রাজনীতিতে সমসময়ই প্রতিদ্ব›দ্বীতা থাকবে, থাকবে প্রতিযোগীতা এমনকি থাকবে সহঅবস্থানও। এটাই রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনীতির এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বীতার নামে অপরাজনীতি, বিষোদ্গার, নেতাদের চরিত্রহণনের নোঙরা মানসিকতা ও মিথ্যাচার ত্রমেই কুলষিত করে তুলছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, রাষ্ট্রগঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সম্প্রতি ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার ব্যাবসয়ী সোহাগকে অত্যন্ত নির্মমভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এই পৈচাশীক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ সারা দেশের মানুষ। দেশের মানুষ সোহাগ হতাকান্ডে জড়িত সকল অপরাধীদের দৃষ্টামূলক শাস্তি চায় এবং এই শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তমান সরকারের। এই হত্যাকান্ডে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের কয়েকজন নেতা কর্মীর জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির হাই কমান্ড ঐসব অভিযুক্ত নেতাদেরকে আজীবনের জন্য দল থেকেও বহিষ্কার করেছে। যেহেতু বিএনপি এখন সরকারে নেই তাই বিএনপির পক্ষে এই সকল অপরাধীদের আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করার কোনে সুযোগ নেই। এখন সম্পূর্ণরূপে বর্তমান সরকারের দায়িত্ব ঐসব অপরাধীদের খূঁজে বের করে দ্রæত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ববস্থা নিশ্চিত করা।
অথচ অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সোহাগ হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে এখন হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করার বদলে রাজনীতির মাঠে অপরাজিনীতি শুরু হয়েছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। বিশেষকরে কয়েকটি দল ও মহল এই ঘটনার পুরো দায়ভার বিএনপির উপর এবং এককভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে যা ইতিমধ্যে ব্যপকভাবে আলোচনা, সমালোচনা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই অপপ্রচার ও বিএনপি নেতাদের চরিত্রহনণের ছবি ও ভিডিওগুলো বেশ সুকৌশলে দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়ও। সোহাগ হত্যাকাÐকে কেন্দ্র করে এখন রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের এক নোঙরা খেলায় মেতে উঠেছে কিছু কিছু দল ও ব্যক্তি যা দেশের রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে কুলষিত করছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে বিএনপিকে দুর্বল করার ও আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার যে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছে তা ইতিমধ্যেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোশাল মিডিয়ায় ও বিভিন্ন টিভি-টক শো’তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
হত্যাকান্ড হত্যাকান্ডই এবং যে কোনো হত্যাকান্ডই অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং যারা হত্যাকান্ড ঘটায় তারা দেশ ও জাতীর শত্রু এবং ক্ষমার অযোগ্য। বিএনপি ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে সোহাগ হত্যাকান্ডে নিন্দা জানিয়েছে এবং সরকারের কাছে অবিলম্বে সকল হত্যাকারীকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবী করেছে। তবে এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিতাপের ও সন্দেহজনক বিষয় হচ্ছে এই নির্মম হত্যােেন্ডের মূল আসামীদেরকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি এবং নিহত সোহাগের পরিবারের পক্ষ থেকে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট থানা মামলার এজাহারে প্রকৃত খুনীদের কয়েকজনের নাম অন্তর্ভূক্ত করেনি। এই অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর। বিএনপির বিরুদ্ধে যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচার ও কুৎসা রটানো হচ্ছে তার আরেকটি প্রমাণ সম্প্রতি খুলনায় বিএনপির একজন নেতাকে পায়ের রগ কেটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং চাঁদপুরে একটি মসজিদের ইমামকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ এই সকল হহত্যাকান্ড নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মহলটি একেবারেই নিশ্চুপ।
সোহাগ হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজটি দেখলে বেশ সহজেই অনুমেয় এটি যে অত্যন্ত সুকৌশলে নিখুঁতভাবে ধারণ করে তা সোশালমিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই পৈশাচিক ও নির্মম হত্যাকন্ডের ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মিছিল বের করে অশালীন ও কুরুচীপূর্ণে স্লোগান শুরু হয়ে যায় এবং সেই ভিডিওগুলোও দ্রæততার সাথে সোশাল মিডিয়ায় চলে আসতে থাকে। সবচাইতে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই ঘটনায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও টার্গেট করা হয় এবং বিভিন্ন স্থানে হাতে গোনা ২০-২৫জন কিশোর-ছাত্র ও তাদের সাথে কিছু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে জিয়াউর রহমানের ছবি মাটিতে ফেলে এই ছবি অবমাননা করে ছবিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যও সোশাল মিডিয়া ও অন্যন্য চিভি চ্যানেলে প্রচারিত হতে দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এটা বেশ নিশ্চিত করেই বলা যায়, যে যেই কিশোররা জিয়াউর রহমানের ছবি অবমাননা ও ছবিতে আগুন দিচ্ছিলো তারা জিয়াউর রহমান কে এবং বাংলাদেশে তার কী ভ‚মিকা- সে সম্পর্কে যে কিছুই জানতো না। সম্পূর্ণ হীন উদ্দেশে এই কিশোরদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কারা এইসব কিশোরদেরকে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে?
