মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আকাশযুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানিদের যুদ্ধক্ষমতাকে ধ্বংস করেছিলেন। এই বীর যোদ্ধাদের মধ্যে ফ্লাইং অফিসার (পরে স্কোয়াড্রন লিডার) বদরুল আলম, বীরউত্তম অন্যতম। গত ২৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে এ বীর যোদ্ধার জীবনাবসান হয়। ২৮ অক্টোবর দুপুরে, ফিউনারেল প্যারেড শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্কোয়া. লি. বদরুল আলমকে শাহীন কবরস্থানে দাফন করা হয়। বিমান বাহিনী যখন নির্ভীক এই আকাশ যোদ্ধাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাচ্ছিল, তখন দুপুরে দেশের অন্যত্র বেশকিছু বাঁক বদলকারী ঘটনা ঘটে।
দুপুর প্রায় ১২টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে কর্নফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করেন। যা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করল। এই সময়ে ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশ-মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনা ও সংঘর্ষ ঘটে। নৃশংসভাবে পুলিশ সদস্য হত্যা, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, রাজপথে গাড়ি পোড়ানো, অগ্নিসন্ত্রাস, রাজপথে সংঘাত, হাসপাতালের গাড়ি পোড়ানো, সমাবেশ পন্ড হওয়া, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, সাংবাদিক আহত হওয়া...। টিভি স্ক্রলে দেখানো হয় ‘কাকরাইল, নয়াপল্টন রণক্ষেত্র...।’ স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমাদের নিজেদের ভেতরের সর্বনাশা যুদ্ধে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর কিছু এলাকা। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের আরেক চিত্র সম্ভবত বিভক্ত, সংঘাতময় ও বৈষম্যমূলক বাংলাদেশ। হেমন্তের রাত্রে, বিষণ্ন মনে ভাবি, বদরুল আলমের মতো মুক্তিযোদ্ধারা কি এমন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন?
স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলমের ফিউনারেল প্যারেড :
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতির গর্বিত কৃতি সন্তান এবং ‘কিলোফ্লাইটের’ বৈমানিক স্কো. লি. বদরুল আলম, বীরউত্তম (অব.) ২৭ অক্টোবর বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী নাদিরা আলম, কন্যা ফারিহা হাসান, পুত্র রাজিন আলম ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বাশার প্যারেড গ্রাউন্ডে ২৮ অক্টোবর-২৩, মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষে ভারপ্রাপ্ত সহকারী সামরিক সচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সহকারী সামরিক সচিব কর্নেল জিএম রাজীব আহমেদ এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
ফিউনারেল প্যারেড শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বদরুল আলমকে, বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশারে অবস্থিত শাহীন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানার্থে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন বিমানের ফ্লাই পাস্ট অনুষ্ঠিত হয়।
একজন বৈমানিকের বেড়ে ওঠা :
স্কো. লি. বদরুল আলম ১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খন্দকার মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন) এবং মাতার নাম মিসেস হোসনে আরা বেগম। তিনি ১৯৬৫ সালে পিএএফ পাবলিক স্কুল লোয়ার টোপা থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৮ সালে পিএএফ একাডেমি, রিসালপুর, পাকিস্তান থেকে এফএসসি পাশ করেন।
স্কো. লি. বদরুল আলম ১৯৬৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। একাডেমিতে সাফল্যের সাথে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৬৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৪৫তম জিডি (পি) শাখায় পাইলট অফিসার পদবিতে কমিশন লাভ করেন। ক্যাডেট অবস্থায় তিনি ফ্লাইংয়ে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
বদরুল আলম ছিলেন একজন চৌকস বৈমানিক। চাকরিকালীন তিনি তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে এমআই-৮ হেলিকপ্টার ও মিগ-১৯ বিমান চালনা প্রশিক্ষণ কোর্সসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পেশাগত কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে তা সম্পন্ন করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে অসম সাহসিক অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে বদরুল আলমকে ১৯৭৩ সালে ‘বীরউত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ ছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৬’-এ ভূষিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে বদরুল আলম অত্যন্ত উদার, সামাজিক, দয়াশীল ও মানবিক ছিলেন।
