতিহাস নিজেদের পছন্দে পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলত্রুটি অবশ্যই আলোচিত হবে। কিন্তু ‘৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কী করেছে’ জাতীয় সরল উক্তি সমস্যা জটিল করে তুলবে। দেশ গঠন থেকে সবই রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে– এই সত্য মেনে ভুলত্রুটি শুধরে বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরির পথে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি। 
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
সূত্র: সমকাল