শোকাবহ আগস্ট ও দুটি জন্মদিন

নাসির আহমেদ
  ০২ আগস্ট ২০২২, ২১:৪০

আগস্ট এলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে আসে। সেই মর্মান্তিক স্মৃতি বিবেকবান মানুষ মাত্রকেই মর্মাহত করে। একইসঙ্গে ঘাতকদের প্রতি প্রবল ঘৃণাও জাগিয়ে তোলে। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধানকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতিকে এবং মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তেভেজা একটি নবীন রাষ্ট্রের প্রগতিশীল অস্তিত্বকেই। যে কারণে জাতির পিতার হত্যাকারীরা ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা দিয়ে পরিচয় পাল্টে দিয়েছিল। যদিও শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ তা মেনে নেয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক দর্শনে বিশ্বাসী ঘাতকরা একাত্তরের ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করে দিয়ে গেলো, তার বিষফল আজও ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। যে কারণে আগস্ট আমাদের কাছে এক অবিস্মরণীয় শোক আর লজ্জার গ্লানিতে নিমজ্জিত একটি মাস।
আগস্ট মাসটি নানামাত্রিক নেতিবাচক ঘটনায় পূর্ণ। শুধু ১৫ আগস্টের জাতীয় বিপর্যয়ই নয়, ১৯৭৫-এর এই আগস্টেরই ২৬ তারিখ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রুদ্ধ করার জন্য অমানবিক বর্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়ার সরকার জাতীয় সংসদে অনুমোদন করিয়ে আইনে পরিণত করেছে।
এ দেশ কী করে ভুলে যাবে একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বহু মানুষের প্রাণনাশের সেই ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথা! আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যার নীলনকশা কীভাবে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল জঙ্গিগোষ্ঠী আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে, তার আজ কারও অজানা নেই। আদালতের রায়ে সেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বহু নেতাকর্মীকে হতাহতকারী সেই খুনিচক্রের বিচার শেষ হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে অপরাধীরা।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই মনে পড়ে (৬ ও ৯ আগস্ট) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর পারমাণবিক বোমায় মানব ইতিহাসের ভয়ংকরতম হত্যাযজ্ঞ আর বিপর্যয়ের স্মৃতিও। এই আগস্টেই মনে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ আগস্ট ১৯৪০) এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণের (২৭ আগস্ট ১৯৭৬) স্মৃতিও।
কেমন করে দেশবাসী ভুলে যাবেন বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়ংকর উত্থানের স্মৃতিবহ ১৭ আগস্টের কথা? সেদিন মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী! বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়ে তারা জানান দিতে চেয়েছিল তাদের শক্তি কতখানি।
এ রকম অনেক দুর্যোগময় ঘটনা জড়িয়ে আছে শোকাবহ আগস্টের সঙ্গে। কিন্তু এত শোক, এত দুঃখের মধ্যেও জীবন সতত বহমান। এ মাসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন  (৮ আগস্ট ১৯৩০) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। এ মাসেই তাদের জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সংগঠক শেখ কামালের জন্মদিন (৫ আগস্ট ১৯৪৯)।
কিন্তু তাদের দুজনের জন্মের আনন্দময় স্মৃতি আমাদের উচ্ছ্বসিত করে না, বরং আগস্টের ১৫ তারিখ জাতির পিতার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাদের নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার মর্মান্তিক স্মৃতিই আমাদের বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে। তারপরও জন্মদিন বলে কথা। প্রতিবছর তাঁদের জন্মদিনে স্মরণ করা হয় পরম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। শেখ কামালের জন্মদিনে দেশের সংবাদপত্র টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করে, বেতার-টেলিভিশনে প্রচারিত হয় তাঁর অকাল প্রয়াণের মর্মান্তিক ঘটনা।
গত বছর টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে স্মৃতিচারণমূলক  আলোচনায় শেখ কামালের সহপাঠীদের কারও কারও স্মৃতিচারণ পড়েছি, শুনেছি। তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন কী অমায়িক আর সহজ মানুষ ছিলেন তিনি। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর কী জঘন্য মিথ্যাচার আর অপপ্রচার চালানো হয়েছিল শেখ কামালকে নিয়ে। জাসদের পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ আর মাওলানা ভাসানীর তথা ন্যাপের মুখপাত্র ‘হক কথা’ যে কী ভয়ংকর মিথ্যাচার করেছে, তা আজ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। এখনও পুরনো পত্রিকা ঘাঁটলে সেই ভয়াবহ মিথ্যাচারের প্রমাণ মিলবে।