দূর রণাঙ্গনের হাতছানি :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় বদরুল আলম বিমান ঘাঁটি ঢাকায় হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রনে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য তিনি ১৯৭১ সালের ৬ মে নরসিংদী থেকে ভারতের আগরতলার দিকে রওনা হন। বিদায়ের সময় তার মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘জিতে এসো, হেরে যেও না। তোমাকে দেশের জন্য ছেড়ে দিলাম।’ বাবা ক্যাপ্টেন বদরুদ্দোজা নিজে গাড়ি চালিয়ে নরসিংদী লঞ্চ ঘাটে নামিয়ে দেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল আলম। যিনি পরে বড় ভাইকে অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধে যাবেন।
কলকাতার ম্যাপে প্রস্ফুটিত সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গন :
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (মে-সেপ্টেম্বর) এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি বা কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল এমএজি ওসমানীর (পরে জেনারেল) স্টাফ অফিসার হিসেবে কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সান্নিধ্য লাভ করেন।
কলকাতার দায়িত্ব পালন বিষয়ে বদরুল আলম বলেন, ‘আমাকে জেনারেল ওসমানীর স্টাফ অফিসার নিয়োগ দিয়ে রেখে দিল। আমি মূলত আমাদের নেতাদের তথ্যগুলো ভারতের হাই-অফিশিয়ালদের সঙ্গে শেয়ার করতাম। তাদের সিদ্ধান্তগুলো আমাদের নেতাদের জানাতাম। অনেকটা ইন্টেলিজেন্সের মতো করে কাজ করতাম।’
কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সেকেলে ধরনের বিশাল একটি বাড়ি। এটি ছিল একদা অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারি বাসভবন। এই বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকারের কার্যালয় ও বাংলাদেশ ফোর্সেস বা বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর। এখানকার একটি কক্ষকে কিছুটা সামরিক সদর দপ্তরের অপারেশন রুমের মতো সাজানো হয়েছে। দেয়ালে বাংলাদেশের ম্যাপ লাগানো। ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম স্টাফ অফিসার হিসেবে অনেকটা আর্মি বা ডিভিশন হেড কোয়ার্টারের জিএসও-৩, স্টাফ অফিসারের মতো কাজ করতেন।
ভারতীয় বিএসএফ ও সেনাবাহিনীর চ্যানেলে চলমান যুদ্ধের সিচুয়েশন রিপোর্ট ও সিগনাল ম্যাসেজ আসত। এই বিষয়গুলো ম্যাপে প্লট করা হতো। এই কাজে বিএসএফের কিছু সদস্য সাহায্য করতেন। প্রায় প্রতিদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেই কক্ষে আসতেন। মাঝে মধ্যে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও আসতেন। তাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করতেন বদরুল আলম।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের তুলনায় মে-জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তা কিছুটা কমে যায়। আগস্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন বাড়তে থাকে। ম্যাপে প্রস্ফুটিত হয় সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গনের চিত্র। ব্রিফিংয়ের সময় বদরুল বুঝতে পারেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মনের প্রসন্নতা...।
মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমান বাহিনীর প্রধান) ছিলেন বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। তিনি বাংলাদেশ বাহিনীর অপারেশন ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। স্টাফ অফিসার হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে বিশেষ করে পরিকল্পনা ও সম্পদ সংগঠনে তরুণ বদরুল আলম সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বিভিন্ন বিমান বাহিনীতে বাঙালি বৈমানিকদের যত সুখ্যাতি :
ব্রিটিশ ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে বাঙালি বৈমানিক ও সদস্যদের সুখ্যাতি আমাদের উড্ডয়ন ইতিহাসের অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আকাশযুদ্ধে যে বৈমানিক অধিকসংখ্যক বিমান ভূপাতিত করার পারদর্শিতা প্রদর্শন করেন তাকেই এইস (ইংরেজিতে এসিই) পাইলট বা বৈমানিক বলা হয়। আকাশপথে বিমানযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের (জর্ডান, ইরাক, পাকিস্তান) দেশের খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশি এইস (এসিই) বৈমানিকের নাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম। আকাশপথে অসামান্য পারদর্শিতার জন্য তাকে তিনটি পৃথক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
তিনি ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেন এবং ঠিক দুই বছর পরে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ৪টি বিমান ভূপাতিত করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এমনকি, আজও তিনি ডগ ফাইটে সর্বাধিকসংখ্যক (চার) ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার একক কৃতিত্বের অধিকারী একমাত্র পাইলট। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান জীবন বাজি রেখে করাচি মৌরিপুর বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি টি-৩৩ বিমান হাইজ্যাক করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পাকিস্তানি পাইলটের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে মধ্য আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে প্লেন বিধ্বস্ত হয়। শহীদ হন মতিউর রহমান। স্বাধীনতার পর মতিউর রহমানকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ পদক প্রদান করে জাতীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
