“যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যহ ভোরে
মেলবো দু’চোখ, দেখবো নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,
ততদিন আমি পালন করবো শোক”
-শামসুর রাহমান
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানাস্থ বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর-বর্তমানে বিজিবি) সদরদপ্তরে বিদ্রোহী, বিপথগামী ও উচ্ছৃঙ্খল বিডিআর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সেনা-অফিসার হত্যাকান্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কালিমালিপ্ত ও কলঙ্কিত এক অধ্যায়। নৃশংসতম ও নারকীয় এই পিলখানা হত্যাযজ্ঞ এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ড অপ্রত্যাশিত সুনামির মতো সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের মনোবলকে আঘাত করেছে। এ ঘটনা সংগ্রামী বাঙালি জাতি ও ক্রমঅগ্রসরমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গর্ব ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় নির্মমতম গণহত্যা দেখে একজন বিদেশি মিশনারি বলেছিলেন- ‘নরকে এখন শয়তান নেই। সব শয়তান এখন রুয়ান্ডায়।’ একই দেশের, একই বাহিনীর, নিজ জাতি ও নিজ ধর্মের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত পিলখানার পৈশাচিক উন্মাদনা দেখে তিনি কী বলতেন?
একালের এডোনিসদের তাজা মুখগুলো
পিলখানা বধ্যভূমিতে আমরা হারিয়েছি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন সূর্য সন্তানকে। এই নিষ্ঠুরতম ঘটনা কবুল করতে বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। এঁদের অনেকে ছিলেন আমার মহাপরিচালক, অধিনায়ক, ইউনিট সহকর্মী, ক্যাডেট কলেজের বন্ধু, কৈশোরের খেলার সাথী, কোর্সমেট, ছাত্র অথবা সহকর্মী। এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সংবাদে মনের আঙিনায় বার বার ভেসে উঠেছে গ্রীক পুরানের সুদর্শন এডোনিসের মত তরুণ অফিসারদের তাজা মুখগুলো।
বাংলাদেশ রাইফেলসে সেনাকর্মকর্তাদের অসাধারণ যে অবদান
২১৩ বছরের গর্বের ঐতিহ্য নিয়ে বিডিআর একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত ও কার্যকর সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। বিশেষত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে নিয়োজিত মূলত বাঙালি সেনা অফিসারদের গতিশীল নেতৃত্বে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী এই বাহিনী (ইপিআর) একটি পেশাদার ও কর্তব্যনিষ্ঠ সংগঠন হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ষাটের দশকে এই বাহিনী আসালং মৌজা, লক্ষীপুর, জকিগঞ্জ, মোগলহাট, উখিয়াসহ অসংখ্য সীমান্ত সংঘর্ষ ও যুদ্ধে শক্তিশালী ভারতীয় ও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বাহিনীর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (পরে মেজর ও বীর উত্তম) নেতৃত্বে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ইপিআর সদস্যগণ চট্টগ্রাম শহরের রেলওয়ে পাহাড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য রণকৌশলগত সদর দপ্তর ও ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইপিআরের সাহসী ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।
গত কয়েক যুগে সেনা অফিসারদের আত্মত্যাগ, নিবেদিতপ্রাণ মনোভাব,কঠোর পরিশ্রম ও তেজোদ্দীপ্ত নেতৃত্বের ফলেই বিডিআর একটি কার্যকর ও দক্ষ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর এই বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধসহ আন্দার মানিক, রেজুপাড়া, পাদুয়া, বড়াইবাড়ি, হিলি, টেকনাফ, জকিগঞ্জ, বেরুবাড়ীসহ অসংখ্য সীমান্ত সংঘর্ষে মাতৃভূমির পবিত্র সীমান্ত রক্ষা করে।
কি অপূর্ব প্রতিদান!
গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সব সীমান্ত সংঘর্ষ এবং যুদ্ধগুলো পরিচালনার দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিডিআর-এ প্রেষণে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যয়ী অফিসারবৃন্দ। তাঁরা দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধের মাঠে ঝলসে উঠেছিলেন যুদ্ধ-দেবতার মতো। সেইসব বীরদের লাশ আমরা পেলাম পিলখানার বধ্যভূমিতে, নর্দমায়, ম্যানহোলে। কি অপূর্ব প্রতিদান! অধিনায়ক হিসেবে নিজ সৈনিকদের প্রশিক্ষণ, কল্যাণ, দেখভাল ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য এই সব সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন সদা নিবেদিতপ্রাণ। শহীদ অফিসারগণ যখন দেখলেন তাদের নিজেদের সৈনিকরাই তাঁদের আক্রমণ করছে,তখন হয়তো গুলির আঘাতের চেয়েও অকৃতজ্ঞতার সেই ভয়ংকর আঘাত আরো গভীর হয়ে উঠেছিল। পিলখানার সেই সব নরপিশাচদের বর্বরতা দেখে এমনকি লজ্জা পেয়ে যায় অকৃতজ্ঞ ও ষড়যন্ত্রকারী ব্রুটাসদের প্রেতাত্মা।
২য় ইস্ট বেঙ্গলের শহীদ সহকর্মী
ভয়াল পিলখানা মৃত্যু-উপত্যকায় আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যবাহী ও আমার স্মৃতিময় ইউনিট ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫ জন অফিসারকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানিকছড়ি ও লক্ষীছড়ি এলাকায় এই ইউনিট মোতায়েন থাকাকালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আবদুল বারী আমার অধিনায়ক ছিলেন। সৎ ও কর্তব্যপরায়ন এই অফিসার ছিলেন প্রকৃত সৈনিকের এক প্রতিকৃতি। কাজই ছিল তাঁর আরাধনা। তারই পরিপক্ক পরিচালনায় বৈরী পরিস্থিতিতে মানিকছড়ি উপজেলায় নেপচুন চা বাগানের পাশে হালদা নদীর তীরে অবস্থিত ‘সিমুতাং গ্যাসফিল্ডে’ সিসমিক সার্ভে ও ড্রিলিং এর জন্য আসা বিদেশিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আমরা কাজ করেছিলাম।
এই ইউনিটে পরবর্তীতে আমার প্রিয় ও অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অধিনায়ক ছিলেন কর্ণেল মোঃ নকিবুর রহমান। সদা হাস্যময় এক মানুষ। তার হৃদয় ছিল এক উদার নীলাকাশ। কর্ণেল নকিবের অধিনায়ত্বের সময় তার ব্যক্তিত্বের মাধুর্য, অনুপ্রেরণা ও গতিশীল নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গলের সদস্যদের মনোবল আশ্চর্য রকম উচ্চমাত্রা লাভ করেছিল। এমন অধিনায়ককে গুলি করতে হাত কাঁপলো না ঘাতকদের? ভদ্র, বিনয়ী ও নীরব কর্মী মেজর মোঃ মকবুল হোসেন ছিলেন সিলেট সেনানিবাসে আমার উপ-অধিনায়ক। মেজর এসএম মামুনুর রহমান ছিলেন আমাদের রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার। তাঁর হাতের যাদুতে যেন দ্রুত সেরে উঠতো পাহাড়ের ম্যালেরিয়া রোগী। লক্ষীছড়ি ও মানিকছড়ির সবুজ পাহাড়ের সহজ সরল মানুষরা কি জানে যে তাদের ‘প্রিয় ডাক্তার’ এখন ঘুমিয়ে আছে মৃত্যুর দেশে?