রাজনৈতিক সচেতন মহলের অনেকেই মনে করছেন সোহাগ হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে দোষারোপের যে অপরাজনীতি শুরু হয়েছে সেটা বন্ধ করা না গেলে সোহাগ হত্যাকান্ডকে জড়িত প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে এবং দোষীদের প্রকৃত বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত অবিলম্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা যারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিষয়টিকে দেখবে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা যে ভাষায় বিএনপি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অশালীনভাবে বক্তব্য রেখেছেন তা রীতিমতো হতবাক করার মতো যা ইতিমধ্যেই ব্যপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিএনপির বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সোহাগ হত্যার ঘটনায় জিয়াউর রহমানকে টেনে আনা। সর্বত্রই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- এই ইস্যুতে জিয়াউর রহমানকে কেন এবং কারা টার্গেট করলো এবং দৃশ্যপটে আনল? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চরিত্রহণনের এই ঘটনাটি যে বিএনপির বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সেটা বলা যায় নিশ্চিতভাবেই। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে কারা? দেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে এখন রাজনৈতিকভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদেরকে চিহ্নত করতে হবে এবং রাজনৈতিকভাবেই তাদের মোকাবেলা করতে হবে। কারণ লন্ডনে তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের ম্যধকার বৈঠকে যতই সন্তুষ্টির আলোচনা হোক না কেন এখনও নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলা ও যে কোনোভাবে নির্বাচনকে বানচাল করে দেওয়ার প্রচেষ্টা যথেষ্ট জোরেশোরেই চলছে এবং যারা এই প্রচেষ্টার সাথে জড়িত তাদের সকলেরই সম্মিলিত টার্গেট বিএনপি ও তারেক রহমান। বিএনপির অনেক শুভাকাক্সিক্ষরাই মনে করেন লন্ডন-বৈঠকের ফলাফলকে ঘিরে বিএনপির আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই এবং এই ইস্যুতে সরকারকে শতভাগ বিশ^াস করাটা কোনোভাবেই বিএনপির জন্য সমীচিন হবে না।
রাজনীতিতে চরিত্রহণন ও চরিত্রহণনের অপচেষ্টা কখনই কারো জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। বরং এটি সবসময়ই হিতে বীপরিত হতেই বাধ্য এবং ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। ইতিমধ্যে গত দুই-তিনদিনে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোশাল মিডিয়ায় ও বিভিন্ন টিভি-টক শো’তে পরিস্কারভাবে বলেছেন সোহাগ হত্যাকাÐকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবেই বিএনপিকে ফাঁসানো হয়েছে এবং সরকারেরও কোনো কোনো অংশ এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। এই অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিএনপিকে দুর্বল করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে বিএনপির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করা। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, জনাব তারেক রহমান নিজেই ইতোমধ্যে এই ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেছেন এবং গত শনিবার দেয়া এক ভার্চুয়াল ভিডিও বক্তৃতায় তিনি দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এর জন্য ড. ইউনূস সরকারের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন এবং পাশাপাশি স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করেছেন, ‘দেশের এবং বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি এবং অদৃশ্য শত্রæ ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে।’
তারেক রহমানের এই উপলব্ধি জনগনের কাছে তার নিজ মুখে স্পষ্ট করে দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায় বিএনপির উচিত হবে অবিলম্বে নিজ দলকে সুসংগঠিত করে তাদের সমমনা সকল রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও শুভাকাক্সক্ষীদেরকে সাথে নিয়ে জোট ভারী করে দ্রুত নির্বাচন আদায়ে সরকারকে কঠোর বার্তা দেয়া এবং প্রয়োজনে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে কঠোর ও এক দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়া এবং সেটি কালবিলম্ব না করে খুবই দ্রুত।