পরবর্তীতে বিমান বাহিনী যুদ্ধে অংশ নিলে কিলো ফ্লাইটের বাঙালি বৈমানিকগণ সাইফুল আজম-মতিউর রহমানের সম্মান রক্ষা করেছিলেন।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের ভ্রূণ :
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ কে খন্দকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি মে মাসে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। এ কে খন্দকারের প্রস্তাব শুনে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের কাছে জোর অনুরোধ করলে সিদ্ধান্ত হয় বাঙালি বৈমানিকদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হবে। এজন্য সেপ্টেম্বর মাসে ভারত বাংলাদেশকে একটি অটার বিমান, একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান হস্তান্তর করে। এ তিনটি বেসামরিক এয়ারক্রাফটকে অনেক কষ্ট করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের জন্য নাগাল্যান্ড প্রদেশের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য নির্মিত ৫ হাজার ফুটের একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড ব্যবহার করতে দেয়।
বিমান বাহিনী গঠনে বদরুল আলমের ভূমিকা :
১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হওয়ার সময় বদরুল আলম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিমান বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে ৮নং থিয়েটার রোডের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের জঙ্গলে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন এই বীর যোদ্ধা। এ বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘২২ বা ২৩ সেপ্টেম্বরের কথা। ভারতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এলেন এ কে খন্দকার। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ভারত ৩টি এয়ার ক্রাফট দিয়েছে আমাদের। এখন আমাদের একটা মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং বানাতে হবে। দুজনে বসে পরিকল্পনা করলাম। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অনেক পাইলট ছিল আমাদের। কিন্তু তারা সম্মুখযুদ্ধে চলে গেছেন। ভালো যুদ্ধ করছেন। আমি তখন প্রস্তাব দিলাম আগরতলায় অনেক বেসরকারি এয়ারলাইন্সের পাইলট মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এসেছেন। তাদের মধ্য থেকে আমরা পাইলট নিতে পারি। উনি আমার বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। আমাকেই দায়িত্ব দিলেন পাইলট খুঁজে আনতে। আগরতলা গিয়ে আমি ছয় পাইলসহ ৪৭ জন এয়ারম্যানকে খুঁজে আনলাম। তাদের নিয়ে সরাসরি চলে গেলাম নাগাল্যান্ড রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা ডিমাপুর। সেখানেই সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। ২৮ সেপ্টেম্বর আমাদের এয়ারফোর্স গঠিত হলো।’
কিলো ফ্লাইট নামকরণ :
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। উল্লেখ্য, এই নামটির প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। এ বিষয়ে এ কে খন্দকার পরে লিখেন ‘অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে কর্মরত ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম মুক্তিবাহিনীর এই বিমান বাহিনীকে ‘কিলো ফ্লাইট’ নামে অভিহিত করার প্রস্তাব করেন। মুক্তিবাহিনীতে ইতিমধ্যে ব্যক্তির নামে (জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ ও খালেদ মোশাররফ নামের আদ্যক্ষর নিয়ে যথাক্রমে ‘জেড’ ‘এস’ ও ‘কে’ ফোর্স) ব্রিগেড গঠন করা হয়েছে। তাই বিমান বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে আমার প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ আমার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে (খন্দকারের ‘কে’) বিমান বাহিনীর নামে কিলো ফ্লাইট রাখার অভিমত দেওয়া হয় (১৯৭১ : ভেতরে বাইরে)।
কিলো ফ্লাইটের জন্মস্থান নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল বদরুল আলমের। তবে সেখানে তার আর যাওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি (২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর) বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি দল ডিমাপুর সফর করেছে। এর নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন তানভির মারজান।
কিলো ফ্লাইট গঠন : নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন :
অনেক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (কিলো ফ্লাইট) যাত্রা শুরু হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল ডিমাপুরে আসেন। কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর এ কে খন্দকার এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের কথা ঘোষণা করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ভারতীয় বিমান বাহিনীপ্রধান। উল্লেখ্য, বিমান বাহিনী গঠনে পারিবারিকভাবে বাঙালি-ঘনিষ্ঠ এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লালের অসাধারণ ভূমিকা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম স্কো. লি. সুলতান মাহমুদ, বীরউত্তম (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল, বিমান বাহিনীর প্রধান ও বীরউত্তম)। সুলতান মাহমুদকে কিলো ফ্লাইটের ‘অফিসার কমান্ডিং’ বা অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এ কে খন্দকারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তাকে বিমান বাহিনী প্রধান নিযুক্তি দেয় বাংলাদেশ সরকার।
এ কে খন্দকার বিমানবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং অটার বিমান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বৈমানিকদের দুভাগে ভাগ করা হয়। হেলিকপ্টারের ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় সুলতান মাহমুদকে এবং সহযোদ্ধা (কো-পাইলট) হিসেবে নিয়োজিত হন বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ, বীরউত্তম (প্রাক্তন পিআইএ)।
অটার বিমানের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (পরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন, বীরউত্তম) এবং সহযোদ্ধা হন ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ, বীরউত্তম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ, বীরউত্তম। অপরদিকে ডাকোটা বিমানের ক্যাপ্টেন নিয়োজিত হন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, বীরউত্তম। তার সহযোদ্ধা (কো-পাইলট) হিসেবে নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, বীরপ্রতীক ও ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত, বীরপ্রতীক। চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচনা করায় ডাকোটা বিমানটিকে পরিবহন বিমান হিসেবে কর্নেল ওসমানীকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, কিলো ফ্লাইটে ৩টি বিমানে ৩ জন করে ৯ জন বৈমানিক ছিলেন। এই ৯ জনের ৬ জনই ছিলেন বেসামরিক বৈমানিক। বিমান সেনা ছিলেন মোট ৪৭ জন।
প্রথম অভিযান-অপারেশন নারায়ণগঞ্জ :
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে বিমান হামলা করলে ভারতও পাল্টা বিমান হামলা চালায়। সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের পাশাপাশি বাঙালি বিমানযোদ্ধারাও পাকিস্তানিদের যুদ্ধক্ষমতা হ্রাস করার লক্ষ্যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় বিমান হামলা করবে। ঠিক হয় সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের ইউএসএসও তেল ডিপো এবং শামসুল আলমের নেতৃত্বে অটার বিমানটি পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপোতে বিমান আক্রমণ করবে।
চূড়ান্তভাবে প্রথম অপারেশন পরিকল্পনা হয় ৩ ডিসেম্বর দিবারাত্রে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-ভারত সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ ও চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয় কিলো ফ্লাইটের অপারেশনের মাধ্যমে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমানের মাধ্যমে নয়। তাই ৩ ডিসেম্বর বিমান বাহিনী তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন।
৩ ডিসেম্বর মাঝ রাতে পর্যাপ্ত জ্বালানি ও ১৪টি রকেট সংযোজন করে সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম তার সঙ্গীসহ হেলিকপ্টার নিয়ে ত্রিপুরার কৈলাশহরের তেলিয়ামুড়া থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন। অপরদিকে শামসুল আলম ও তার দল অটার বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
ডার্ক এ্যাশ কালারের ‘কাভারঅল’ পরে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার চালাচ্ছেন সুলতান মাহমুদ। পাশে বসে নেভিগেশনের দায়িত্বে বদরুল আলম। মেশিনগান চালানোর জন্য রয়েছেন সাহসী গানার সার্জেন্ট এম শহিদুল্লাহ, বীরপ্রতীক। সুলতান মাহমুদ যখন রওনা দেন তখন জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক ঝলমল করছিল, যা ছিল হেলিকপ্টারের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। হেলিকপ্টার বেশি উঁচু দিয়ে উড়তেও পারছিল না; পাকিস্তানি রাডারে ধরা পড়ার ভয়ে। তেলিয়ামুড়া থেকে কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ধরে হেলিকপ্টার নায়ারণগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ডেমরায় পৌঁছে যান। তারপর দক্ষিণে মোড় নিয়ে সোজা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো এলাকায় পৌঁছায়।