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সেই ৪ জন প্রাক্তন ক্যাডেট
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের চারজন প্রাক্তন ক্যাডেটকে আমরা হারিয়েছি। প্রফেশনাল ও জ্ঞান-অন্বেষী কর্ণেল মোহাম্মদ আখতার হোসেন ছিলেন আমার (চট্টগ্রামের) সেক্টর কমান্ডার। কলেজে আমাদের প্রিয় বকুল ভাই। দীর্ঘদেহী, দক্ষ আর্টিলারি অফিসার মেজর হুমায়ুন হায়দার ছিলেন আমার শিক্ষক ও শিল্পী সুজা হায়দার স্যারের প্রাণপ্রিয় পুত্র। শহীদ মেজর মাকসুম-উল-হাকিম ছিলেন এই কলেজেরই আর এক কৃতি ছাত্র। ১৪ তম ব্যাচের কর্ণেল মোঃ আফতাবুল ইসলাম (বুলবুল), মেজর আহমেদ আজিজুল হাকিম (পলাশ) ও আমি ১৯৭৭ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে সপ্তম শ্রেণীতে এই কলেজে যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের ক্লাসের ‘ফাস্ট বয়’ আফতাব সেনাবাহিনীতেও তার মান রেখেছিলেন। আমাদের কোর্সে ‘কর্ণেল’ পদে প্রথম পদোন্নতি লাভ করেছিলেন আফতাব। আজিজ যেমন ছিলেন ক্রিকেট মাঠের দূর্দান্ত বোলার, তেমনি কলেজের শ্রেষ্ঠ তবলা বাদকও। ভবিষ্যতে কোন এক পুনর্মিলনীতে পদ্মা তীরের সেই স্মৃতিময় কলেজে হয়তো সব বন্ধুরা একত্রিত হবে। সেখানে শুধু থাকবে না পাখি আর ফুলের নামের আমাদের ছেলেবেলার প্রাণপ্রিয় দুই বন্ধু।
রাঙামাটির রউফ টিলায় একটি গ্রুপ ছবি
মনে পড়ে সুরভিত নীলিমায় ফেলে আসা দিনগুলোর শব্দমালা। মেধা, কৃতিত্ব ও মননের আশ্চর্য সমন্বয়ে কর্ণেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিক ছিলেন আমাদের প্রজন্মের এক শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। রাঙ্গামাটির অদূরে মোহময় কাপ্তাই হ্রদের বুকে ভেসে থাকা রউফ টিলায় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ-এর স্মৃতিসৌধে তোলা আমাদের গ্রুপ ছবি এখন শুধুই যেন স্মৃতি। এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কর্ণেল মোঃ এমদাদুল ইসলাম ছিলেন মিলিটারি একাডেমির তুখোড় অস্ত্র প্রশিক্ষক। দ্রোনাচার্যের মতই তিনি ক্যাডেটদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন।
কম্বোডিয়ায় কয়েকজন শান্তিরক্ষী
কম্বোডিয়ায় লেঃ কর্ণেল মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমরা সুপ্রাচীন অ্যাংকর ওয়াট মন্দিরের অদূরে পুমবক পাহাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধরত দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ-বিরতি কার্যকর করেছিলাম। কম্বোডিয়ায় প্রাচীন এ্যাংকর থম নগরীতে এক কোজাগরী পূর্নিমায় অরণ্য ভেদ করে মায়াবী মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এক বিশাল মন্দির। আমি ও কর্ণেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ শুভ্র আলোকিত নীরব নগরীর সেই প্রাচীন মন্দির নির্মাণে আমাদের পূর্ব পুরুষদের হাতের ছোঁয়া আছে জেনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। র্যাবে কিংবদন্তিময় কৃতিত্বের অধিকারী কর্নেল গুলজার একদিন কম্বোডিয়ায় কুখ্যাত ‘টুয়েল স্ল্যাং’ টর্চার চেম্বারে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখে আমাকে বলেছিলেন ‘‘খেমাররুজরা কি মানুষ’’? পিলখানায় ঘৃণিত অপরাধীদের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কর্নেল গুলজার হয়তো ভেবেছিলেন বাংলার মাটিতে কেন আজ খেমাররুজদের মত প্রশিক্ষিত খুনিদের প্রত্যাবর্তন? নমপেনে মেকং নদীর তীরে বসে কত সন্ধ্যায় মেজর মাহমুদ হাসান ও আমি প্রিয় বাংলাদেশের কথা ভেবেছি।