স্কুলজীবন থেকেই শেখ কামাল একজন প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ, নাট্যাভিনেতা, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক হিসেবে মেধার স্বাক্ষর রেখে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর কারাবাসকালে কৈশোর থেকে কীভাবে সংসারে মাকে সহযোগিতার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন, তার বিশদ বিবরণ পড়ে আমরা চমকে উঠি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন শেষে এমএ ফাইনাল পরীক্ষার ভাইবাও দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। কিন্তু উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শেখ কামাল তার রেজাল্ট দেখে যেতে পারলেন না। উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল বলেই সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার (ক্যাপ্টেন)-এর চমৎকার সম্ভাবনাময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরে আবার ফিরে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। লেখাপড়া, খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তিনি।

বিয়ে করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল খুকীকে। বিয়ের মাস পূর্ণ হতে না হতেই ১৫ আগস্ট। হাতের মেহেদি ঢাকা পড়ে গেলো রক্তে। মুছে গেলো প্রিয় যুগলের সম্ভাবনাময় এক উজ্জ্বল জীবন-বাস্তবতা।

এরকম মর্মান্তিক স্মৃতি নিয়েই ফিরে আসে স্নেহময়ী বঙ্গমাতা এবং তার প্রিয়পুত্র শেখ কামালের জন্মদিন।

বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা ওরফে রেণু অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। শিশু বয়সে পিতৃমাতৃহারা ফজিলাতুন নেছা রেণু লালিত-পালিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহময়ী মায়ের কাছে। তাদের বিয়ে হয়েছিল শিশু বয়সেই। তবে দাম্পত্য জীবন আরও বেশ কয়েক বছর পরে, অর্থাৎ পরিণত বয়সে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তার বিশদ বর্ণনা আছে। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর জীবনের ছায়াসঙ্গী এই মহীয়সী নারী জাতির পিতার উত্থান-পতনে তোলপাড় রাজনৈতিক জীবনের কত যে দুঃখ আর দুর্যোগ সহ্য করে গেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।

বিভাগ পূর্বকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর সুখ-দুঃখের নিত্যসঙ্গী ছিলেন বঙ্গমাতা। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কারাগারে। শুধু কারাগারে বন্দিই রাখা হয়নি, তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অপচেষ্টাও হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত নিরন্তর তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে।
চরম দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী জীবনসঙ্গিনী সহযোদ্ধা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন অবিচল সংগ্রামী। স্বামীকে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালন নিয়ে কখনও চিন্তা করতে দেননি। বরং বৈরী রাজনীতির দুর্গম পথচলায় সবসময় শক্তি সাহস জুগিয়েছেন, আবার বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালে তার অবর্তমানে তার হয়ে করণীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মামলা পরিচালনা পর্যন্ত টাকা জোগাড়, উকিল জোগাড়সহ যাবতীয় কাজ পরম নিষ্ঠার সঙ্গে, ধৈর্যের সঙ্গে সম্পাদন করেছেন বঙ্গমাতা।
আওয়ামী লীগের সেই চরম দুর্দিনে জেনারেল আইয়ুব খানের মতো দোর্দণ্ড  প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের কাজটা যে কত কঠিন ছিল, আজকের বাস্তবতায় তা কল্পনাও করা যাবে না। মামলা পরিচালনার জন্য যোগ্য উকিল খুঁজে বের করা, মামলার খরচ জোগানো এসব নিয়ে কত কষ্টই না তিনি করেছেন। নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করেও মামলার খরচ চালিয়েছেন। মামলার কাগজপত্র নিয়ে উকিল কোর্টকাচারি সামাল দেওয়াসহ কতই না ছোটাছুটি তার।
বৈরী পরিবেশে ছুটে বেড়িয়েছেন ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। পুলিশ গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছুটে গেছেন বিভিন্ন নেতাকর্মীর বাড়িতে, তাদের সুখ-দুঃখ দেখতে, সহায়তা করতে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য কত কী করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর হয়ে তার নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন নেতাকর্মীদের কাছে। কর্মীরাও ছুটে এসেছেন বঙ্গমাতার কাছে। তিনি তাদের আপ্যায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা জানিয়ে সেভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তো সংসারের দিকে ফিরে তাকাবার সুযোগই পাননি। ঝড়ঝাপটা সব গেছে প্রিয়তমা স্ত্রী বঙ্গমাতার ওপর দিয়ে।
১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হওয়ার পর মিন্টু রোডের মন্ত্রিপাড়ায় সরকারি আবাসনে ঠিকানা হয়েছিল বঙ্গমাতা এবং তার সন্তানদের। কিন্তু কয়েক মাসের সেই শান্তি তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেলো যখন পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসক চক্র যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্র হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করতে শুরু করে।
আবার বাসা খুঁজে ভাড়া করা বাসায় যাওয়া। এমন ঘটনা ১৯৫৬ সালেও একবার ঘটেছিল। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য বঙ্গবন্ধু সরকারি বাসায় উঠেছেন, কিন্তু দলের দায়িত্ব পালনের স্বার্থে তিনি যখন স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করলেন, তখন আবার বাসা খুঁজে ভাড়া বাড়িতে ওঠার বিড়ম্বনা।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বাড়ি করার আগে অর্থাৎ গোটা পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত নিরন্তর বঙ্গমাতাকে সামাল দিতে হয়েছে ভাড়া বাসায় অস্থায়ী বসবাসের ছোটাছুটির বিড়ম্বনা।
বঙ্গমাতা জাতির পিতাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এমনভাবে সুযোগ দিয়েছিলেন বলেই টুঙ্গিপাড়ায় ‘খোকা’ থেকে তিনি জাতির পিতায় পরিণত হতে পেরেছিলেন। সাংসারিক অভাব অনটন কোনও দিকে তাকাতে দেননি বঙ্গবন্ধুকে। এমনও হয়েছে, সংসারে বাজার করারও টাকা নেই, সন্তানদের শুধু খিচুড়ি খাইয়েছেন। এমন উৎসাহ দিয়েছেন যাতে সন্তানদের মনোবল ভেঙে না যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ তার পরিবারের সদস্যদের এবং বঙ্গবন্ধু- পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের স্মৃতিচারণে সেই দুঃখ-দুর্দশার দিনগুলো দেশবাসীর কাছে আজ পরিচিত।
স্বামীর কারাবন্দি জীবনের বাস্তবতায় কখনও ভেঙে পড়েননি বঙ্গমাতা। বরং তিন পুত্র, দুই কন্যাকে নিয়ে চরম বৈরী পরিবেশেও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট অতিক্রম করে হাসিমুখে সংসারে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে বয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে সংসার নিয়ে কখনও কোনও অভিযোগ করেননি। কোনও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়ও রাখেননি। বরং সবসময় দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র মতো অসাধারণ ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ হয়তো এ জাতি কখনও পেতো না, যদি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা তাকে আত্মজীবনী লিখতে অনুপ্রেরণা না দিতেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী শুরু হয়েছে তার প্রিয় সহধর্মিণীর সেই অনুপ্রেরণার উল্লেখের মধ্য দিয়ে।
প্রথম পৃষ্ঠাতেই তিনি লিখেছেন ‘... আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়।... আমার স্ত্রীর ডাকনাম রেণু... আমার জন্য কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন তথা কৈশোর থেকে নিরন্তর সংগ্রামে দুঃখকষ্ট, হাসিকান্নায় পরম ধৈর্যে ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত তার প্রিয় সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বহু জায়গায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সেবা, ভালোবাসা, পরিচর্যা আর নিরন্তর অনুপ্রেরণার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। তরুণ ছাত্রনেতা ভাষা-সংগ্রামী শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা পর্যন্ত যে বিশাল কণ্টকিত পথ, সে পথের নিত্যসঙ্গী ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সব সংগ্রামের নেপথ্য শক্তি জুগিয়েছেন এই সর্বংসহা মহীয়সী নারী।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুকে আইয়ুব সরকার আন্দোলনের মুখে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিল না, তখন আপস-আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। বঙ্গবন্ধুকে রাজি করানোর জন্য একটি চক্র পাঁয়তারা করতে থাকে। এই কঠিন ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে বের না হওয়ার জন্য কঠোর অবস্থান নেন বঙ্গমাতা। কারাগারে তিনি জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এ খবর পাঠান। সেদিন বঙ্গমাতার এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভূমিকায় রক্ষা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে, রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আইয়ুব খানের চক্রান্ত ভেস্তে গেছে বঙ্গমাতার সচেতন ভূমিকার কারণে।
শুধুই একটি ঘটনা নয়, এমন বহু যুগান্তকারী ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গমাতা।
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কথা বলা যায়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিতে যাবেন। ভীষণ উদ্বিগ্ন তিনি। একদিকে ছাত্র ও যুবসমাজের প্রবল চাপ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার, অন্যদিকে সরাসরি ঘোষণা দিলে সামরিক হামলার চরম বিপর্যয়ের শঙ্কা। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশে যাত্রালগ্নে সেই উৎকণ্ঠার মধ্যে বঙ্গমাতার কী অসাধারণ অনুপ্রেরণামূলক পরামর্শ।
