গত শনিবার বিমান ও স্থলপথে ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের হামলার পর থেকে লড়াই চলছেই। হামাসের অতর্কিত হামলায় হতচকিত ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে, প্রতিশোধ হিসেবে গাজায় খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যুদ্ধে উভয় পক্ষের মৃতের সংখ্যা দুই হাজার অতিক্রম করতে চলেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, এই যুদ্ধ পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্রকে পাল্টে দেবে। হামাসের ভয়ংকর হামলা ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি তো ঘটিয়েছেই, তার সঙ্গে বিরাট মানসিক ধাক্কাও দিয়েছে।
মানচিত্র কার কতটুকু বদলাবে সেটা এখন বোঝা না গেলেও বুঝতে বাকি থাকছে না যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘ সংঘাতের সমাধানের কোনও পথ নেই। বলতে গেলে খোলা আছে দুটি পথ– বিশ্ব থেকে ইসরায়েলি মানচিত্র মুছে ফেলা, যেটা ইরান বলছে। এই পথ সংঘাতের, রক্তক্ষয়ের। এই পথ এক অসম যুদ্ধের –পরাক্রমশালী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিরীহ ফিলিস্তিন নাগরিকদের। আরেক পথ এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সৃষ্টি করা, যার জন্য উদ্যোগী সৌদি আরব ও তার মিত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
হামাসের হামলায় আপাতত ইসরায়েল বড় ধাক্কা খেয়েছে এবং ভয়ানক পাল্টা হামলা শুরু করেছে, যার মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। উভয় হামলাতেই বেসামরিক নাগরিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এর প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুয়ের্ক বলেছেন, এই হামলাটি ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর একটি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, বেসামরিক ব্যক্তিদের কখনোই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত না। ইরান যেমন করে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবসুলভভাবে হামাসের নিন্দা জানিয়ে ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
ফিলিস্তিনের নিজের ঘরে বিভাজন এবং বিদ্বেষের অন্ত নেই। নিজভূমে পরবাসী ফিলিস্তিনি জনগণের স্বদেশের আকাঙ্ক্ষা সক্রিয় হলেও গোষ্ঠী-নেতাদের লড়াইয়ের কারণে সেটা কখনও সেভাবে গতিবেগ পায় না। ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন আল-ফাতাহ এবং ইরান সমর্থিত আল-হামাসের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং হানাহানির কথা সবার জানা। মাহমুদ আব্বাসও ভালো করে জানেন হামাসের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে তাদের জন্য দেওয়া মার্কিন-ইউরোপীয় অনুদান বন্ধ হয়ে যেতে পারে যেকোনও সময়।
প্রায় ২১ বছর আগে আরব শান্তি উদ্যোগ নামে সক্রিয় হয়েছিল সৌদি আরব। এর উদ্দেশ্য ছিল ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্ত ফিরিয়ে এনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা। সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। তবে সৌদি আরব এখনও মনে করে এটি সম্ভব, যদি দুই পক্ষের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগে।
এগুলো সবই রাজনৈতিক উদ্যোগ। আলোচনার টেবিলে এসব ওঠে, আবার হারিয়ে যায়। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিষয়টি খুব কম আলোচনাতেই উঠছে। ইসরায়েলের নাগরিক সমাজে ফিলিস্তিনিদের আলাদা রাষ্ট্রের কথা আলোচিত হলেও ইসরায়েলের শাসকরা সে পথটি চিন্তাও করে না। তাদের মধ্যে কাজ করে হিংসা ও বিদ্বেষ।
হামাস কেন এত বড় হামলা করলো বা করতে পারলো সেটা এখন বড় আলোচনা। ইসরায়েলের গুপ্তচর বিভাগ বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসাবে খ্যাত, তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কীভাবে সম্ভব হলো, এটি যেমন আলোচনা তেমনি আলোচনা কেন করলো তা নিয়ে। গাজা এবং অন্যত্র জনসমর্থন আদায় করতে এবং পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের গুরুত্বকে আরও জোরালো করতে হামাস এই হামলা করেছে, যদিও তারা ভালো করেই জানে এমন হামলা ইসরায়েলকে আরও সহিংস করে তুলবে এবং দেশটি অধিকৃত অঞ্চলের নীতিতেও কোনও পরিবর্তন আনবে না। ২১ বছর আগে সৌদি আরবের শান্তি উদ্যোগ কিছুটা নতুনভাবে গতি পায় বাইডেন প্রশাসনের কারণে। আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনাকে ব্যাহত করা হামাসের আরেকটি বড় লক্ষ্য।
সৌদি আরবকে আধুনিক, উদার, ব্যবসা ও পর্যটনবান্ধব করতে চান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। নিজ দেশে মেয়েদের ব্যাপারে উদারতা দেখানোসহ সামাজিক বিভিন্ন সংস্কারের পাশাপাশি সৌদি আরব পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার চেষ্টাও করছে। সেই প্রচেষ্টায় আছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। ইহুদি রাষ্ট্রটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব স্বীকৃতি দেয়নি ঠিক, তবে নানাভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এর পাশাপাশি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির বড় উদ্দেশ্য ফিলিস্তিন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। সেটি আর আপাতত এগোবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বলতে গেলে বিরাট ক্ষতিই হলো। ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের সূত্রে পশ্চিম তীরে স্বাভাবিক অবস্থা আসার সুযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটি হাতছাড়া হলো। একটা কথা তো ঠিক যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমাধান হতে পারে না। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চায় সৌদি আরবও। তবে সেটা শান্তিপূর্ণভাবে।
হামাস আগে হামলা করেছে এ কথা সত্যি। তবে বল ইসরায়েলের কোর্টেই। দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের জমি, ভূমি দখল করে রাখার মাধ্যমে, নিষ্ঠুরতা জারির মাধ্যমে নিজেদের জন্যও অশান্তির পরিবেশ তৈরি করছে কিনা সেই বিবেচনা বোধ ইসরায়েলের না এলে শান্তি সুদূর পরাহত। হাত আছে আমেরিকারও। যদি কারণে অকারণে ইসরায়েলের পাশেই থাকে যুক্তরাষ্ট্র তবে তার নিজের যুদ্ধ অর্থনীতি চাঙা হবে ঠিকই, তবে সেটা হবে রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে।
লেখক: সাংবাদিক