ডেমরার কাছে এসে গোদনাইল তেলের ডিপো লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিকে মোড় নেন। পাকিস্তানিরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা গোদনাইলের তেলের ট্যাংকারের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। মুহূর্তের মধ্যে ট্যাংকারগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকল। আগুনের লেলিহান শিখা যেন আকাশ গ্রাস করে ফেলল। চারদিক আলোকিত হয়ে পড়ল। গোদনাইল তেলের ডিপোর আগুন জ্বলে পরের দিনও।
এভাবে ঢাকায় পাকিস্তানিদের শক্তিশালী অবস্থানে দুঃসাহসিক আঘাত হেনে তাদের জ্বালানি ডিপোটির ধ্বংস সাধন করে সুলতান-বদরুল আলমদের প্রথম সফল অভিযান সমাপ্ত হয়। চট্টগ্রামেও কিলো ফ্লাইটের মিশন সফল হয়।
মিশন শেষে দুটি এয়ারক্রাফট ফিরলে কিলো ফ্লাইটে আনন্দের বন্যা। এরপর হেলিকপ্টার ও অটার বিমানের পাইলটদের শত্রুর বিরুদ্ধে বিরামহীন আক্রমণ পরিচালিত হয়।
বদরুল আলম ১৯৭১ সালের ৩ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অনেকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। কখনো নিজে হেলিকপ্টর চালিয়ে, কখনো সুলতান মাহমুদ এবং সাহাব উদ্দিনের কো-পাইলট হিসেবে সিলেট, কুলাউড়া, নরসিংদী, কুমিল্লা এবং দাউদকান্দি সেক্টরসমূহে অসংখ্য বিমান অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের মনে দারুণ ভীতির সঞ্চার করেছিল।
সে সময় বদরুল আলম মোট ১৬টি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। অপারেশনগুলো সিলেট ও কুমিল্লা এলাকায় পলায়নমুখী পাকিস্তানি সৈন্যদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। এ ধরনের অসংখ্য বিমান অভিযানের ফলে অল্পদিনের মধ্যেই পাকিস্তানিদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের ভাগ্যে চূড়ান্ত পরাজয় সূচিত হয়েছিল। এই সফল অভিযানগুলো মুক্তিযুদ্ধের আকাশ জয়ের গল্প এবং সামরিক ইতিহাসের বিরল ঘটনা।
১১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত অভিযানের সময় ভারতীয়রা নরসিংদীতে হেলিকপ্টারের সৈন্য নামানোর পরিকল্পনা করে। বদরুল আলম ও সাহাব উদ্দিনের হেলিকপ্টার সেদিন সৈন্যভর্তি ভারতীয় হেলিকপ্টারগুলোকে ‘আমর্ড এসকর্ট’ দিয়েছিল। বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন সাহাব পাকিস্তানিদের ওপর ক্রমাগত রকেট আক্রমণ চালান। এ ছাড়াও কখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপরিচিত জায়গায় (পথপ্রদর্শক এবং উদ্ধার অভিযানের জন্য) ভারতীয় বিমান বাহিনী আক্রমণ পরিচালনার জন্য কিলো ফ্লাইটের সহায়তা নিয়েছিল।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বদরুল আলম :
বদরুল আলম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘জেনারেল ওসমানী ১৬ ডিসেম্বর কুমিল্লায় ছিলেন। তিনি যে হেলিকপ্টারে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করছিলেন, আমি সেই হেলিকপ্টার চালনার দায়িত্বে ছিলাম। সেদিন সকালে আমরা সিগন্যাল মেসেজ পাই যে, হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। প্রথম সময় দেওয়া হয়- দুপুর ১২টায় ওরা আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু সেই মেসেজে আত্মসমর্পণের সময়ে ওসমানী সাহেবের ভূমিকা কী হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিদের কী ভূমিকা হবে সেটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। আপনারা জানেন, ইনস্ট্রুমেন্ট অব স্যারেন্ডার-এ শুধু জেনারেল আরোরার নাম ছিল।
এ ব্যাপারটা আমাদের আঘাত দিয়েছিল। ওসমানী সাহেব ছাড়া আরও কয়েকজন জেনারেল ঢাকায় বা তার কাছাকাছি ছিলেন। তাঁদেরও ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়নি। এ জন্য ওসমানী সাহেব সিলেট যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে হযরত শাহ্জালাল (র.) মাজার জিয়ারত করার একটা মানত আগে থেকেই তাঁর ছিল। এজন্য তাঁর একটা পৃথক হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয় (সাপ্তাহিক মেঘনা, ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬)।
১৬ ডিসেম্বরের এ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন সুলতান মাহমুদ ও সাহাবউদ্দিন আহমেদ। জেনারেল ওসমানীর ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে না যাওয়ার বিষয়ে ওই দু’জন মুক্তিযোদ্ধা থেকে মোটামুটি একই ধরনের বক্তব্য আমি শুনেছি। সে এক অন্য ইতিহাস।
আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৩টায় সুলতান মাহমুদ, সাহাব উদ্দিন আহমদ ও বদরুল আলমসহ ৭ জন বাঙালি পাইলট অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে করে আগরতলা থেকে ঢাকার পথে রওনা হন। এভাবে বদরুল আলম ও সহযোদ্ধা বৈমানিকগণ ১৬ ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেলে মুক্ত নগরী ঢাকায় আসেন।
মুক্তিযুদ্ধে কিলো ফ্লাইটের যত অর্জন :