একজন অশ্বারোহী রোমান বীর
মনে পড়ছে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) সহকর্মী চৌকস অফিসার কর্ণেল মোঃ আনিস উজ জামান এর কথা। অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে যখন তিনি ঘোড়ায় চড়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে আসতেন, মনে হতো তিনি যেন প্রাচীন যুগের অশ্বারোহী সুদর্শন রোমান বীর যোদ্ধা। মেজর মোঃ রফিকুল ইসলাম ছিলেন সেনাবাহিনীর জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল বিভাগের প্রতিশ্রুতিশীল অফিসার। ক্যাডেট রফিক যখন বিএমএতে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলেন, তখন তাকে কিছুদিন প্রশিক্ষণ দেয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমরা হারিয়েছি কর্ণেল কাজী এমদাদুল হক ও মেজর মোঃ আব্দুস সালাম খানকে। তারা ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ কমান্ডোদের অন্যতম। আকাশ থেকে তাদের প্যারাসুট জ্যাম্প দেখে পাখিরাও ঈর্ষা করতো।
টেকনাফের সেইসব কর্মবীর
টেকনাফ এলাকায় বিডিআরে স্বল্পকাল কর্মরত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি কী গভীর দায়িত্ব বোধ, কর্মস্পৃহা ও দেশপ্রেম নিয়ে টেকনাফ অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন কর্ণেল শওকত ইমাম, কর্ণেল আবু মুছা মোহাম্মদ আইউব কাইসার ও মেজর মোঃ আজহারুল ইসলাম। হোয়াইকং বিওপি থেকে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের শাহপুরী দ্বীপ বিওপি পর্যন্ত বাংলাদেশ-মিয়ানমারের স্পর্শকাতর এলাকা তাঁরা নিরাপদ ও চোরাচালানমুক্ত রেখেছিলেন।
মনে পড়ে কঠোর পরিশ্রমী মেজর মোঃ মিজানুর রহমান এর কথা। আমি ও তৎকালীন লেফটেন্যান্ট মিজান একদিন রাঙ্গামাটির ঘাগড়া ক্যাম্প থেকে শান্তি বাহিনীর একটি দলের খোঁজে দুর্গম কালা পাহাড়ে পথ হারিয়ে ছিলাম। মেজর হোসেন সোহেল শাহনেওয়াজ ছিলেন সপ্রতিভ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও প্রাণখোলা একজন পদাতিক অফিসার। ২৪ পদাতিক ডিভিশন সদরদপ্তরে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী কর্ণেল সামসুল আরেফিন আহাম্মেদ অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে প্রশিক্ষণ ও আভিযানিক কাজগুলো সম্পন্ন করতেন। অত্যন্ত সামাজিক ও কর্তব্য-পরায়ন অফিসার মেজর মুস্তাক মাহমুদ ছিলেন সাভার সেনানিবাসে আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
বিদেশ থেকে টেলিভিশনে সারি সারি লাশ দেখে ভাবি, এই ভয়াল মৃত্যু উপত্যকা তো আমার দেশ হতে পারে না। কেন আমরা বার বার শুনি মধ্যযুগের সেই সব ভয়ঙ্কর প্রেতকণ্ঠ? ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৮১, ২০০৯-এ কেন এই দেশেরই নির্মম ঘাতকরা চুরমার করে আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষদের বুক? এ দেশ কি তবে গ্রীক ট্র্যাজেডি পুনরাবৃত্তির অসহায় রক্তাক্ত রঙ্গমঞ্চ?