‘সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমি জানো যে দেশের মানুষের জন্য কী চাই, তোমার থেকে বেশি তা কেউ জানে না। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি শুধু সে কথাটাই বলবে।’
সেই অসামান্য প্রেরণা আজ ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকের মতো তিনি দলের নেতাকর্মী এবং কারারুদ্ধ কর্মীদের স্বজন-পরিজনদের  যেভাবে আপ্যায়ন করেছেন, সহমর্মিতা জানিয়েছেন, তা দুঃসময়ে দলকে সংগঠিত রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ এই পরস্পর নির্ভরতার উজ্জ্বল চিত্রই তুলে ধরেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর বারবার কারাবন্দি হন বঙ্গবন্ধু; তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অনেকে কারাগারে। সেই চরম দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়ে অনুপ্রাণিত করে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সঙ্গে সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল।
কর্মীরাও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গমাতার কাছেই ছুটে আসতো। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশনা এ নেতা-কর্মীদের পৌঁছে দিতেন। স্বজনদের যেভাবে আপন বিবেচনা করেছেন, আপ্যায়ন করেছেন, বিপদে সহমর্মিতা জানিয়েছেন, তার কোনও তুলনা নেই।  প্রবীণ নেতাদের স্মৃতিচারণা থেকে আমরা জানতে পারি– ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। সেদিন নিজ হাতে রান্না করে নেতাকর্মীদের খাইয়েছিলেন বঙ্গমাতা। যেন সহধর্মিণীর চেয়ে রাজনৈতিক সহকর্মীর ভূমিকায়ই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন এই মহীয়সী নারী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, তখনও তাঁর সরল-সহজ জীবনের বৃত্ত থেকে তিনি সরে যাননি। সেই মমতাময়ী রূপ সর্বত্রই ছিল দৃশ্যমান। ১৯৭২’এর জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে এলেন, তখন অনেক সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যা ছিল যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে লাঞ্ছনার শিকার বীরাঙ্গনা নারীদের পুনর্বাসন এবং যুদ্ধশিশুদের পরিচয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: পিতার নাম লিখে দিও শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গমাতা নিজেও বীরাঙ্গনাদের বলেছিলেন, আমি তোমাদের মা। মাতৃস্নেহে তিনি অনেক বীরাঙ্গনা কন্যার বিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবন একটাই আরাধ্য ছিল, বাঙালির স্বাধীনতা আর শোষণ থেকে মুক্তি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাও দেশের কথাই ভাবতেন। বঙ্গবন্ধুর মতো রাষ্ট্রক্ষমতার কোনও ভোগ-বিলাসের প্রতি সামান্য দৃষ্টিও ছিল না তাঁর। তিনি বরাবরই সাধারণ সুতি শাড়ি পরতেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতার পরও তিনি সেই সহজ-সরল সাধারণ অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন।
রাসেলের জন্মদিনের ঘরোয়া অনুষ্ঠানের একটি ফটোগ্রাফ, সম্ভবত ১৯৭৪ কী ৭৫ সালের, ফেসবুকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। কত ছোট্ট একটি কেক! অতি সাধারণ অনাড়ম্বর আয়োজন। সাধারণ পোশাকে তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা- শেখ রেহানা, পুত্র রাসেলসহ পরিবারের সব সদস্য মিলে জন্মদিন পালন করছেন কাঠের অতি সাধারণ একটি ডাইনিং টেবিলে। একটি দেশের রাষ্ট্রপতির সন্তানের জন্মদিন এত সাদামাটা হয়, কল্পনাই করা যায় না!
এই সাধারণ জীবনই যাপন করেছেন অসাধারণ বঙ্গবন্ধু, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও ততধিক সাধারণ জীবনই যাপন করে গেছেন। যে কারণে তার সন্তানরাও ভোগবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হননি। দেশপ্রেম, সততা আর সহজ মানুষ হিসেবে বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে বঙ্গমাতা এবং তাদের সন্তানেরা জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
জীবনে যেমন, মরণেও বঙ্গমাতা স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে একই রক্তেশয্যায় মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বড় অকালে চিরবিদায় নিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার প্রিয় সহধর্মিণীর মতো এমনই মহীয়সী নারী জন্ম দিয়েছিল এই বাংলার পলিমাটি, এই কথা ভেবে বাংলার মাটির কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছে করে। রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদেরও দেশপ্রেমে বড় ইচ্ছে করে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’!
লেখক: অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক ( বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন।