সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত শনিবার (২১ জুন) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার এই ঘোষণা দেন। এর ফলে ১৩ জুন শুরু হওয়া ইরান-ইসরায়েলের চলমান সংঘাত নতুন মোড় নিল। সংঘাতটি এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে।
আঞ্চলিক যুদ্ধ বা এমনকি বিশ্বযুদ্ধ নিয়েও কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় রাত ৮টার একটু আগে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমরা ইরানে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় সফলভাবে হামলা সম্পন্ন করেছি, যার মধ্যে রয়েছে ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান। সব উড়োজাহাজ এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে। এখন শান্তির সময়।
এরপর ইরানের সফল সামরিক অভিযানের বিষয়ে হোয়াইট হাউসে স্থানীয় সময় রাত ১০টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদি দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠা না হয় তাহলে অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর ওপরও শিগগিরই নির্ভুলভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে অভিযান চালানো হবে। এভাবে চলতে পারে না।
হয় শান্তি আসবে, নয়তো ইরানে ট্র্যাজেডি ঘটবে।’ এ সময় তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান।
পরে ইরানও তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তেহরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা অ্যাটমিক এনার্জি অর্গানাইজেশন অব ইরানের প্রধান বলেছেন, ‘এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির লঙ্ঘন।’ যদিও ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, আদতে তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টি করার মতো সেখানে কিছু নেই।
এ অবস্থায় সংঘাত কোন পর্যায়ে যেতে পারে? পরবর্তী পরিস্থিতি অনেকটা ইরানের সরকারের ওপর নির্ভর করছে। গত সপ্তাহে ইরানের ধর্মীয় নেতা আলী খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশ নিলে তাদের পাল্টা আঘাত করা হবে।’ খামেনি বলেন, ‘মার্কিনদের জানা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনবে।’ তবে মাঠ পর্যায়ে ইরান কী পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা দেখার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরান হামলার প্রেক্ষাপটে মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কের ইরান বিষয়ে একটি মন্তব্য মনে পড়ল। ২০০৪ সালে এই জেনারেল একটি গোপন পরিকল্পনা প্রকাশ করেন, যা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। ক্লার্কের ভাষ্য অনুযায়ী সেই গোপন পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ‘আমরা পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি দেশকে সরিয়ে দেব। শুরু হবে ইরাক দিয়ে; তারপর সিরিয়া, লেবানন, সোমালিয়া, সুদান এবং সব শেষে ইরান।’ পরিকল্পনাটি মূলত নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকার নিও-কনজারভেটিভ নীতিনির্ধারকদের দ্বারা পরিচালিত ছিল বলে তিনি জানান। এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি ছিল ভূ-রাজনৈতিক ও তেল নিয়ন্ত্রিত স্ট্র্যাটেজি।
তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের বর্তমান ‘ইরান প্রকল্প’ এত সহজ হবে না। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় বিশ্বপরিস্থিতি এবং বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। গাজায় গণহত্যার দায়ে পশ্চিমা বিশ্বে ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতি অনেক কমে গেছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ইরানে মার্কিন হামলার প্রতিবাদ হচ্ছে। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের হার্টল্যান্ডে ইরান আক্রমণ করায় ইসরায়েলিদের মনোবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলের ‘অজেয় ভাবমূর্তি’ আর নেই।
১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে উত্খাত করার লক্ষ্যে এজেন্ট না পাঠালে (অপারেশন আয়াক্স) ইরান হয়তো গণতন্ত্রের পথে তার যাত্রা অব্যাহত রাখত। লেখক স্টিফেন কিনজার তাঁর ‘অল দ্য শাহ’জ মেন’ গ্রন্থে এমনটা লিখেছেন। তিনি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ইরান আক্রমণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ অবস্থায় ইরান যে পাল্টা ব্যবস্থাগুলো নিতে পারে তা হলো সরাসরি সামরিক প্রতিশোধ, প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে হামলা, হরমুজ প্রণালি বন্ধ ও সাইবার আক্রমণ। তবে সম্ভবত ইরান সরাসরি আক্রমণ না করে বরং ‘অপ্রত্যক্ষ যুদ্ধ’ ও আঞ্চলিক উত্তেজনা ছড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের চাপে ফেলতে চাইবে। এরই মধ্যে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি মার্কিন জাহাজে আক্রমণের হুমকি দিয়েছে।
মার্কিন হামলার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইরান যদি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে, তখন হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মকভাবে এই যুদ্ধে জড়াতে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র স্থল অভিযান চালালেও ইরানে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে। তখন ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়ে বড় ফাঁদ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। সেখানে হাজার হাজার মার্কিন সেনার প্রাণ হারানোর ঝুঁকি থাকবে। অবশ্য এই সম্ভাবনা বেশ কম।
আপাতত মার্কিন সম্পৃক্ততা তিনটি বোমা ফেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে যে আপাতত তাদের মিলিটারি অপারেশন সমাপ্ত এবং তারা তেহরান সরকার পতনের চেষ্টা করছে না। এখন ইরান প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিশোধের জন্য কিছু ‘ফেসসেভিং অ্যাটাক’ করতে পারে, যেটা আগেও করেছে। এদিকে চলমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে না ঘাঁটিয়ে ইসরায়েলে মিসাইল আক্রমণ অব্যাহত রাখবে।
গতকাল ইরানে যেসব পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলা হয়েছে সেগুলো যদি অচল হয়ে যায়, তাহলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তাঁদের যুদ্ধের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে ঘোষণা দিতে পারেন। এটি এই সংঘাতকে সমাপ্তির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।
কিছু সময়ের জন্য ইরান পারমাণবিক প্রকল্প থেকে সরে আসতে পারে। জাতিসংঘ ও পরাশক্তিগুলোর চাপে কিছুদিনের মধ্যে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আলোচিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবে না বলে মনে হয়। কারণ অন্য শক্তিগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
শক্তিশালী মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানের আঘাত নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধের গতি বদলে দিয়েছে। তবে আগামী দিনে এই যুদ্ধ আরো তীব্র বা সর্বাত্মক হবে কি না তা নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েলের নেতৃত্ব ও প্রতিক্রিয়ার ওপর। সেইসব নেতৃত্ব হঠকারী বা আত্মঘাতী কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে যুদ্ধের এই চরম উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে হয়।
হাজার বছরের সভ্যতার দেশ ইরান। ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ঐতিহাসিক ও আত্মিক সম্পর্ক। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ সালে পারস্যরাজের নিমন্ত্রণ পেয়ে ইরান ভ্রমণ করেন। সেই অভিজ্ঞতার ওপর লেখেন অসাধারণ গ্রন্থ ‘পারস্যযাত্রী’। অনেক বাংলাদেশির কাছে ইরান একটি আবেগের নাম। আশা করি, এই ভয়ংকর সংকট থেকে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ মুক্ত হবে। গোলাপ, টিউলিপ আর বিখ্যাত কবিদের দেশ ইরান বিদেশি আক্রমণ থেকে মুক্তি পাক। শান্তি নামুক মধ্যপ্রাচ্যে।