অদ্ভুত যে সীমান্ত-জীবন
লোমহর্ষক সেই রক্তাক্ত পিলখানা হত্যাকান্ডের প্রাথমিক পর্যায়ে পিলখানার খুনি দুবৃর্ত্তরা বিডিআরে নিয়োজিত সেনা অফিসারদের তথাকথিত সুযোগ-সুবিধা ও অনিয়মের কথা বলেছে। অথচ প্রকৃত ঘটনা এর বিপরীত। সেনাবাহিনী থেকে আসা অফিসারদের বরং সেনাবাহিনীত বিদ্যমান তুলনামূলক উন্নত মানের বাসস্থান, চিকিৎসা ব্যবস্থা, রেশন, যানবাহন, স্কুল সুবিধাদি ও মর্যাদাপূর্ন কাজের পরিবেশ ছেড়ে দূরবর্তী অপরিচিত পরিবেশ (অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ছাড়া) দায়িত্ব পালন করতে হয়।
একটি বিডিআর ব্যাটালিয়নে অধিনায়কসহ মাত্র ২/৩ জন অফিসারকে একদিকে বৈপরিত্যময় ও অবান্ধব পরিবেশ ঝুকিপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় শক্তিশালী চোরাচালান সিন্ডিকেট, নারী পাচারকারী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, ড্রাগ ব্যবসায়ী এবং তথাকথিক গড ফাদারদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়; অন্যদিকে প্রতিপক্ষ সীমান্ত রক্ষীদের রক্তচক্ষুর বিপরীতে মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চিতে সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। প্রকৃতপক্ষে বিডিআর-এর চাকুরি সেনা কর্মকর্তাদের জন্য মোটেই সুখকর, আকর্ষণীয় কিংবা আরামদায়ক নয়। তবুও রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব ভেবে ঝুঁকি নিয়ে সেনা অফিসারগণ বিডিআর সদস্যদের পেশাদায়িত্ব, নিয়মশৃঙ্খলা, সততা ও দায়বদ্ধতার বন্ধনে আনার চেষ্টা করেছেন প্রতিক্ষণ। এই সব সেনা কর্মকর্তারা শত প্রলোভনেও শুধু নিজেকে সৎ রাখেননি, অধীনস্থদের অসৎ উপার্জন দমনেও সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই কি তাদের অপরাধ?
পিলখানার এই শহিদগণ হলেন সেই সব সৈনিক, যারা বাংলার লাল সবুজ পতাকা তুলে ধরেছিলেন পৃথিবীর দিকবিদিক। তবে যুদ্ধজয়ের নেশায় নয়, শান্তির ললিত বাণী নিয়ে শান্তিরক্ষী সৈনিক হয়ে যুদ্ধ কবলিত দেশের মানবের পাশে। পূর্বে তিমুর থেকে পশ্চিমে হাইতে, উত্তরে জর্জিয়া থেকে দক্ষিণে নামিবিয়া পর্যন্ত সব দিগন্তে পারিজাত প্রিয় মাতৃভূমির পতাকা তুলে ধরেছিলেন তাঁরা সগৌরবে।
তাদের ছিল ভালোবাসাময় সোনার সংসার
পিলখানায় শহীদ এই সুপ্রশিক্ষিত, চৌকস, মেধাবী ও পেশাদার সেনা অফিসারগণ দেশের জন্য ঝুঁকি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ করেছেন, সীমান্ত রক্ষা করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিপদ-আপদ ও বিভিন্ন প্রয়োজনে দেশবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন পরম মমতায়। সব ক্ষেত্রে দেশের প্রতি বিপুল ভালোবাসায় তারা কাজ করেছেন। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও এঁরা ছিলেন কি উজ্জ্বল মানুষ। ভালোবাসা, মায়ামমতা, স্নেহ ও বন্ধুত্বের পবিত্র বন্ধনে তারা আবদ্ধ ছিলেন শত সহস্র মানুষের সঙ্গে। তাদের ছিল প্রীতি-ভালোবাসাময় সোনার সংসার।
১২ তম লং কোর্সের ৪ জন সতীর্থ
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) থেকে প্রশিক্ষণ শেষে (১৯৮৫) আমরা ১২ তম লং কোর্সের ১২৪ জন তরুণ কমিশন লাভ করেছিলাম। পিলখানায় আমরা হারিয়েছি আমাদের কোর্সের চার প্রিয় মুখ: কর্ণেল আফতাব, লেঃ কর্ণেল লুৎফর, মেজর সালেহ ও মেজর আজিজ। কুড়িগ্রামের সন্তান কর্নেল আফতাব চীনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা অধ্যয়নকালে অনন্য মেধায় মুগ্ধ করেছিলেন বিদেশী অধ্যাপকদের। প্রকৌশল ডিগ্রী অর্জনকারী মেজর আজিজ যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। আমরা হারিয়েছি সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকা দীর্ঘদেহী, ভদ্র স্বভাবের দায়িত্ববান অফিসার মেজর মোহাম্মদ সালেহকে।
একজন কর্ণেল লুৎফর রহমান
চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন আমার প্রাণের বন্ধু আর্টিলারি রেজিমেন্টের সুদক্ষ ও কর্তব্যপরায়ন অফিসার লেঃ কর্ণেল মোঃ লুৎফর রহমান। জামালপুরের সন্তান লুৎফর পড়াশোনা করেছিলেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। সৎ বিনয়ী, ধীর- স্থির লুৎফর ছিলেন বৌদ্ধিকভাবে অতি উঁচু মানের। লুৎফরের করুণ মৃত্যুর কথা যখন শুনি, কুয়েতে তখন উৎসবের মাস। সর্বত্র ‘হালা ফেব্রুয়ারি’ এবং ‘স্বাধীনতা ও মুক্তি দিবসের’ আনন্দময় কর্মকান্ড। সমুদ্রঘেঁষা গালফ রোড থেকে কুয়েত সিটির সুউচ্চ লিবারেশন টাওয়ার দেখে মনে হয়েছিল নগরীর লাল বাতিগুলো যেন গায়ে তাঁর রক্ত মেখেছে। ভাবছিলাম, পিলখানার হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা মরুভূমির বিষাক্ত জহুরিলা সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বনানীতে লুৎফরের কবরে এখন প্রশান্ত নীরবতা। সেখানে সারা রাত ধরে আকাশ ফেলে শিশিরাশ্রু। মানুষ নয়, তাঁর বন্ধু এখন শুধু মাটি আর অন্ধকার। হে বন্ধু, কী পড়ো এখন সেখানে? কীভাবে সেখানে পাও কবি কাহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’, আবুল হাসানের ‘পৃথক পালংক’ আর মির্চা এলিয়েদের ‘লা নুই বেংগলী’? সর্বশেষ গোলন্দাজ সূত্র, সামরিক অগ্রগতি নিয়ে কার সাথে মগ্ন হও সুমধুর আলাপচারিতায়?
তোমাদের মৃত্যুতে শোকের মিছিলে বাংলার প্রতিটি বৃক্ষ
২০০৯ এর ২ মার্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তোমাদের চির বিদায় জানানো হয়েছিল। হে অভিমানী বন্ধু আমার, তুমি কোনদিন জানতে পারবে না তোমাদের অকাল প্রয়াণে লক্ষ কোটি দেশবাসীর বুকে কী শোকের গভীরতা। তোমাদের মৃত্যুতে শোকের মিছিলে দাঁড়িয়েছিল বাংলার প্রতিটি বৃক্ষ। শোক জানাতে মেঘেরা পরেছিল কালো ব্যাজ। প্রিয় নদীগুলো কিছুক্ষণের জন্য যেন থামিয়েছিল তাদের স্রোতধারা।
আধাঁর বিনাসী প্রমিথিউসদের সালাম
যে সব অশুভ ও ভয়ঙ্কর শকুন বাংলাদেশ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে রক্তাক্ত করতে চায়, মার্চের এই শোকাবহ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর শহীদ সদস্যদের জন্য জাতির শোক, আবেগ আর ভালোবাসার জোয়ার দেখে স্বম্ভিত হয়েছিল সেই সব পাপিষ্ঠ শকুন।
হে বীর সেনানী বন্ধুগণ, তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাও। তোমাদেরকে কখনো ভুলব না আমরা। চিরদিন তোমরা রইবে আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের স্মরণে। তোমরা এ যুগের আধাঁর বিনাশী প্রমিথিউস। সঙ্কটে- সম্ভাবনায় তোমরা বার বার আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে বাংলাদেশকে ভালোবাসার আগুন।
(এই লেখাটি প্রথম সেনাবাহিনীর ত্রৈমাসিক সাময়িকী ‘সেনাবার্তায়’ প্রকাশিত হয়েছিল। এপ্রিল, ২০১০)
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক