আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে আশা-নিরাশার যে দোলাচল; রাস্তাঘাট ও চায়ের দোকানের আড্ডায় গেলেই তা বোঝা যায়। মানুষের একটাই প্রশ্ন– অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক হবে তো?
আম জনতা বেশির ভাগ গোপন ব্যালটের মাহাত্ম্য প্রায় ভুলেই গেছে! ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানুষের বিরাট অংশ এখনও ভোট প্রদানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেনি। নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরে আসবে; মানুষ নিঃশঙ্ক চিত্তে পছন্দসই প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে– ভোটের সময় দেশব্যাপী এমন পরিবেশ এখন সময়ের দাবি। আগামী নির্বাচনের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
দুই.
এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই আশা করা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে ব্যবস্থাকে এর আগে বাতিল করা হয়েছিল। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকেও এ-সংক্রান্ত একটি রায় ঘোষিত হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববর্তী সরকার সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। বাতিলের কারণ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রলম্বিত হওয়ার বিষয়ও আলোচনায় উঠে এসেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আগের নিয়মে সরকারপ্রধান হতেন সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি। সে ক্ষেত্রে দেশের মানুষের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের নাম আগেই স্পষ্ট হয়ে থাকত। আগামীতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন– এখনও স্পষ্ট নয়। কেননা, নির্বাচন ঠিক কবে অনুষ্ঠিত হবে, সেই রোডম্যাপ এখনও প্রকাশিত হয়নি।
তিন.
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার বিষয়ে দেশের মানুষের বড় অংশের সংশয়ের মূল কারণ হলো, তিক্ত অভিজ্ঞতা। বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার অব্যক্ত দুঃখবোধ। ভোটে পেশিশক্তির ব্যবহার, কালো টাকার দাপট, হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমার ভয়ভীতি কমবেশি সব আমলেই ছিল; শুধু গত তিনটি নির্বাচনে নয়। কিন্তু ২০১৪, ১৮ ও ২৪ সালের নির্বাচনে আগের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর রেকর্ড ভেঙে গিয়েছিল।
নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের সংশয়ের পাশাপাশি হতাশার আরেক কারণ হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকের বেপরোয়া গতিবিধি, অশালীন আচরণ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ, মিথ্যা মামলার মাধ্যমে নীরব চাঁদাবাজি। ফলে তৃণমূলের মানুষ সত্যিই শঙ্কিত বোধ করছে। ভাবছে, এরাই হয়তো একটা নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অবাধ, সুশৃঙ্খল নির্বাচনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই সময় থাকতেই এদের এমন অপ্রতিরোধ্য গতিকে প্রতিহত করা জরুরি। অন্যথায় দেশ-বিদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ কর্মকাণ্ডও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সমূহ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
চার.
বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নতুন আরেক অপরাধের কথা শোনা গেছে এবং তা বাস্তবে অনেক স্থানে ঘটেছেও। তা হলো, কালো টাকার মালিক এমন প্রার্থী কর্তৃক তাঁর নির্বাচনী এলাকার বড় বড় ভোটকেন্দ্রে মোতায়েনকৃত সব জনবলকে অর্থের বিনিময়ে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। এতে প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে আনসার সদস্য পর্যন্ত সবাই আকার-ইঙ্গিতে, সরাসরি বা প্রচ্ছন্নভাবে তাঁর পক্ষে কাজ করে যাবেন। তারা সেই প্রার্থীর সমর্থনে জাল ভোট দিতে সহায়তা করবেন। কেউ কেউ একাধিকবার কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও এর কোনো প্রতিবাদ করবেন না; প্রতিপক্ষের অভিযোগ আমলে নেবেন না; লোক দেখানো তৎপরতা প্রদর্শন করবেন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে তারা আগেই উপজেলা কার্যালয় থেকে পছন্দমতো প্রিসাইডিং অফিসার তাদের চিহ্নিত কেন্দ্রে পদায়ন করিয়ে নেন। এর সঙ্গে প্রতিপক্ষ জনপ্রিয় প্রার্থীর সম্পর্ক থাকে না। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের বাইরে কোনোরূপ বাধা বা দৃশ্যত প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। ভোটাররা কেন্দ্রের ভেতরে নিরাপদে প্রবেশ করলেও সবাই ভোট দিতে পারবে– এমন নিশ্চয়তা থাকবে না। বাহ্যিক অবস্থা বা পারিপার্শ্বিকতা থেকে বোঝা যাবে, কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে; বাস্তব চিত্র হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পাঁচ.
জাতীয় ও স্থানীয় সরকার, উভয় নির্বাচনেই দুর্বৃত্ত ও ভোট ডাকাতরা নানা অপকর্মের জাল বিস্তার করে থাকে। তারা নতুন নতুন প্রযুক্তিগত কলাকৌশল উদ্ভাবন করে। নির্বাচনে কোনো কোনো প্রার্থী ভাড়াটিয়া গুন্ডা, সন্ত্রাসী ও অবৈধ অস্ত্রধারীকে শহর থেকে আমদানি করে থাকে। তারা রেজিস্ট্রেশনবিহীন হোন্ডা আর মাইক্রোবাস ভর্তি করে তাদের নিয়ে চলাচল করে থাকে। অভিজ্ঞতা বলে, দু’একদিন আগেই তারা কেন্দ্রভিত্তিক বিরাট অঙ্কের টাকা পৌঁছে দিয়ে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর স্থানীয় প্রতিনিধিরা রাতের আঁধারে তা ভোটারের ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর দায়িত্ব নেয়। এই অবৈধ ও অপপন্থা অবলম্বনকারীদের রুখতে না পারলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করা যাবে না। সারাদেশে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা এসব সমাজ বিনষ্টকারী জঞ্জাল সাফ করে তবেই আগামী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সমতাভিত্তিক মাঠ প্রস্তুতের সাহসী অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। শতভাগ নিরাপত্তা দিতে হবে সৎ, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক ও জনপ্রিয় প্রার্থীকে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক সৎ ও যোগ্য মানুষের আস্থার প্রতীক।
হোসেন আবদুল মান্নান: গল্পকার; সাবেক সচিব
সূত্র : সমকাল