মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে খুব বেশি পরিবর্তন আসার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্টভাবেই আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা চিন্তা করেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা নির্বাচনকেন্দ্রিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। পরিবর্তন তখনই ঘটতে পারে, যখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান হবে। নানা বিষয়ে মতৈক্য ঘটতে পারে, যেমন বাণিজ্যের দিক থেকে কিংবা প্রতিরক্ষা বিষয়ে। এ রকম আরও বিষয় থাকতে পারে, যেগুলোর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ক আরও সুস্পষ্ট করা সম্ভব।
কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বা করেছে– এমন ভাবাটা সমীচীন নয়। বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত যে আলোচনা করেছে, তা নিশ্চিতভাবেই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গে কিংবা যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের সম্পর্কে ভারতের অবস্থান অতীতে যা ছিল, ভবিষ্যতে খুব সম্ভব সে রকমই থাকবে। তবে এটিও লক্ষণীয়, ভারতের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ঢালাওভাবে কোনো পক্ষে না যাওয়ার জন্য জনগণের মধ্যে তারা এক ধরনের আস্থার জায়গা তৈরির চেষ্টা করছে। স্বাভাবিকভাবেই একে সাধুবাদ জানানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার বলতে চাইছে, এক ধরনের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে গেলে তার দায়িত্ব যে শুধু আওয়ামী লীগের, তা ভাবার কারণ নেই। এখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও আছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, সে ক্ষেত্রে ভারত বলুক বা না বলুক; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই আসবে। এখানে দায়দায়িত্ব যে সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের, তাও নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলতে পারে, তাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে নির্বাচনী পরিবেশ বাংলাদেশ সরকার হয়তো তৈরি করতে পারেনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মাথায় রেখে ভাবা দরকার, বিএনপি নির্বাচনে এলে কী হবে, আর নির্বাচনে না এলে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? সে ক্ষেত্রে নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয় ভাবনাচিন্তার বিষয় রয়েছে এবং তা জটিল হবে বলে আমার মনে হয়। এখানে তৃতীয় পক্ষের কারণে আমেরিকার নীতির পরিবর্তন ঘটবে না। তবে ১. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে; ২. আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে কিনা এবং সে জায়গায় আওয়ামী লীগই শুধু সব দায়দায়িত্ব বহন করে, তা নয় এবং ৩. নির্বাচনের সময় কী ধরনের সহিংসতা হয় বা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হচ্ছে কিনা– সেটি যুক্তরাষ্ট্র দেখবে।
নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমে যা দেখছি, সেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলো বেশ কিছুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত যে চাইছে নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমিও মনে করি, আমাদের নির্বাচনে আসলে বাংলাদেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। বহির্বিশ্বের দেশগুলো একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে মাত্র, কিন্তু তারা নির্ণায়ক হতে পারে না। আমরা অনেকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের দিকে বেশি নজর দিই। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের দিকে নজর না দিয়ে যারা নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা নিজেদের দায়িত্বেই নির্বাচনে যাতে কারচুপির ঘটনা না ঘটে, তা বাংলাদেশের স্বার্থেই নিশ্চিত করবে। এ ধরনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্যান্য দেশ বড় করে দেখবে।
প্রধান বিরোধী দল হিসেবে যদি আমরা বিএনপিকে চিন্তা করে থাকি, তারা এই বিষয়গুলো অনুধাবন করবে। এর পর তারা নিশ্চিতভাবেই গঠনমূলক অংশগ্রহণ ও সংলাপ এবং সেই সঙ্গে গঠনমূলক সমালোচনা করবে। আলোচনার মাধ্যমে তারা নির্বাচনে আসতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে না এসে যদি বলা হয় কারচুপি হচ্ছে, তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটিও মনে রাখা দরকার। খুব স্বাভাবিকভাবেই যেখানে বিরোধী দল থাকবে না, জবাবদিহি থাকবে না; সেখানে নির্বাচনে কারচুপি হবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খুব গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে। সেটিও পশ্চিমা বিশ্বের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলবে। সুতরাং বিষয়গুলো মাথায় রেখে, জনগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কী করা যেতে পারে, সেটিই আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান চিন্তাভাবনা হওয়া দরকার।
সাহাব এনাম খান: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়