মোট ৩টি বিমানের মধ্যে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল একটি অটার বিমান এবং একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার। এ দুটি বিমান ডিসেম্বরের ৩ তারিখ রাত থেকে ডিসেম্বরের ১১ তারিখ পর্যন্ত মোট ৪৬টি মিশন (অপারেশন) সম্পন্ন করে। অত্যন্ত সীমিত যুদ্ধ সক্ষমতা নিয়ে এ মিশন সম্পন্ন হয়। এ মিশনগুলো প্রায় সবই ছিল আত্মঘাতী। মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনা নিয়ে কিলো ফ্লাইটের বৈমানিকেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এ কীর্তি অনুপম অহংকারের। এ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ইতিহাসের অনন্ত গর্বের উপকরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে চার্চিল বলেছিলেন, ‘এত অল্প মানুষের কাছে এত বেশিসংখ্যক মানুষের ঋণী হওয়ার কথা এর আগে যুদ্ধের ইতিহাসে শোনা যায়নি’। ১৯৭১ এ আমাদের ক্ষুদ্র বিমান বাহিনীর অবদান বিষয়ে চার্চিলের কথাটি যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, কিলো ফ্লাইটের ৯ জন দুর্ধর্ষ বৈমানিকের মধ্যে আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন শুধু ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন, বীরউত্তম, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, বীরপ্রতীক ও ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত, বীরপ্রতীক। তাদের পর এই বীরত্বমূলক অসাধারণ গল্পগুলো বলার কেউ থাকবে না...। কিলো ফ্লাইটের প্রত্যেকটি অপারেশন এক একটি অ্যাকশনধর্মী অ্যাডভেঞ্চার ফিলমের প্লট উসকে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের এই ‘মহাসম্পদটি’ যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে, বাংলাদেশের তরুণ লেখক ও ফিলম মেকাররা হয়তো একদিন খুব আপসুস করবেন...।
স্বাধীনতার-পরবর্তী জীবন যে রকম :
বদরুল আলম সৌভাগ্যবান পাইলটদের অন্যতম, যিনি পর্যায়ক্রমে ফাইটার বিমান, হেলিকপ্টার ও ট্রান্সপোর্ট এয়ার ক্রাফট চালিয়েছেন। তিনি ১৭ টাইপের এয়ার ক্রাফটে ফ্লাই করেছেন মোট ১৫,৭৭৮ ঘণ্টা। বদরুল আলম তিনটি দেশের বিমান বাহিনীতে (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও লিবিয়া) কর্মরত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর বদরুল আলম বিমান বাহিনী গঠনে বিশেষত হেলিকপ্টার উইংয়ে সম্পৃক্ত ছিলেন। এক সময়ে তৎকালীন সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম ছিলেন একমাত্র ভিভিআইপি পাইলট এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হেলিকপ্টারে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন।
বদরুল আলম আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হেলিকপ্টারের পাইলট হিসেবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেশে যুদ্ধের সেই ধ্বংসকাণ্ড দেখে বঙ্গবন্ধু চোখের জল সংরক্ষণ করতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে বদরুল আলমের রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি।
১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩টি সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। বদরুল আলম হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে চমৎকার সমর্থন দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পাইওনিয়ার।
বদরুল আলম বিমান বাহিনী প্রশিক্ষণেও অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর ট্রেনিং ইউনিটের প্রথম ‘চিফ ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর’। সুলতান মাহমুদের সঙ্গে তিনি ট্রেনিং ইউনিট গড়ে তোলেন। এটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স একাডেমি হিসেবে রূপ লাভ করে।
বিমান বাহিনী ক্যারিয়ারে হঠাৎ কালো মেঘের আনাগোনা :
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে অস্থির হয়ে ওঠে সশস্ত্র বাহিনীর পরিবেশ। বদরুল আলম একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ফলে হঠাৎ তার চমৎকার সামরিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখেও পড়েন। তবে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তাকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়।
কারও জীবন থেমে থাকে না। সামরিক ক্যারিয়ারের দুঃখজনক অকালীন সমাপ্তির পর তিনি বৈমানিকের নতুন ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। বিমান বাহিনীর চাকরি শেষে তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বিমানে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরির পর ১৯৭৭ সালেই তিনি লিবিয়ার বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে তিনি ১৯৮১ সালে পুনরায় বাংলাদেশ বিমানে যোগদান করেন। তিনি বিমানের ফাস্ট অফিসার ও ক্যাপ্টেন হিসেবে এফ-২৭, এপিটি, এয়ার বাস ৩১০ এবং ডিসি-১০ চালনা করেন। বদরুল আলম বাংলাদেশ বিমান থেকে ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত :
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে মাত্র ১০ বছর চাকরি করলেও বদরুল আলম মনেপ্রাণে বিমান বাহিনী অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। তিনি শক্তিশালী ও আধুনিক বিমান বাহিনীর কথা ভাবতেন। এক দিন আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখ, আমরা ৩টি পুরোনো এয়ারক্রাফট দিয়ে বিমান বাহিনী শুরু করেছিলাম। আজ আমাদের পাইলটরা সর্বাধুনিক বিমান চালাচ্ছে। ফ্রান্সের রাফাল, ইউরো ফাইটর বা যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের মতো সর্বাধুনিক বিমান কেনার কথাও ভাবা হচ্ছে’...।
বিমান বাহিনীকে বিদায়ী সালাম :
২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ৫২ বছর পূর্তি উৎযাপন করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। দিবসটির কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন সন্ধ্যায় একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বদরুল আলম ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তরুণ প্রজন্মের বিমান বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক কিছু কথা তিনি বলেন। প্রিয় বিমান বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল বদরুল আলমের শেষ সাক্ষাৎ...।
একদা শাহিন কবরস্থানে নৈঃশব্দময় নির্জনতায় :
বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীরউত্তমের ফিনারেল গত ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন শাহীন কবরস্থানে এসেছিলেন বদরুল আলম। কিছুটা অসুস্থ্ থাকায় কবরস্থানের একপাশে একটি চেয়ারে দীর্ঘ সময় বসেছিলেন।
এই সময় তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, বিমান বাহিনী ও বিশেষত সুলতান মাহমুদের বিষয়ে কথা হয়। তিনি আমাকে নাজমুল আহসান শেখের লেখা ‘পঁচাত্তরে ৩ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী বৈমানিকদের বর্ণনায় বিমান বাহিনীর ভূমিকা’ বইটি উপহার দেন। কথা বলতে বলতে তিনি হারিয়ে যান ১৯৭১ এর রণাঙ্গনে। সামরিক বাহিনীতে রণাঙ্গনের সময়ের বন্ধুত্ব একটা আশ্চর্য শক্তিশালী বিষয়। এই সম্পর্কে মিশে থাকে অদ্ভুত আবেগ।
সুলতান মাহমুদের দাফনের পর একে একে সবাই চলে যান। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে শাহিন গোরস্থানে। বদরুল আলম মুক্তিযুদ্ধ ও সুলতান মাহমুদবিষয়ক স্মৃতি নিয়ে কথা বলে যান...। আমরা কয়জন এই অদ্ভুত পরিবেশে প্রবীণ এক বৈমানিকের স্মৃতি রোমন্থন শুনতে থাকি। একসময় মনে হয়, বদরুল আলম কিলো ফ্লাইটে তার সাবেক অধিনায়ক ও যুদ্ধ সহকর্মী সুলতান মাহমুদের (কবরের) পাশে যতক্ষণ সম্ভব বেশি সময় বসে থাকতে চান। আমরা কজন বসে থাকি কবরস্থানের নৈঃশব্দময় নির্জনতায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না আঁধারে ডেকে যায় আমাদের চারপাশ।
বৈমানিকদের রোমাঞ্চকর যে জীবন :
বিমান বাহিনীর বৈমানিক বা পাইলটদের জীবন রীতিমতো রোমাঞ্চকর। ভারতের এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল লিখিত গ্রন্থ- ‘মাই এয়ারস উইথ আইএএফ’ সামরিক পরিসরে একটি মাস্টার পিস। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে চমৎকার কিছু বই লিখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার ওপর মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও বাংলাদেশের প্রথম বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার লিখেছেন, ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই গ্রন্থে লেখক দায়িত্ব পালনকালে প্রত্যক্ষকৃত মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতি তুলে ধরেছেন। তবে বইটির কিছু বিষয় নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম শওকাত উল ইসলাম লিখেছেন, ‘অবিশ্বাস্য এক যাত্রা : এক জঙ্গি বৈমানিকের রোমাঞ্চকর কাহিনি।’ সাবেক বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মমতাজ উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন : কনসপিরেসি বিহাইন্ড ককপিট, ওডেসি অব এ ফাইটার পাইলট। সাবেক আরেক বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদ লিখেছেন : ‘মাই ডেসটিনি’। বিমান বাহিনীর সুদক্ষ কর্মকর্তা গ্রুপ ক্যাপ্টেন খান মোহাম্মদ নজিবের অত্যন্ত সুলিখিত বই ‘মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানে বন্দিত্বের তিন বছর’।
চলমান যুদ্ধে কোনো বিমান বাহিনী এত প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে এত জীবন বিপন্নকারী মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করে বলে কোনো ইতিহাস নাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীর এই অসাধারণ ভূমিকা নিয়ে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া লিখেছেন অসাধারণ এক গ্রন্থ ‘বিহঙ্গের ডানা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী’। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অসাধারণ ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এই কৃতিত্ব নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘ঈগলস্ ওভার বাংলাদেশ’। এই অসাধারণ বইটির লেখক পিভিএস জাগান মোহন ও সমির চোপড়া।
ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গঠন ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের জোড়হাটের স্টেশন কমান্ডার গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল)। নিবেদিত প্রাণ এই কর্মকর্তা তার প্রবন্ধে ‘দি এয়ার ওয়ার’ এ বাংলাদেশি পাইলটদের কৃতিত্বের কথা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন (লিবারেশন বাংলাদেশ : ১৯৭১। ভারতীয় বিমান বাহিনীর বাঙালি পাইলটের রোমাঞ্চকর জীবন ফুটে উঠেছে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘উইং কমান্ডার’ উপন্যাসে।
ইসরায়েলের গাজা অভিযান ও সামরিক পাইলটের মন :
গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর আক্রমণে গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আমাদের পাইলট বদরুল আলমরা ১৯৭১ এ বাংলার স্বাধীনতার জন্য আকাশযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। অন্যদিকে বর্তমানে প্যালেস্টাইনের গাজায় ইসরায়েলি সামরিক পাইলটরা আত্মরক্ষার অজুহাতে গণহত্যায় জড়িত। গত ৩৫ দিন ধরে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী গাজার ২৩ লাখ মানুষের ওপর যেভাবে (৩২ হাজার টন) বোমা বর্ষণ করেছে তা সাম্প্রতিক সময়ে এক নিষ্ঠুরতম ঘটনা। ইসরায়েলের পাইলটরা এই গণহত্যার জন্য ইতিহাসে ঘৃণার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, তৎকালীন বাঙালি ফ্লা. লে. সাইফুল আজম ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ৪টি ইসরায়েলি বিমান ধ্বংস করে কিংবদন্তি পাইলটে পরিণত হয়েছিলেন।
এখানে প্রতি ১০ মিনিটে একটি শিশু হতাহত হচ্ছে। তবে ইসরায়েলের সব সৈনিকই এ রকম বিবেকহীন হয়তো না। কয়েক বছর আগে গাজায় বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি পাইলট প্যালেস্টাইনিদের ওপর নির্বিচার বোমা বর্ষণের ব্যাপারে তাদের অপারগতা জানিয়েছিলেন। ‘ব্রেকিং সাইলেন্স’ নামে একটি প্লাটফর্মে ইসরায়েলের ইহুদি পাইলটরা তাদের বক্তব্য পেশ করেছিল।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ঢাকায় বেস কমান্ডার ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যামূলক অভিযান অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলে তিনি সাধারণ জনগণের ওপর বোমাবর্ষণের ব্যাপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদেশ অমান্য করেন। পরবর্তীতে এয়ার কমোডর জাফর মাসুদকে বদলি করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
সৈনিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সময় বিবেকের তাড়নার এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে থাকে। এ বিষয়ে ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের একটি কবিতা স্মরণযোগ্য : ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, তাদের ঘৃণা করি না/যাদের রক্ষা করি তাদের ভালোবাসি না।’ (এ্যান আইরিশ এয়ারম্যান ফোর্সেস হিজ ডেথ)।
বর্তমানে গাজার শহর অঞ্চল বা বসতি এলাকার যুদ্ধে হামাসের বিখ্যাত টানেল বা সুড়ঙ্গ যুদ্ধের কথা আলোচিত হচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, (১৯৭২ ডিসেম্বর) পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে বন্দি ১৩ জন বাঙালি তরুণ সেনা কর্মকর্তা জেল কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলা দিয়ে জেলের বিশাল দেয়ালের নিচ দিয়ে টানেল খুঁড়ে জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে এক অন্য ইতিহাস।
শেষের কথা :
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরগণ একে একে চলে যাচ্ছেন। তাঁরা যে স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা ভেবেছিলেন, তা বিনির্মাণ না করতে পারলে এটি হবে একটি জাতীয় ট্রাজেডি। অগ্নিসন্ত্রাস, সংঘাত, সহিংসতা আর নয়। নিজেদের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ নয়। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাক ঐক্যবদ্ধ শান্তির বাংলাদেশ। সুন্দরভাবে গড়ে উঠুক গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ।
অনেক সমালোচনা থাকলেও এটাই সত্য যে, অদ্যাবধি বাংলাদেশের ব্যাপক অর্জনের পেছনে রাজনীতিবিদদের কৃতিত্ব অপরিসীম। তারাই আমাদের পথ দেখিয়েছেন। তারাই পথ দেখাবেন। যদিও দিগন্তে কালো মেঘের আনাগোনা, সংঘাতের পূর্বাভাস। তুবও এ দেশের মানুষ শান্তির আশায় বুক বাঁধে। সমঝোতা-সংলাপ-আলোচনায় দিন শেষে ফুটুক সুষ্ঠু নির্বাচনের সুরভিত ফুল। মসৃণ হোক গণতন্ত্রের পথ চলা। যা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। উন্নয়নের পাশাপাশি একই সঙ্গে এগিয়ে যাক গণতন্ত্র, সুশাসন আর নাগরিক মর্যাদা।
আমাদের যে কজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা যেন জীবনের শেষ বেলায় শান্তি ও সৌহার্দ্যময় বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেন। ওপারে ভালো থাকবেন বীর আকাশযোদ্ধা স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম, বীরউত্তম। স্যালুট টু ইউ স্যার। সালাম।
বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক